ঢাকা ১২:৪৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২২ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ঝিনাইদহে এসআইয়ের কাণ্ড: ৮০ হাজার টাকা না দিলে সকালেই কোর্টে চালান

 

‘টাকা দিতে হবে আশি হাজার। রাতেই দিতে হবে। নইলে সকালেই কোর্টে চালান করে দেব।’-কথাগুলো বলেছেন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নারিকেলবাড়িয়া পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ এসআই আব্দুস সালাম। শেষ পর্যন্ত আশি হাজার টাকার বিনিময়ে মুক্তি মিলেছে সদর উপজেলার বাটিয়াডাংগা গ্রামের মৃত মহসীন শেখের ছেলে আব্বাস আলী শেখ (৭০), মহেশপুর উপজেলার আয়ুব হোসেনের ছেলে মো. কালাম প্রধান, যশোর বাঘারপাড়া উপজেলার তেলেধন্য গ্রামের মহর আলী মোল্লার ছেলে মো. মাসুদ রানা, মহেশপুর বাগানঘাট গ্রামের হানেফ আলীর ছেলে সাব্বির হোসেন, একই গ্রামের মৃত হানেফ আলীর ছেলে আবুল কাসেমের। এরা ভাঙ্গারি (পুরাতন মালামাল) ব্যবসায়ী।

ঘটনাটি ঘটে মঙ্গলবার (১৭ জুন) রাত পৌনে ১২টার দিকে ঝিনাইদহ সদর থানায়। শুক্রবার খবর ফাঁস হলে তোলপাড় শুরু হয়। নড়েচড়ে বসেন জেলা পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা। মাঠে নামেন পুলিশের বিশেষ গোয়েন্দা দল। এদিকে ঘটনা ধামাচাপা দিতে দালালচক্র মরিয়া হয়ে উঠেছে।

ভুক্তভোগীদের একজন আব্বাস আলী বলেন, ভ্যানে গ্রামে গ্রামে ঘুরে পুরাতন (ভাঙ্গারি) মালামাল ফেরি করে কিনে থাকেন তারা। মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে সদর উপজেলার দিঘিরপাড় গ্রাম থেকে কেজিদরে পুরাতন লোহালক্কড় কিনে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ফিরছিলেন। এ সময় নারিকেলবাড়িয়া পুলিশ ক্যাম্পের এসআই আব্দুস সালাম ভ্যান-রিকশাসহ আটক করে তাদের পুলিশ ক্যাম্পে নিয়ে আসে। ক্যাম্পে নিয়ে মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় এবং ৫ জনকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশ ক্যাম্পে আটক রাখার পর ঝিনাইদহ সদর থানায় নিয়ে আসে। সেখানে তাদের থানাহাজতে রাখার পর চলতে থাকে দেনদরবার। টাকা না দিলে একাধিক মামলায় জড়িয়ে পরদিন (বুধবার) কোর্টে চালান করে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়। অবশেষে রাত পৌনে ১২টার দিকে ৮০ হাজার টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিতে রাজি হন এসআই আব্দুস সালাম (ক্যাম্প ইনচার্জ)।

মঙ্গলবার রাতে থানায় উপস্থিত জেলা শহরের খালপাড়ের বাসিন্দা মঞ্জু জোয়ারদারের স্ত্রী মোছা. আদরিকা বলেন, থানায় ডিউটি অফিসারের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আশি হাজার টাকা দিতে রাজি হয় ভুক্তভোগীরা। তিনি আরও জানান, টাকা লেনদেনের সময় চিল্লাচিল্লি করেও লাভ হয়নি। পাঞ্জাবি পরা এক দালালের মাধ্যমে ঘটনাটি ঘটে। ওইদিন সদর থানায় বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন বলে জানান এই প্রত্যক্ষদর্শী। এ সময় তারা তিন নারীসহ অন্তত ৫ জন থানায় উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া ছিলেন রাজনৈতিক নানা পরিচয়ে আরও অনেকে।

কথা হয় ভুক্তভোগী আব্বাসের অসুস্থ স্ত্রী পারভীন বেগম ও মেয়ে রিপা খাতুনের সঙ্গে। তারা বলেন, এসআই সরাসরি আশি হাজার টাকা চেয়েছেন এবং বলেছেন ওই রাতেই দিতে হবে। সকাল হলেই কোর্টে চালান করে দেবে। টাকা না দিলে তিনটি ডাকাতি মামলায় তাদের চালান করে দেওয়ার হুমকি দেন এসআই আব্দুস সালাম। নিরুপায় হয়ে আশি হাজার টাকা দিতে বাধ্য হয়েছেন তারা।

জানতে চাইলে এসআই আব্দুস সালাম বলেন, মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে বামুনাইল এলাকার তৃমহনী থেকে ভ্যান বোঝাই মালামালসহ ৫ জনকে ধরে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সন্ধ্যার দিকে আটক ব্যক্তিদের সদর থানায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং রাত অনুমান পৌনে ১২টার দিকে দিঘিরপাড় গ্রামের কলেজ শিক্ষক সাবুর আলী মল্লিকের জিম্মায় মুচলেকা নিয়ে থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

আশি হাজার টাকা লেনদেনের বিষয়টি সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, ওসি সাহেবের নির্দেশে আটক ব্যক্তিদের থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সদর থানার ওসি আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না থাকায় মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। লেনদেনের কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন তিনি।

এদিকে গ্রেফতার বাণিজ্যের খবর জানাজানি হলে বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে ঘুসের টাকা ফেরত দিতে খোরশেদ নামের কথিত দালালকে সঙ্গে নিয়ে সদর উপজেলার ডাকবাংলা বাজারে যান এসআই আব্দুস সালাম। সেখানে একটি চায়ের দোকানে ভুক্তভোগী আব্বাসের ছেলে ইমরানের কাছে টাকা ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।

ঝিনাইদহ জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এমরান জাকারিয়া বলেন, ঘটনাটি দুঃখজনক। তদন্তে প্রমাণিত হলে অবশ্যই দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সবুজদেশ/এসএএস

Tag :

ঝিনাইদহে এসআইয়ের কাণ্ড: ৮০ হাজার টাকা না দিলে সকালেই কোর্টে চালান

Update Time : ০৯:৪১:৩৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ জুন ২০২৫

 

‘টাকা দিতে হবে আশি হাজার। রাতেই দিতে হবে। নইলে সকালেই কোর্টে চালান করে দেব।’-কথাগুলো বলেছেন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নারিকেলবাড়িয়া পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ এসআই আব্দুস সালাম। শেষ পর্যন্ত আশি হাজার টাকার বিনিময়ে মুক্তি মিলেছে সদর উপজেলার বাটিয়াডাংগা গ্রামের মৃত মহসীন শেখের ছেলে আব্বাস আলী শেখ (৭০), মহেশপুর উপজেলার আয়ুব হোসেনের ছেলে মো. কালাম প্রধান, যশোর বাঘারপাড়া উপজেলার তেলেধন্য গ্রামের মহর আলী মোল্লার ছেলে মো. মাসুদ রানা, মহেশপুর বাগানঘাট গ্রামের হানেফ আলীর ছেলে সাব্বির হোসেন, একই গ্রামের মৃত হানেফ আলীর ছেলে আবুল কাসেমের। এরা ভাঙ্গারি (পুরাতন মালামাল) ব্যবসায়ী।

ঘটনাটি ঘটে মঙ্গলবার (১৭ জুন) রাত পৌনে ১২টার দিকে ঝিনাইদহ সদর থানায়। শুক্রবার খবর ফাঁস হলে তোলপাড় শুরু হয়। নড়েচড়ে বসেন জেলা পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা। মাঠে নামেন পুলিশের বিশেষ গোয়েন্দা দল। এদিকে ঘটনা ধামাচাপা দিতে দালালচক্র মরিয়া হয়ে উঠেছে।

