ঢাকা ০৫:৩৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৯ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ঝিনাইদহে ‘হানি ট্র্যাপে’ সর্বস্বান্ত প্রবাসীসহ আরও যারা

 

ঝিনাইদহ শহরে এখন নতুন এক আতঙ্কের নাম ‘হানি ট্র্যাপ’। শহরের বেশ কয়েকটি এলাকায় বাসাবাড়ি ও আবাসিক হোটেলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এ চক্রের অদৃশ্য অস্তানা। বাইরে থেকে সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলেও ভেতরে চলছে ফাঁদ পেতে মানুষকে সর্বস্বান্ত করার খেলা। সক্রিয় এ চক্র একের পর এক মানুষকে কৌশলে ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা।

সম্প্রতি সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, বিদেশ ফেরত প্রবাসীসহ জেলার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এ চক্রের এ ফাঁদে পড়েছেন।

যেভাবে ফাঁদে ফেলে চক্রটি

ভুক্তভোগীরা জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা মোবাইল ফোনে শুরু হয় সম্পর্কের সূত্রপাত। প্রথমে পরিচিতি, পরে কৌশলে প্রেম বা বন্ধুত্বের জালে ফাঁসানো হয়। একসময় নির্জন স্থানে দেখা করার প্রলোভন দেওয়া হয়।

দেখা করতে গেলে নিয়ে যাওয়া হয় কোনো ভাড়া করা বাসাবাড়ি কিংবা শহরের আবাসিক হোটেলের কক্ষে। সেখানে প্রস্তুত থাকে চক্রের অন্য সদস্যরা। এরপর শুরু হয় ভিডিও ধারণ, হুমকি-ধমকি। পরে হাতিয়ে নেওয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা।

সূত্র জানায়, ঝিনাইদহ শহরের অন্তত পাঁচটি এলাকায় এ চক্র সক্রিয় রয়েছে। চক্রটির টার্গেট সাধারণত ব্যবসায়ী, সরকারি চাকরিজীবী কিংবা বিদেশফেরত প্রবাসীরা। অনেকে ব্ল্যাকমেইলের ভয়ে পরিবার বা সমাজে মানসম্মান হারানোর আশঙ্কায় মুখ খোলেন না। কিছু রাজনৈতিক নেতা, অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা ও কথিত সাংবাদিকদের যোগসাজশে চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে এমন কর্মকাণ্ড করে আসছে।

এ চক্রের শিকার সৌদি আরবফেরত এক প্রবাসী বলেন, ‘আমি দেশে ফেরার কয়েকমাস আগে এক নারীর সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয় হয় আমার।

তখন থেকে তার সঙ্গে মেসেঞ্জার-হোয়াটসঅ্যাপে নিয়মিত কথা বলা শুরু করি। দেশে ফেরার পর ওই নারী আমাকে শহরে আসতে বলে। আমি শহরে আসলে আমাকে আর্দশ পাড়ার একটি বাসায় নিয়ে যায়। ওই বাসায় যাওয়ার কিছু সময় পরে ৭ থেকে ৮ যুবক সেখানে হাজির হয়। আমাকে নানা ধরনের ভয়-ভীতি দেখায় তারা। পরে আমার কাছে মোটা অংকের টাকা দাবি করে। আমি মান-সম্মানের ভয়ে তিন দফায় তাদের ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়েছি। এখনো তারা আমার কাছে টাকা দাবি করছে।’

শহরের ব্যাপারীপাড়া এলাকার এক মুদি দোকানি বলেন, ‘কয়েকদিন আগে তার পরিচিত এক চাকরিজীবী এই হানি ট্র্যাপে পড়ে সবকিছু হারিয়েছেন। ফেসবুকে পরিচিত এক তরুণী তাকে ডেকে নিয়ে কৌশলে আবাসিক হোটেলে নিয়ে যান। এর কিছু সময়ের মধ্যে কয়েকজন যুবক ওই হোটেলে ঢুকে পড়েন। তারা ওই চাকরিজীবীর আপত্তিকর ছবি তুলে ৫ লাখ টাকা দাবি করেন। তাদের ভয়ে কয়েক দফায় টাকাগুলো দিয়েছেন তিনি। তবে এখন তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শহরের পায়রা চত্বর এলাকার এক হোটেল ম্যানেজার বলেন, ‘কয়েকজন মেয়ে প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন লোক নিয়ে আমাদের হোটেলে আসেন। আমরা সন্দেহ করি, কিন্তু প্রমাণ ছাড়া কিছু বলাও কঠিন। অনেক সময় পুলিশের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয় না।’

জেলা সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি বীর মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত হোসেন বলেন, ‘হানি ট্র্যাপ’ এখন শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, বরং বর্তমান সমাজের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্ধকারে ঢাকা এ অপরাধচক্রকে নির্মূল করতে না পারলে শহরের সামাজিক পরিবেশ আরো ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। তাই প্রশাসনকে এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

এ ব্যাপারে ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমরান জাকারিয়া গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এটি শুধু অপরাধ নয়, বরং সামাজিক নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। এ নিয়ে জেলা পুলিশের সাইবার ইউনিটসহ একাধিক টিম কাজ করছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘বাসাবাড়ি ও হোটেল মালিকদেরও দায়িত্ব আছে। সেই সঙ্গে এ চক্রের ফাঁদে যারা পড়ছেন, তাদের সচেতন হতে হবে। তাহলে এ ধরনের অপরাধ অনেকাংশে কমে আসবে।’

সবুজদেশ/এসএএস

Tag :

