ঢাকার উৎকৃষ্ট অবদান
চার নদীবেষ্টিত যে নগরীর ভেনিস হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল, সে নগরীটি এখন বিশ্বদরবারে বাসযোগ্যতায় দ্বিতীয় নিকৃষ্ট নগরী হিসেবে উপস্থাপিত। সর্বজনীন কিছু মাপকাঠিতে বিশ্বের ১৪০টি শহরকে ১০০-এর মধ্যে যে নম্বর দেওয়া হয়েছে, ঢাকা পেয়েছে তাতে ৩৮ পয়েন্ট। আর বাসযোগ্যতার মাপকাঠিতে সবার ওপরে যে শহরের অবস্থান, সেই ভিয়েনার প্রাপ্ত নম্বর ৯৯.১। প্রাপ্ত নম্বরে বিস্তর ব্যবধান। তবে কেবল এই সংখ্যাগুলোর দিকে না তাকিয়ে আর কিছু সংখ্যার দিকে তাকালেই বিষয়টি অন্য রকম হতে পারে। ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের তথ্যমতে, ভিয়েনায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪ হাজার মানুষ। আর ঢাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪৫ হাজার মানুষ। পার্থক্যটা এখানেই।
জনসংখ্যার ভার তো আছেই, আরও আছে কেন্দ্রীভূতকরণ। জীবিকার সুযোগ এই দেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি এই শহরেই। ঢাকা শহরের একজন গৃহকর্মী মাসে ৭ থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন। ঢাকার বাইরে হয়তো একজন শিক্ষিত বেসরকারি কর্মী বা ছোট ব্যবসায়ীর আয়ের চেয়ে অনেক কম। এ কারণেই সব ধরনের পেশাজীবীদের ভিড় বাড়ে এই শহরে। জীবন-জীবিকার আশায় ঢাকায় ছুটে আসে সারা দেশের অসংখ্য মানুষ। তা ছাড়া উচ্চতর শিক্ষা, আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য আরও হাজার কারণে ঢাকায় বসবাসের জন্য আসে সব জেলার মানুষ।
বসবাসরত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে প্রতিদিন যুক্ত হন আরও অসংখ্য অস্থায়ী অভিবাসী। সারা দেশে কার্যত এটিই প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। প্রতিদিন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যাওয়া বা বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা জনগোষ্ঠীর যে চাপ ঢাকা নেয়, তার হিসাব কি আছে বিশ্ববাসীর কাছে? স্বাস্থ্যসেবায় দ্য ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের মাপকাঠিতে ঢাকা পেয়েছে ২৯-এর একটু বেশি নম্বর। কিন্তু উন্নয়নশীল আমাদের এই দেশের অভ্যন্তরে সবচেয়ে ভালো চিকিৎসাটা কিন্তু মেলে এই ঢাকাতেই। উন্নত চিকিৎসার জন্যও এ দেশে ঢাকার কোনো বিকল্প আছে কি?
নানা ধরনের দাপ্তরিক কাজের জন্যও এই শহরে বাড়ে মানুষের চাপ। সব প্রধান কার্যালয়গুলো গড়ে উঠেছে এই নগরেই। হ্যাঁ, ক্ষমতাকাঠামোর বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি। আর সে কারণেই এই নগরীতে প্রতিদিনই যুক্ত হচ্ছে প্রায় ১ হাজার ৮০০ নতুন বাসিন্দা। ঢাকার হাজারও সমস্যা। নানা নতুন অসুবিধায় বিপর্যস্ত নাগরিকেরা। তবুও এ শহর নির্মাণ করে চলে অনেক জীবনের স্বপ্ন, বেঁচে থাকা, এগিয়ে চলা। এ শহরের কোলে আশ্রয় নিয়ে নিজের এবং পরিবারের জীবনে পরিবর্তন নিয়ে আসে অসংখ্য মানুষ।
স্থপতি ইকবাল হাবিব এক সাক্ষাৎকারে ঢাকাকে তুলনা করেছিলেন মায়ের সঙ্গে। সেই মা তিনি নিজে সব সহ্য করে সন্তানদের অন্নের অভাব হতে দেন না। তিনি বলেছিলেন, অবকাঠামোগত বা বিনিয়োগ দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিবছর ঢাকাকে নিকৃষ্ট শহরের উপাধি দেওয়া হয়। তবে আমি গর্বের সঙ্গে বলতে চাই, জনসংখ্যার এত ঘনত্ব নিয়েও সচল শহর হিসেবে টিকে আছে ঢাকা। স্বল্প আয়তনের রাজধানী সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্র। সারা দেশের সব নাগরিক কোনো না কোনোভাবে ঢাকানির্ভর। কেউবা স্বপ্নের খোঁজে, কেউ বা জীবিকার প্রয়োজনে, কেউবা উন্নত জীবনের খোঁজে এই শহরে ঠাঁই নেয়। অকৃপণ ঢাকার তাতে কোনো বিরাম নেই। কিন্তু ঢাকা আজ ক্লান্ত, জীবনীশক্তি হারাতে বসা এক নগর। একে বাঁচাতে ও টেকানোর সময় যে ফুরিয়ে যায়।