ভুক্তভোগীদের একজন আব্বাস আলী বলেন, ভ্যানে গ্রামে গ্রামে ঘুরে পুরাতন (ভাঙ্গারি) মালামাল ফেরি করে কিনে থাকেন তারা। মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে সদর উপজেলার দিঘিরপাড় গ্রাম থেকে কেজিদরে পুরাতন লোহালক্কড় কিনে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ফিরছিলেন। এ সময় নারিকেলবাড়িয়া পুলিশ ক্যাম্পের এসআই আব্দুস সালাম ভ্যান-রিকশাসহ আটক করে তাদের পুলিশ ক্যাম্পে নিয়ে আসে। ক্যাম্পে নিয়ে মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় এবং ৫ জনকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশ ক্যাম্পে আটক রাখার পর ঝিনাইদহ সদর থানায় নিয়ে আসে। সেখানে তাদের থানাহাজতে রাখার পর চলতে থাকে দেনদরবার। টাকা না দিলে একাধিক মামলায় জড়িয়ে পরদিন (বুধবার) কোর্টে চালান করে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়। অবশেষে রাত পৌনে ১২টার দিকে ৮০ হাজার টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিতে রাজি হন এসআই আব্দুস সালাম (ক্যাম্প ইনচার্জ)।

মঙ্গলবার রাতে থানায় উপস্থিত জেলা শহরের খালপাড়ের বাসিন্দা মঞ্জু জোয়ারদারের স্ত্রী মোছা. আদরিকা বলেন, থানায় ডিউটি অফিসারের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আশি হাজার টাকা দিতে রাজি হয় ভুক্তভোগীরা। তিনি আরও জানান, টাকা লেনদেনের সময় চিল্লাচিল্লি করেও লাভ হয়নি। পাঞ্জাবি পরা এক দালালের মাধ্যমে ঘটনাটি ঘটে। ওইদিন সদর থানায় বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন বলে জানান এই প্রত্যক্ষদর্শী। এ সময় তারা তিন নারীসহ অন্তত ৫ জন থানায় উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া ছিলেন রাজনৈতিক নানা পরিচয়ে আরও অনেকে।

কথা হয় ভুক্তভোগী আব্বাসের অসুস্থ স্ত্রী পারভীন বেগম ও মেয়ে রিপা খাতুনের সঙ্গে। তারা বলেন, এসআই সরাসরি আশি হাজার টাকা চেয়েছেন এবং বলেছেন ওই রাতেই দিতে হবে। সকাল হলেই কোর্টে চালান করে দেবে। টাকা না দিলে তিনটি ডাকাতি মামলায় তাদের চালান করে দেওয়ার হুমকি দেন এসআই আব্দুস সালাম। নিরুপায় হয়ে আশি হাজার টাকা দিতে বাধ্য হয়েছেন তারা।

জানতে চাইলে এসআই আব্দুস সালাম বলেন, মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে বামুনাইল এলাকার তৃমহনী থেকে ভ্যান বোঝাই মালামালসহ ৫ জনকে ধরে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সন্ধ্যার দিকে আটক ব্যক্তিদের সদর থানায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং রাত অনুমান পৌনে ১২টার দিকে দিঘিরপাড় গ্রামের কলেজ শিক্ষক সাবুর আলী মল্লিকের জিম্মায় মুচলেকা নিয়ে থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

আশি হাজার টাকা লেনদেনের বিষয়টি সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, ওসি সাহেবের নির্দেশে আটক ব্যক্তিদের থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সদর থানার ওসি আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না থাকায় মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। লেনদেনের কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন তিনি।

এদিকে গ্রেফতার বাণিজ্যের খবর জানাজানি হলে বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে ঘুসের টাকা ফেরত দিতে খোরশেদ নামের কথিত দালালকে সঙ্গে নিয়ে সদর উপজেলার ডাকবাংলা বাজারে যান এসআই আব্দুস সালাম। সেখানে একটি চায়ের দোকানে ভুক্তভোগী আব্বাসের ছেলে ইমরানের কাছে টাকা ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।

ঝিনাইদহ জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এমরান জাকারিয়া বলেন, ঘটনাটি দুঃখজনক। তদন্তে প্রমাণিত হলে অবশ্যই দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সবুজদেশ/এসএএস