ঝিনাইদহের মেয়ে চিত্রনায়িকা শিমলাকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ
ঢাকাঃ
বাংলাদেশ বিমানের ‘ময়ূরপঙ্খী’ উড়োজাহাজ ছিনতাইয়ের চেষ্টার ঘটনায় করা মামলায় চিত্রনায়িকা শামসুন নাহার শিমলাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম দামপাড়া পুলিশ লাইনসে সংস্থাটির কার্যালয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এসময় পলাশের সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন শিমলা।
উড়োজাহাজ ছিনতাই করতে গিয়ে কমান্ডো অভিযানে নিহত হন সিমলার দ্বিতীয় স্বামী পলাশ আহমেদ। কেন, কী কারণে ছিনতাই করতে চেয়েছিলেন, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে পুলিশ। নিহত পলাশ আহমেদের বিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন তার সাবেক স্ত্রী শামসুন নাহার শিমলা।
তিনি জানিয়েছেন, আর্থিক ও পারিবারিক বিষয়ে পলাশের দেওয়া বেশকিছু তথ্য বিশ্বাস করে শিমলা তাকে বিয়ে করেছিলেন, যা পরে মিথ্যা হিসেবে প্রমাণিত হয়। প্রতারণার শিকার হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পেরে শিমলা তাকে তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে পলাশ অংসলগ্ন আচরণ শুরু করেন। এমনকি ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টার অভিনয়ও করেন পলাশ। বিচ্ছেদের আগে-পরে তিনি মানসিকভাবে বির্পযস্ত ছিল। বারবার চেষ্টা করেও বিচ্ছেদ ঠেকাতে না পেরে মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে পলাশ বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টার মতো ঘটনায় জড়িয়েছিলেন বলে ধারণা শিমলার।
বিমান ছিনতাইচেষ্টার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাটি তদন্ত করছেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিট চট্টগ্রামের পরিদর্শক রাজেস বড়ুয়া। তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে নায়িকা সিমলার সঙ্গে পলাশের কীভাবে কখন পরিচয় হয়, বিয়ে, তালাকসহ দুজনের সম্পর্ক কেমন ছিল, জানতে চাওয়া হয়। পাওয়া তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করা হবে। পলাশ কোনো জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কি না, তাও জানতে চাওয়া হয়। উত্তরে সিমলা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানান। হতাশা থেকে পলাশ এই কাজ করতে পারেন বলে শিমলার ধারণা। তবে কী কারণে হতাশা, তা জানাতে পারেননি। তার এই বক্তব্য সঠিক কি না, আমরা তা যাচাই করে দেখবো।
শিমলাকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বিষয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঝিনাইদহের শৈলকূপা সরকারি ডিগ্রি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে পড়া অবস্থায় ১৯৯৭ সালের ৩ নভেম্বর শিমলা স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসেন। ১১ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট শিমলা এসময় চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হন। ২০১৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকার গুলশানে গ্লোরিয়া জিনস নামে একটি কফিশপে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের সাংবাদিক রাশেদ পলাশের জন্মদিনের পার্টিতে পলাশ আহমেদের সঙ্গে শিমলার পরিচয় হয়। পলাশ তার নামি ‘মাহী বি’ এবং নিজেকে চলচ্চিত্র প্রযোজক হিসেবে পরিচয় দেন। পরিচয়ের কিছুদিন পর শিমলা নিজ থেকেই পলাশকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। ২০১৮ সালের ৬ মার্চ তাদের বিয়ে হয়।
