বিশেষ প্রতিনিধিঃ
সুরাইয়া আক্তারের দিন শুরু হয় ভোর চারটায়। ঘুম থেকে উঠেই পড়তে বসেন। এরপর বাড়িঘর ঝাড়ু দিয়ে অন্যান্য কাজ শেষ করে গরুর জন্য ঘাস আনতে মাঠে ছোটেন। দুপুরে ফিরে বাড়িতে ছাত্র পড়ান। বিকেলে বেচাকেনা করতে বসেন বাড়ি লাগোয়া দোকানে। রাত আটটা পর্যন্ত সেখানেই কেটে যায়। তারপর ১২টা পর্যন্ত চলে পড়াশোনা।
সুরাইয়া আক্তার (১৮) ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার তেলকুপ গ্রামের মৃত সিরাজুল ইসলামের বড় মেয়ে। এভাবে পড়ালেখা করে এখন পর্যন্ত জীবনের সব কটি পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফল করেছেন তিনি। কিন্তু মাঝপথে এসে অর্থকষ্টে আটকে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ফরম পূরণ। আবার ভর্তির সুযোগ পেলেও খরচ মিলবে কই থেকে সেই চিন্তাও ভর করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার খুব ইচ্ছা সুরাইয়ার, কিন্তু কীভাবে সেই আশা পূরণ হবে তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন তিনি। অর্থের অভাবে মাঝপথেই সবকিছু থেমে যাবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কায় মা ছবুরা বেগম।
সুরাইয়ার বাবা সিরাজুল ইসলাম ২০১৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তিনি পেশায় ছিলেন কৃষিশ্রমিক। সুমাইয়া আক্তার (১২) ও সানজিদা আক্তার (৪) নামের তাঁর আরও দুই বোন রয়েছে।
মা ছবুরা বেগম জানান, তাঁদের মাঠে কোনো জায়গাজমি নেই। সাড়ে চার শতক জমির ওপর তাঁদের বসতবাড়ি। স্বামী সিরাজুল ইসলাম অন্যের জমিতে কাজ করলেও তাঁদের সংসার সুন্দরভাবে চলছিল। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁদের সব আশা শেষ হয়ে যায়। সংসারে উপার্জন করার কোনো মানুষ থাকে না। কীভাবে চলবেন, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না।
বড় মেয়ে সুরাইয়া আক্তার তখন কলেজে পড়ছিল। চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছা নিয়ে বিজ্ঞান শাখায় পড়ালেখা করে। বাবার মৃত্যু তার পড়ালেখায়ও সমস্যা দেখা দেয়। বিজ্ঞান শাখায় পড়ে নিয়মিত প্রাইভেট পড়তে পারবেন না ভেবে মানবিক বিভাগে চলে আসে। এভাবে সে অদ্যাবধি পড়ালেখা করে যাচ্ছে।
সুরাইয়া আক্তার জানান, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছেন তিনি। ২০১৮ সালে নলডাঙ্গা ইব্রাহিম মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান শাখা থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ-৪.৯৪ পেয়েছেন। এরপর কালীগঞ্জ শহরের সরকারি মাহতাব উদ্দিন ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হন। সেখানেও বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হলেও কিছুদিন পর বাবা মারা যান। তখন চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন ত্যাগ করে মানবিকে চলে আসেন। ২০২০ সালে তার এইচএসসি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরীক্ষা হয়নি, বোর্ড কর্তৃপক্ষ তাকে জিপিএ-৪.৯২ দিয়ে ফলাফল ঘোষণা করেছেন।
সুরাইয়া আক্তার বলেন, ‘বাবার মৃত্যুর পর মা সারাক্ষণ বলতেন, বিয়ে করে সংসার শুরু কর। আমার পক্ষে তোমার পড়ানো আর সম্ভব নয়।’ এ অবস্থায় পরিকল্পনা করে তিনি সংসার বাঁচিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার। তখনই মাথায় বুদ্ধি আসে বাড়িতে একটি দোকান তৈরি করার। বাবা মৃত্যুর সময় কিছু টাকা রেখে গিয়েছিলেন, আর এনজিও থেকে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে দোকান দেন। দিনে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা কেনাবেচা হয়। এতে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় হয়। পাশাপাশি গরু লালন-পালন করেন। এই দিয়ে তাঁদের সংসারের পাশাপাশি পড়ালেখা চলে। তাঁর এই কাজে মা ছবুরা বেগম সহযোগিতা করেন।
সুরাইয়া বলেন, সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ফরম পূরণ করতে পারেননি। ভর্তির জন্য কোচিং করতে তাঁর সাত হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরম পূরণ করেছেন। এখন অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির ফরম পূরণ করতে হবে, কিন্তু টাকার জন্য পারছেন না। তা ছাড়া ভর্তি হলেও পড়ালেখার খরচ কোথায় পাবেন, তা নিয়েও সারাক্ষণ চিন্তা হয়। তবে তাঁর এখনো আশা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তজার্তিক সম্পর্ক বিভাগে পড়ালেখা করে সরকারি বড় চাকরি করবেন, যা অর্থের অভাবে ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সুরাইয়া আক্তারের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি মাহতাব উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) মো. আশরাফ উদ্দিন বলেন, মেয়েটির বাবা সিরাজুল ইসলাম কঠিন পরিশ্রমী ও সৎ মানুষ ছিলেন। তিনি পরিশ্রম করে বাচ্চাদের লেখাপড়া করানোর পাশাপাশি সংসারটি গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেন। ঠিক সেই সময় তিনি মারা যান। এখন অর্থের অভাবে মেয়ে সুরাইয়া আক্তারের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাবে, এটা ভাবতে কষ্ট হয়। কলেজে থাকা অবস্থায় তাঁরা যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করেছেন। এখন সবার সহযোগিতা প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন।