ঝিনাইদহঃ

পুরো নাম শের আলী মিয়া হাওলাদার। জাতীয় পরিচয়পত্র মোতাবেক বয়স ১১০ বছর। কিন্তু এই বয়স তার আসল বয়স না। মিডিয়া ও দর্শনাথীদের উটকো ঝামেলা থেকে বাঁচতে তার ছেলেরা পিতার বয়স ১৪ বছর কমিয়ে দিয়েছেন। এ কথার সত্যতা মিলেছে বৃদ্ধ শের আলীর কথায়।

১১৫ বছর পর্যন্ত তিনি মাঠেও কাজ করেছেন। এখনো নিজে ওযু করে ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন শের আলী হাওলাদার। জীবনে কোন শারিরীক সমস্যা তাকে স্পর্শ করেনি। জীবন সায়াহ্নে এসেও তিনি এক প্রাণবন্ত মানুষ।

পরিবারের দাবী, শের আলী মিয়াই পৃথিবীর দীর্ঘজীবী পুরুষ মানুষ।

পরিবারের দেওয়া তথ্য মতে, শের আলী মিয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৪ সালের জুলাই মাসে। আর বাংলা সন ছিল ১৩০০ সালের ভাদ্র মাস। আসছে ভাদ্র মাসে শের আলী মিয়ার বয়স ১২৫ বছর পূর্ণ হবে বলে জানান তার ছোট ছেলে শহিদুল ইসলাম। বর্তমান তার বয়স ১২৪ বছর।

ভাঙ্গা ভাঙ্গা অনেক স্মৃতি রোমন্থন করেন তিনি। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর সময় শের আলী মিয়া সবে কৈশর থেকে যৌবনে পা রেখেছেন। শের আলী ও তার পরিবারের দেওয়া এই তথ্য সঠিক হলে ১২৪ বছর বয়সী শের আলী মিয়াই হবেন পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘজীবী পুরুষ।

যদিও বর্তমান জাপানের ১১২ বছর বয়সী নাগরিক মাসাজো নোনাকা পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বয়সী পুরুষ হিসেবে গিনেস বুকে স্থান পেয়েছেন। মাসাজো নোনাকার চেয়ে ঝিনাইদহের শের আলী ১২ বছরের বড়।

অতি-ভোরে ফজরের নামাজ পড়েই শের আলী মিয়া খেতে চান। সকালে তিনি চিড়া ও আম খান। এরপর চা খাওয়ার অভ্যাস তার নিয়মিত। দুপুরে যতসামান্য ভাত। রাতে ভাতের সঙ্গে দুধ আর মিষ্টি দিতেই হবে। দুধ না দিলে ভাত খান না।

রাত জেগে ইবাদত করার অভ্যাস শের আলী মিয়ার। এই বয়সেও কোন ওষুধ খেতে হয় না। চুল দাড়ি অনেকটাই কাচা আছে। জ্ঞান, দৃষ্টি ও শ্রবণ শক্তি ভাল থাকায় নিজের কাজ নিজে করতে পারেন।

ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কুলবাড়িয়া গ্রামে শের আলী মিয়ার বাড়ি। পিতার নাম মৃত আমির আলী বক্স। মাতা জয়গুন নেছা ওরফে যমুনা বিবি। শের আলী মিয়া ৭ প্রজন্মকে দেখছেন। ছেলে ও মেয়ের সন্তানসহ ৯০ জন বংশধর তার। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর ছোট মেয়ে মনোয়ারা বেগমের বর্তমান বয়স ৭০ বছর। ছোট ছেলে শহিদুল ইসলামের বয়স ৫২ বছর। প্রথম পক্ষের স্ত্রীর বড় মেয়ে আনোয়রা খাতুন জীবিত থাকলে এখন তার বয়স হতো ৮৪ বছর। ২০০৪ সালে ৭৬ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন আনোয়ারা খাতুন।

নিজের জন্ম সাল মনে না থাকলেও শের আলী জানালেন, শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার রাহাপাড়া গ্রামে তারা বসবাস করতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশরা সৈন্য সংগ্রহ শুরু করে। তখন শের আলী ও তার বড় মামা আমজাদ আলী সরদার যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ব্রিটিশ সৈন্য দলে নাম লেখান। সে সময় তারা তাকে একটি সার্টিফিকেটও দেন, যেটি তার ছেলেরা হারিয়ে ফেলেছেন। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে তার মা-বাবাসহ বাড়ির সবাই কান্নাকাটি শুরু করেন। যুদ্ধে যাওয়া বাধ্যতামূলক করে ব্রিটিশ নেতৃত্বাধীন জোট ফরমান জারী করলে শের আলী মিয়া ও তার বড় মামা তখন যুদ্ধে না গিয়ে পালিয়ে যান ভারতের বনগাঁর কাঠালিয়া গ্রামে। পরবর্তীতে স্বপরিবারে ভারতে বসবাস শুরু করেন। আনুমানিক ২০/২২ বছর বয়সে তিনি পার্শ্ববর্তী ফরিদপুরের নলতা গ্রামের করম আলী খুনকারের মেয়ে আছিয়া খাতুনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