পরিচয়ের পর থেকে বিয়ে পর্যন্ত পলাশ ও শিমলা বিভিন্ন স্থানে দেখা-সাক্ষাৎ করেন এবং বেড়াতে যান। এসময় পলাশ শিমলাকে জানান, তার বাবা লন্ডনের বড় ব্যবসায়ী। তাদের পুরো পরিবার লন্ডনে থাকে। পলাশ নিজেও ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী নাগরিক। ঢাকার উত্তরায় তাদের বাড়ি আছে। নারায়ণগঞ্জেও তাদের একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি আছে।
দু’জনের পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ের পর পলাশ শিমলাকে নিয়ে বনানীর একটি ভাড়া বাসায় ওঠেন। এসময় শিমলা নারায়ণগঞ্জে পলাশের বাড়িতে যেতে চাইলেও পলাশ তাকে বাড়ি নিয়ে যাননি। এর আগে পলাশ বারবার শিমলাকে ডেকে চাপ দিতে থাকেন যেন সাংবাদিকদের ডেকে বিয়ের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু সেই ঘোষণা আর দেওয়া হয়নি।
সূত্রমতে, শিমলা বিয়ের আগ থেকেই ভারতের মুম্বাইয়ে আসা-যাওয়া করতেন। বিয়ের ১৫ দিন পর তিনি শুটিংয়ের কাজে মুম্বাই যান। পলাশ তাকে জানান, তিনিও লন্ডনে চলে যাবেন। শিমলা তাকে বনানীর বাসা ছেড়ে দেওয়ার কথা বললেও পলাশ রাজি হননি। মুম্বাইয়ে অবস্থানরত শিমলাকে ভিডিও কল করে একাধিকবার কথা বলেন পলাশ। এসময় নিজেকে লন্ডনে আছেন প্রমাণ করতে পলাশ ঢাকায় অভিজাত হোটেলে ওঠেন এবং ভিডিও কল করেন বলে পরে শিমলা জানতে পারেন বলে জানিয়েছেন পুলিশকে।
২০১৮ সালের জুলাই মাসে শিমলা মুম্বাইয়ে ছিলেন। এসময় আকস্মিকভাবে পলাশও মুম্বাইয়ে পৌঁছান। মুম্বাই যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে পলাশ জানান, লন্ডনে যাওয়ার পথে ট্রানজিট হিসেবে তিনি মুম্বাইয়ে অবস্থান করছেন। কিন্তু তিন-চারদিন ধরে মুম্বাইয়ে অবস্থান করায় শিমলার সন্দেহ হয়। তিনি পাসপোর্ট দেখতে চাইলে পলাশ সেটা দেখাতে অস্বীকৃতি জানান। মূলত সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়ে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয় সেখান থেকে।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে শিমলা দেশে ফিরেন। এসময় পলাশকে চাপ দিয়ে তিনি তাদের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জে যান। সেখানে গিয়ে পলাশের প্রতারণার বিষয়টি শিমলার কাছে স্পষ্ট হয়। নিজেকে প্রতারিত ভেবে হতাশ হয়ে পড়েন শিমলা। ধীরে ধীরে পলাশের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে। সেটা সহ্য করতে না পেরে পলাশ অসংলগ্ন আচরণ শুরু করেন। সেপ্টেম্বর মাসের এক রাতে শিমলাকে অনেক অনুরোধ করে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য গুলশানে একটি রেস্টুরেন্টের সামনে নিয়ে যান পলাশ। শিমলা গাড়ি নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পলাশ রাস্তায় ঢলে পড়েন। শিমলা বুঝতে পারেন, পলাশ ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টার অভিনয় করছেন। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে শিমলা সেখান থেকে চলে যান। পরে পলাশের আচরণ মানসিক নির্যাতনে রূপ নিলে অক্টোবর মাসে শিমলা বনানী থানায় গিয়ে মৌখিকভাবে অভিযোগ করেন। পুলিশ শিমলাকে মামলা করার পরামর্শ দেন।
তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে শিমলা দাবি করেন, পলাশকে ভালোবাসেন বলে তিনি কোনো আইনি পদক্ষেপ নেননি। কিন্তু দূরত্ব ঘোচাতে ও বিচ্ছেদ ঠেকাতে পলাশ রীতিমতো তার ওপর মানসিক নির্যাতন শুরু করেন।
