নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
ঝিনাইদহে জলাশয় সংস্কারের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। খননের পরিবর্তে ট্রাক্টর দিয়ে নদীর মাটি সমান করা হচ্ছে। সিন্ডিকেট সদস্যরা নামমাত্র খনন দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা পকেটে ভরছেন। প্রভাবশালী মহল, মৎস্য বিভাগের কিছু অসৎ কর্মকর্তা ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। জেলা মৎস্য বিভাগের ভূমিকাও রহস্যজনক। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে অনিয়ম-দুর্নীতির সেই চিত্র।
জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্য মতে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে ঝিনাইদহে তিন কোটি ১০ লাখ ১১ হাজার টাকা ব্যয়ে ৩০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে সদর উপজেলায় সাতটি, শৈলকুপায় আটটি, হরিণাকুণ্ডু উপজেলায় ১০টি ও কালীগঞ্জ উপজেলায় পাঁচটি প্রকল্প। স্কিম প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ নির্দেশিকা সূত্রে জানা গেছে, সুফলভোগীরা হবেন প্রকল্প এলাকার ভূমিহীন, প্রান্তিক চাষি, গরিব বেকার যুবক, মহিলা, আনসার ভিডিপি সদস্য ও মৎস্য চাষে আগ্রহী ব্যক্তিরা। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, সুফলভোগীর তালিকায় এমন সব ব্যক্তির নাম রয়েছে যারা কেউ প্রকল্প এলাকার বসিন্দা নন।
জানা গেছে, হরিণাকুণ্ডু উপজেলার নবগঙ্গা নদীর সোনাতনপুর-ভুয়াপাড়া (বাওড়) অংশের শ্রেণি পরিবর্তন করে জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে লিজ দেওয়া হয়েছে। নদীর এ অংশে কমপক্ষে চারটি বাঁধ দেওয়া হয়েছে। সরেজমিন পরির্দশনে গত মঙ্গলবার দুপুরের পর দেখা যায়, অন্তত দেড় ডজন ট্রাক্টর পানিশূন্য ওই নদীতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। নদীর পাড়ে উৎসুক জনতা ভিড়। একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, ওই এলাকার চিহ্নিত দুই-তিনজন প্রভাবশালী মৎস্যজীবী সেজে ট্রাক্টর দিয়ে নদীর তলদেশ সমান করে সংস্কারের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের লাখ লাখ টাকা লুটে নিচ্ছেন। ঘটনাস্থলে পাওয়া গেল অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ভেড়াখালী দক্ষিণপাড়ার এলেম মণ্ডলকে। তিনি মাটি খনন প্রকল্পের এলসিএস কমিটির একজন দলনেতা। শত শত মানুষের সামনে নদীর তলদেশ সমান করা হলেও অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি। তার কথা শুনে উপস্থিত এলাকাবাসী হাসাহাসি করতে থাকেন।
এ বিষয়ে দৌলতপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী সরাসরি অভিযোগ করেন, এভাবে মাটি খননের পরিবর্তে ট্রাক্টর দিয়ে তলদেশ সমান করে সরকারের অর্থ হরিলুট হচ্ছে। মাছ চাষের অজুহাতে এখানে নদীতে কাউকে নামতে দেওয়া হয় না। পাট পচাতে পারে না কৃষক। গ্রামবাসীদের মিথ্যা মামলায় পুলিশ হয়রানি করা হয়। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন অন্তত পাঁচ গ্রামের মানুষ। বর্ষা মৌসুমে তলিয়ে যাচ্ছে এলাকার হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল। সামনের বর্ষা মৌসুমে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন তিনি।
অনুসন্ধানকালে জেলা মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে সরবরাহ করা ৩০টি প্রকল্পের মধ্যে শৈলকুপা উপজেলার নয়টি ও হরিণাকুণ্ডু উপজেলার নয়টির সুফলভোগীদের তালিকায় ধরা পড়েছে চরম অনিয়ম। হরিণাকুণ্ডু উপজেলার কাপাসাটিয়া বাঁওড়ের পুনঃখননের জন্য পাঁচটি এলসিএস (সুফলভোগী) কমিটি গঠন দেখানো হয়েছে। এ কমিটির দল নেতারা কেউ ওই এলাকার বাসিন্দা নন বলে স্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শরাফৎ দৌলা ঝন্টু।
প্রকল্পের নীতিমালা অনুযায়ী দলনেতাদের নামে সোনালী ব্যাংকে পৃথক পৃথক অ্যাকাউন্টে মাটি খনন বাবদ টাকা প্রদান করা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, লুটপাট ও টাকা ভাগভাগি নিরাপদ করতে স্কিম দাখিল, যাচাই-বাছাই ও অনুমোদন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা/মৎস্য কর্মকর্তা, দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারী প্রকৌশলীর সহায়তায় স্কিম বা প্রকল্প প্রস্তুত পূর্বক সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় প্রকৌশলীর স্বাক্ষরসহ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ডিএফও) বরাবর দাখিল করতে হবে। পরবর্তী পর্যায়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আরেক দফায় যাচাই-বাছাই করে মতামতসহ প্রকল্প পরিচালক বরাবর দাখিল করবেন। অথচ করা হয়েছে নীতিমালার বাইরে এলএসসি (সুফলভোগী) কমিটির সদস্য করা হয়েছে সিন্ডিকেটের লোকজনকে।
সিন্ডিকেটের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করে বলেছেন, প্রকল্প অনুমোদন থেকে শুরু করে বিল পাওয়া পর্যন্ত শতকরা ৪০ ভাগ টাকা খরচ হয়ে যায়। বাকি ৬০ ভাগ টাকা দিয়ে মাটি খনন দেখাতে হয় ও টাকা দিয়ে ম্যানেজ করতে হয় প্রকল্পের এলসিএস কমিটির সদস্যদের। এরপরও মৎস্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ও হিসাব রক্ষণ অফিসেও কমিশন দিতে হয়। ঘাটে ঘাটে অর্থ ব্যয় করে লাভ হয় সামান্যই। আপনারা লেখালেখি করলে তদন্ত সামাল দিতে আরও কিছু টাকা খরচ হবে।
হরিণাকুণ্ডু ও শৈলকুপা উপজেলার দায়িত্বরত মৎস্য কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম ট্রাক্টর দিয়ে মাটি সমান করার সত্যতা স্বীকার করে ফোনে বলেন, সঠিকভাবে মাটি খনন না করলে এক পয়সাও দেওয়া হবে না। বিষয়টি নিয়ে মৎস্য বিভাগীয় উপ-সহকারী প্রকৌশলী সোহেল আহম্মেদের সঙ্গে কথা বলতে বলেন তিনি। ওই প্রকৌশলীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে কথা বলেননি তিনি।
ঝিনাইদহ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আলফাজ উদ্দীন শেখও একই আচরণ করেছেন। বুধবার তার দপ্তরে তালা ঝুলতে দেখা যায়।
ওই দপ্তরের হিসাব রক্ষক শওকত আলীর কাছ থেকে জানা যায়, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা থাকেন পাশের জেলা কুষ্টিয়াতে। অন্য কর্মকর্তারাও কেউ নিয়মিত অফিসে আসেন না বলে জানা তিনি।