ঝিনাইদহে ‘হানি ট্র্যাপে’ সর্বস্বান্ত প্রবাসীসহ আরও যারা

Update Time : ১২:৫৭:৫৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

 

ঝিনাইদহ শহরে এখন নতুন এক আতঙ্কের নাম ‘হানি ট্র্যাপ’। শহরের বেশ কয়েকটি এলাকায় বাসাবাড়ি ও আবাসিক হোটেলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এ চক্রের অদৃশ্য অস্তানা। বাইরে থেকে সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলেও ভেতরে চলছে ফাঁদ পেতে মানুষকে সর্বস্বান্ত করার খেলা। সক্রিয় এ চক্র একের পর এক মানুষকে কৌশলে ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা।

সম্প্রতি সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, বিদেশ ফেরত প্রবাসীসহ জেলার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এ চক্রের এ ফাঁদে পড়েছেন।

যেভাবে ফাঁদে ফেলে চক্রটি

ভুক্তভোগীরা জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা মোবাইল ফোনে শুরু হয় সম্পর্কের সূত্রপাত। প্রথমে পরিচিতি, পরে কৌশলে প্রেম বা বন্ধুত্বের জালে ফাঁসানো হয়। একসময় নির্জন স্থানে দেখা করার প্রলোভন দেওয়া হয়।

দেখা করতে গেলে নিয়ে যাওয়া হয় কোনো ভাড়া করা বাসাবাড়ি কিংবা শহরের আবাসিক হোটেলের কক্ষে। সেখানে প্রস্তুত থাকে চক্রের অন্য সদস্যরা। এরপর শুরু হয় ভিডিও ধারণ, হুমকি-ধমকি। পরে হাতিয়ে নেওয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা।

সূত্র জানায়, ঝিনাইদহ শহরের অন্তত পাঁচটি এলাকায় এ চক্র সক্রিয় রয়েছে। চক্রটির টার্গেট সাধারণত ব্যবসায়ী, সরকারি চাকরিজীবী কিংবা বিদেশফেরত প্রবাসীরা। অনেকে ব্ল্যাকমেইলের ভয়ে পরিবার বা সমাজে মানসম্মান হারানোর আশঙ্কায় মুখ খোলেন না। কিছু রাজনৈতিক নেতা, অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা ও কথিত সাংবাদিকদের যোগসাজশে চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে এমন কর্মকাণ্ড করে আসছে।

এ চক্রের শিকার সৌদি আরবফেরত এক প্রবাসী বলেন, ‘আমি দেশে ফেরার কয়েকমাস আগে এক নারীর সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয় হয় আমার।

তখন থেকে তার সঙ্গে মেসেঞ্জার-হোয়াটসঅ্যাপে নিয়মিত কথা বলা শুরু করি। দেশে ফেরার পর ওই নারী আমাকে শহরে আসতে বলে। আমি শহরে আসলে আমাকে আর্দশ পাড়ার একটি বাসায় নিয়ে যায়। ওই বাসায় যাওয়ার কিছু সময় পরে ৭ থেকে ৮ যুবক সেখানে হাজির হয়। আমাকে নানা ধরনের ভয়-ভীতি দেখায় তারা। পরে আমার কাছে মোটা অংকের টাকা দাবি করে। আমি মান-সম্মানের ভয়ে তিন দফায় তাদের ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়েছি। এখনো তারা আমার কাছে টাকা দাবি করছে।’

শহরের ব্যাপারীপাড়া এলাকার এক মুদি দোকানি বলেন, ‘কয়েকদিন আগে তার পরিচিত এক চাকরিজীবী এই হানি ট্র্যাপে পড়ে সবকিছু হারিয়েছেন। ফেসবুকে পরিচিত এক তরুণী তাকে ডেকে নিয়ে কৌশলে আবাসিক হোটেলে নিয়ে যান। এর কিছু সময়ের মধ্যে কয়েকজন যুবক ওই হোটেলে ঢুকে পড়েন। তারা ওই চাকরিজীবীর আপত্তিকর ছবি তুলে ৫ লাখ টাকা দাবি করেন। তাদের ভয়ে কয়েক দফায় টাকাগুলো দিয়েছেন তিনি। তবে এখন তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শহরের পায়রা চত্বর এলাকার এক হোটেল ম্যানেজার বলেন, ‘কয়েকজন মেয়ে প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন লোক নিয়ে আমাদের হোটেলে আসেন। আমরা সন্দেহ করি, কিন্তু প্রমাণ ছাড়া কিছু বলাও কঠিন। অনেক সময় পুলিশের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয় না।’

জেলা সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি বীর মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত হোসেন বলেন, ‘হানি ট্র্যাপ’ এখন শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, বরং বর্তমান সমাজের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্ধকারে ঢাকা এ অপরাধচক্রকে নির্মূল করতে না পারলে শহরের সামাজিক পরিবেশ আরো ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। তাই প্রশাসনকে এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

এ ব্যাপারে ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমরান জাকারিয়া গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এটি শুধু অপরাধ নয়, বরং সামাজিক নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। এ নিয়ে জেলা পুলিশের সাইবার ইউনিটসহ একাধিক টিম কাজ করছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘বাসাবাড়ি ও হোটেল মালিকদেরও দায়িত্ব আছে। সেই সঙ্গে এ চক্রের ফাঁদে যারা পড়ছেন, তাদের সচেতন হতে হবে। তাহলে এ ধরনের অপরাধ অনেকাংশে কমে আসবে।’

সবুজদেশ/এসএএস