সূত্রমতে, নভেম্বর মাসে শিমলা আবারও মুম্বাইয়ে চলে যান। যাওয়ার আগে ৫ নভেম্বর পলাশকে তালাকের নোটিশ দিয়ে যান তিনি। এরপর পলাশ তাকে বারবার ফোন করে বিরক্ত করতেন। মোবাইলে মেসেজ দিতেন। কিন্তু শিমলা সাড়া দেননি। এরপর ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মুম্বাইয়ে থাকা অবস্থায় বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা করতে গিয়ে পলাশ আহমেদের মৃত্যুর খবর পান শিমলা।
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে চলে যাওয়ার সময় শিমলা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমি ডিভোর্স দেওয়ার পর সে (পলাশ আহমেদ) মেন্টালি ডিস্টার্বড ছিল বলে আমার মনে হয়েছে। ঘটনা (বিমান ছিনতাইচেষ্টা) শোনার পরও আমার সেটিই মনে হয়েছে। আমি তদন্তকারী কর্মকর্তাকেও সেটি বলেছি। এমনকি তদন্তেও তার মানসিক সমস্যার বিষয়টি এসেছে বলে আমি জানতে পেরেছি।’
ডিভোর্স কেন হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় কোনো কারণ ছিল, সেজন্য ডিভোর্স দিয়েছি। কিছু মানসিক সমস্যা ছিল পলাশের।’
চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ময়ূরপঙ্খী উড়োজাহাজটির (বিজি-১৪৭ ফ্লাইট) ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিকেল ৫টা ৫ মিনিটে ছেড়ে চট্টগ্রাম হয়ে দুবাই যাওয়ার কথা ছিল। ঢাকা থেকে উড্ডয়নের পরই উড়োজাহাজটি ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে। প্রায় ২ ঘণ্টার টান টান উত্তেজনার পর উড়োজাহাজ ছিনতাইচেষ্টার অবসান ঘটে। কমান্ডো অভিযানে ছিনতাইয়ের চেষ্টাকারী ব্যক্তি নিহত হন। পরে র্যাব জানায়, নিহত ব্যক্তির নাম মো. পলাশ আহমেদ। বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থানার পিরিজপুরে। বাবার নাম পিয়ার জাহান সরদার। পরদিন সন্ত্রাসবিরোধী আইনে এবং বিমান নিরাপত্তাবিরোধী অপরাধ দমন আইনে মামলা করে তা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটকে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, উড়োজাহাজে থাকা এক তরুণ বোমাসদৃশ বস্তু ও অস্ত্র দেখিয়ে ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেন। তার কিছু দাবিদাওয়ার কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে শোনানোর জন্য উড়োজাহাজের ক্রুদের বলেন। একপর্যায়ে পটকা-জাতীয় বস্তুর বিস্ফোরণ ঘটান। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া না হলে বিমানটি ধ্বংসের হুমকি দেন পলাশ। দুষ্কৃতকারী বোমাসদৃশ বস্তু দেখিয়ে বিমানের ককপিটে ঢুকতে চেষ্টা করেন। এ সময় তাঁর কাছে বোমা ও অস্ত্রসদৃশ বস্তু দেখা যায়। পরে বিমানটি চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। যাত্রী ও ক্রুদের নিরাপদে জরুরি নির্গমন পথ দিয়ে নামানো হয়। ইতিমধ্যে বিমানটি ছিনতাইয়ের খবর দেওয়া হলে র্যাব, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো এসে উপস্থিত হয়। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আহত ওই তরুণকে বিমান থেকে নামানো হয়। পরে দেখা যায় তিনি মারা গেছেন।
পরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ফরেনসিক পরীক্ষায় জানা যায়, পলাশের হাতে থাকা সেদিনের পিস্তলটি ছিল দেশে তৈরি প্লাস্টিকের খেলনা। গত ২৪ মার্চ কাউন্টার টেররিজমের একটি দল পলাশের বাবা পিয়ার জাহান, মা রেনু বেগম, চাচা দ্বীন ইসলামসহ আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীসহ ১০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।