প্রথম পক্ষের এক কন্যা সন্তান হওয়ার পর স্ত্রীর আর কোন সন্তান হবে না জানতে পেরে তিনি একই গ্রামের তমিজ উদ্দীন মাঝির কন্যা রূপভান বেগমকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে ঘরে তোলেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে তার ৫ ছেলে ও ১ মেয়ে। ১৯৬৮ সালে ছোট স্ত্রী রূপভান ও ১৯৯৯ সালে বড় স্ত্রী আছিয়া খাতুন ইন্তেকাল করেন।

শের আলী মিয়ার ভাষ্য মতে, ১৯৪৬ সালে ভারতের পাঞ্জাবে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা শুরু হলে সম্পত্তি বিনিময় করে তিনি ৫ ভাই ও পিতা মাতার সঙ্গে চলে আসেন যশোরের চৌগাছা উপজেলার ভাদড়া গ্রামে। ভাদড়ায় এসে দেখেন মুসলিমদের নামাজ পড়ার কোন মসজিদ গ্রামে নেই। ১০/১৫ ঘর মানুষের বেশিরভাগ মুসলিম সেখানে হিন্দু রীতি অনুসরণ করেন। এসব দেখে তিনি নিজের ঈমান আকিদা রক্ষা করতে চলে আসেন ঝিনাইদহের কুলবাড়িয়া গ্রামে। রাস্তাহীন গ্রামে এসে তিনি ও তার ভাইয়েরা কুড়ে ঘর বেঁধে বসবাস শুরু করেন। কুলবাড়িয়ার ইয়াকুব আলীর মাধ্যমে জমি কেনেন ৬৫ বিঘা।

পিতা সম্পর্কে শের আলী মিয়ার ছেলে স্কুল শিক্ষক আব্দুল হক জানান, তার পিতার বয়স এখন ১২৪ বছর চলছে। দেশে যখন ভোটার তালিকা হয়, তখন পিতার আদেশেই তিনি বয়স কমিয়ে দিয়েছিলেন।

তিনি আরও বলেন, তার পিতার বড় মামা আমজাদ সরদার তখনকার সময় শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। তার ডায়রিতেই তার পিতার জন্ম তারিখ লেখা ছিল, যেটি তারা দেখেছেন।

বড় ছেলে ফজল মিয়া বলেন, তার পিতা জীবদ্দশায় ৯ বার বাড়ি বদল করেছেন। ভারতের কাঠালিয়া, পাচপোতা, যশোরের ভাদড়া, রহমতপুর, বর্তমান গ্রামের তিন স্থানেসহ ৯টি স্থানে ঘরবাড়ি করেছেন। ঘন ঘন বাড়ি পরিবর্তনের কারণে ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া সেনা রিক্রুটের সনদটি হারিয়ে যায় বলে জানান ফজল মিয়া।

মহারাজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খুরশিদ আলম জানান, কুলবাড়িয়া গ্রামের শের আলী মিয়া হতে পারেন বিশ্বের সবচেয়ে প্রবীণতম পুরুষ। জাতীয় পরিচয়পত্রে তার বয়স কম দেখানো হয়েছে এটা সত্য। প্রকৃতপক্ষে বৃদ্ধ শের আলীর বয়স অনেক বেশি। মিডিয়াসহ দর্শনার্থীদের ভীড় এড়াতে এই পথ অবলম্বন করেন বলে চেয়ারম্যান খুরশিদ আলমও জানান।

আমাদের সম্পর্কে আপনার বার্তা কি? জানতে চাইলে বৃদ্ধ শের আলী মিয়া বলেন, “নামাজ পড়তে হবে, রোজা রাখতে হবে। আর বে-নামাজীর হাতে খাবেন না এই হলো আমার কথা।”

শের আলী মিয়ার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের উপায়, ছেলে আব্দুল হক মাস্টার ০১৮৭৫৪৪৩০৮৬, ছোট ছেলে শহিদুল ০১৭১৪৯৫৯৪৫১, পোতা (পৌত্র) ইউসুফ ০১৯১৬০৫১৩০২।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here