একেবারে শেষ সময়ে এসে ভোট নিয়ে নানা হিসাব-নিকাশ করছেন সিলেট সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থীরা। এখন তাঁদের নজর নির্দিষ্ট কিছু ‘ভোটব্যাংকের’ ওপর। এসব ভোট নিজেদের পক্ষে টানতে নানা ধরনের কৌশল নিয়েছেন দুটি দলের নেতারা।

সিলেট শহরে ‘ভোটব্যাংক’ হিসেবে পরিচিত গোষ্ঠী মূলত তিনটি। এক. সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, দুই. ইসলাম ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক গোষ্ঠী এবং তিন. আঞ্চলিক ভোট (অন্য জেলা থেকে এসে যাঁরা সিলেটে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন)। এই তিনটি ভোটব্যাংক মোট ভোটারের অর্ধেকেরও বেশি। এসব গোষ্ঠীর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই তিন ভোটব্যাংকের কোনোটাতেই কারও একক প্রাধান্য নেই।

তিন ভোটব্যাংকের মধ্যে সিলেট শহরে সংখ্যালঘু ভোটার সবচেয়ে বেশি বলে ধারণা করা হয়। তবে এই সংখ্যা নিয়ে একাধিক হিসাব পাওয়া গেছে। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতার মতে, সংখ্যালঘু ভোট মোট ভোটারের ১৮ শতাংশ বা প্রায় ৫৮ হাজার হতে পারে। আরেক নেতার মতে, এটা ৯৫ হাজার। বিএনপির মেয়র প্রার্থী আরিফুল হকের মতে, সংখ্যালঘু ভোট আছে ১ লাখ।

বিভিন্ন সূত্র জানায়, সংখ্যালঘুদের মধ্যে বেশির ভাগই হিন্দু সম্প্রদায়ের। মণিপুরি সম্প্রদায়ের ভোট আছে প্রায় ১০ হাজার। অল্পসংখ্যক খ্রিষ্টান ভোটও আছে। গত নির্বাচনে আরিফুল হক সংখ্যালঘুদের ভোটের বড় অংশ পেয়েছেন, এমনটা ধারণা রয়েছে। কিন্তু গত সিটি করপোরেশন নির্বাচন দলীয় প্রতীকে ছিল না। এবার যেহেতু দলীয় প্রতীকে ভোট হচ্ছে তাই সংখ্যালঘুদের ভোট গতবারের মতো আরিফুল পাবেন কি না, তা নিয়ে সন্দিহান অনেকে। তা ছাড়া সংখ্যালঘুদের ভোট যেন গতবারের মতো বিএনপির প্রার্থীর দিকে না যায়, সে জন্য আওয়ামী লীগের কয়েকটি দল কিছুদিন ধরেই কাজ করেছে।

অবশ্য আরিফুল হক প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, এবারও সংখ্যালঘুদের ভোটের বড় অংশ তিনি পাবেন। গতবার নির্বাচিত হওয়ার পর সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে মনোযোগী ছিলেন তিনি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কও ভালো।

ধর্মভিত্তিক দল বা সংগঠনের ভোটও সিলেট সিটি নির্বাচনে ভাগাভাগি হবে, এটা অনেকটাই পরিষ্কার। জামায়াতে ইসলামীর এক নেতা মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। দলটির অন্তত ২৫ হাজার ভোট আছে বলে ধারণা করা হয়। অতীতে এই ভোট বিএনপির বাক্সে যেত। এবার বিএনপির প্রার্থী সেটা হারাচ্ছেন। তবে বিএনপির প্রার্থীর ঘনিষ্ঠজনেরা বলছেন, জামায়াত এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ‘বি-টিম’ বলে এলাকায় প্রচার থাকায় আরিফুল হকের সংখ্যালঘু ভোট ধরে রাখার ক্ষেত্রে কিছুটা সহায়ক হয়েছে।

জমিয়তে উলামা ইসলাম ও খেলাফত মজলিসের স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ দুই নেতার মতে, জামায়াত সংগঠিত এবং প্রচারণায় দক্ষ হওয়ায় তাদের ভোটার অনেক, এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে। এই দুই নেতার মতে, এখানে ইসলামিক দলগুলোর মোট ভোট ৩০ হাজারের মতো। এর মধ্যে জামায়াতের ভোট ২০ হাজারের মতো। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ভোট আছে ৩ থেকে ৫ হাজার। দলটির নিজেদের মেয়র প্রার্থী আছেন। বিএনপি জোটের শরিক জমিয়ত ও খেলাফতের আছে ৩ থেকে ৫ হাজার ভোট। এরা প্রকাশ্যেই বিএনপির সঙ্গেই আছে। এর বাইরে ফুলতলী পীরের একটা প্রভাব আছে। তবে তাঁর অনুসারীদের বেশির ভাগই সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলাভিত্তিক। পীরের অনুসারীরা দুই দলের দিকেই আছেন।

জামায়াতের বাইরে ইসলাম ধর্মভিত্তিক ভোটব্যাংককে কাছে টানতে আওয়ামী লীগ নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে। দলের নেতারা বলেছেন, ইমাম সমিতির সমর্থন তাঁদের প্রার্থীর প্রতি আছে।

বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ব্যক্তিরা সিলেটে আঞ্চলিক ভোটার হিসেবে পরিচিত। এই সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার বলে ধারণা করা হয়। এর মধ্যে বৃহত্তর ময়মনসিংহের মানুষ বেশি। কামরান ও আরিফুল দুজনের শ্বশুরবাড়ি বৃহত্তর ময়মনসিংহে। দুজনের স্ত্রী এই ভোটারদের টানতে ব্যাপক গণসংযোগ করেছেন। আঞ্চলিক ভোট এককভাবে কেউ পাবেন, এমনটা কোনো দলই মনে করে না।

এর বাইরে ১২ হাজার ৬০৭ জন নতুন ভোটার রয়েছেন। তাঁদের কাছে টানতে উন্নয়নের কথা প্রচার করছেন প্রার্থীরা।

তবে তিনটি ভোটব্যাংকের মধ্যে সংখ্যালঘুদের ভোট পাওয়া না-পাওয়ার ওপরই মেয়র প্রার্থীর জয়-পরাজয় অনেকাংশে নির্ভর করবে। অবশ্য এ নিয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে চাননি হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সিলেট শাখার সভাপতি মৃত্যুঞ্জয় ধর। তবে হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বলেন, প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় নৌকার দিকেই ঝোঁক থাকার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে আরিফুলের ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকার সুবাদে তিনিও অনেক ভোট পাবেন।

সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মোট ভোটার ৩ লাখ ২১ হাজার ৭৩২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৭১ হাজার ৪৪৪ জন এবং নারী ১ লাখ ৫০ হাজার ২৮৮ জন। ২০১৩ সালের সিটি নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৩ লাখ ৯ হাজার ১১৫। ওই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে ৩৫ হাজার ১০০ ভোটের ব্যবধানে হেরে যান আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরান।

ভোটব্যাংকের বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী মনে করেন, দুই-একটি উদাহরণ বাদে কোনো ভোটব্যাংকই সিলেটে এবার সেই অর্থে কাজে আসবে না। কারণ, মানুষ এখন অনেক সচেতন। ভোটাররা ব্যক্তি ইমেজকেই প্রাধান্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত ভোট দেবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here