ঢাকা ০৪:৫২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০৮ জানুয়ারী ২০২৫, ২৪ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চায় দিল্লি

সবুজদেশ ডেস্ক:

বাংলাদেশ ও ভারতের পতাকা। ছবি সংগৃহীত-

 

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্টে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। সেই থেকে পাঁচ মাসেরও বেশি সময় কেটে গেছে। এই সময়ের মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কে নাটকীয় অবনতি হয়েছে, যা এখনও পুরোপুরি ‘স্বাভাবিক’ হয়নি। পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন— নতুন বছরে ঢাকা-দিল্লির সম্পর্কে উন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে। এর প্রধান কারণ, উভয় দেশের জন্যই এই সম্পর্ক বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।

ভারত-বাংলাদেশ— দুই দেশই কূটনৈতিক, স্ট্র্যাটেজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন— দু’পক্ষের এই দৃষ্টি পরিবর্তন অনেকটা প্রাকৃতিকভাবেই ঘটছে। তবে ভারতের দিক থেকে সম্পর্ক উন্নতির প্রচেষ্টা ‘শর্তাধীন’ হতে পারে। অর্থাৎ, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, এবং আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়াই হতে পারে দেশটির শর্ত।

সম্প্রতি ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালের এক বক্তব্যে বিষয়টি প্রকাশ করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, তারা একটি ‘গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ, প্রগতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ’ চায়। এতে ‘গণতান্ত্রিক’ শব্দটির মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি নির্বাচিত সরকার চাইছে ভারত। আর ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ শব্দের মাধ্যমে, সমাজে সংখ্যালঘুদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হচ্ছে।

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত ভিনা সিক্রি মনে করেন, বাংলাদেশ ভারতের জন্য একটি ‘প্রায়োরিটি কান্ট্রি’। তবে, বাংলাদেশে পাকিস্তান যেভাবে সম্পর্ক গড়তে চাইছে, সেটি ভারতের জন্য একটি নিরাপত্তা হুমকি। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন এবং সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি ভারতীয় মিডিয়ার অতিরঞ্জন বাদ দিয়ে, বাংলাদেশ সরকার এই ইস্যুগুলোকে বাস্তবভাবে নেয়, তবে সম্পর্কের উন্নতির পথ তৈরি হবে।

অন্যদিকে, ভারতের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলেন, খুব শীঘ্রই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের নাটকীয় উন্নতি হবে। তবে তিনি এই বিষয়টি মানছেন, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ইতিবাচক চিন্তা শোনা গেছে, যেমন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রধান বা পররাষ্ট্র উপদেষ্টাদের বক্তব্য, যা সম্পর্কের উন্নতির প্রতি ইঙ্গিত দেয়। তবে, তার আশঙ্কা— নির্বাচনের আগে যদি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ইস্যু সমাধান না করতে পারে, তাহলে ভারত সম্ভবত আবার অসহযোগিতার পথে যেতে পারে।

এছাড়া, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কোনো মামলা থাকলে, সে বিষয়টি সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভারত ও বাংলাদেশ বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে, এবং সেটি উভয় দেশের স্বার্থে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ২০ কোটি মানুষের বাজার ভারত কখনওই ছাড়তে চাইবে না, আবার বাংলাদেশও ভারী পণ্য আমদানির জন্য ভারতকে উপযুক্ত উৎস হিসেবে দেখে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক দুই দেশের মধ্যে একটি ‘অটো পাইলট’ মোডে চলছে, যেখানে সরকারের তেমন হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই।

ভারতের অর্থনীতিবিদ প্রবীর দে বলেন, বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। উভয় দেশই একে অপরের উপর নির্ভরশীল। তিনি মনে করেন, যদিও আগের মতো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গভীরতা নেই, কিন্তু ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচক লক্ষণ রয়েছে।

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মধ্যে সীমান্ত এবং স্থলবন্দর চালু থাকার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশের মধ্যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি এবং বাণিজ্যিক কনসাইনমেন্ট বাতিল হয়নি, যা সম্পর্কের উন্নতির সম্ভাবনা তৈরি করে। যদিও বাংলাদেশে ভারতের রফতানিমুখী শিল্পগুলো কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবুও ভারতের এক্সপোর্ট প্রোমোশন কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, তাদের গার্মেন্ট রফতানি বেড়েছে, যা ভারতের লাভজনক।

এছাড়া, ভারত যে বাংলাদেশে কিছু অবকাঠামো প্রকল্পে কাজ করছে, সেগুলো এখনও চলমান রয়েছে, এবং এগুলো যেকোনো সময় আবার শুরু হতে পারে। আশুগঞ্জ-আখাউড়া হাইওয়ে নির্মাণ এবং চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের সাথে বাংলাদেশের সমঝোতা এখনো বাতিল হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অর্থনৈতিক স্বার্থের দিক থেকে বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে, এবং উভয় দেশের এই সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য বিশেষভাবে তাগিদ থাকবে। তবে, সম্পর্কের উন্নতি নির্ভর করবে বাংলাদেশে নির্বাচন, সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা এবং পাকিস্তান থেকে কোন ধরনের হুমকি এড়িয়ে চলা নিশ্চিত করতে পারলে।

সূত্র: বিবিসি

 

About Author Information
আপডেট সময় : ১০:৫১:৪৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৮ জানুয়ারী ২০২৫
১ Time View

ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চায় দিল্লি

আপডেট সময় : ১০:৫১:৪৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৮ জানুয়ারী ২০২৫

 

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্টে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। সেই থেকে পাঁচ মাসেরও বেশি সময় কেটে গেছে। এই সময়ের মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কে নাটকীয় অবনতি হয়েছে, যা এখনও পুরোপুরি ‘স্বাভাবিক’ হয়নি। পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন— নতুন বছরে ঢাকা-দিল্লির সম্পর্কে উন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে। এর প্রধান কারণ, উভয় দেশের জন্যই এই সম্পর্ক বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।

ভারত-বাংলাদেশ— দুই দেশই কূটনৈতিক, স্ট্র্যাটেজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন— দু’পক্ষের এই দৃষ্টি পরিবর্তন অনেকটা প্রাকৃতিকভাবেই ঘটছে। তবে ভারতের দিক থেকে সম্পর্ক উন্নতির প্রচেষ্টা ‘শর্তাধীন’ হতে পারে। অর্থাৎ, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, এবং আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়াই হতে পারে দেশটির শর্ত।

সম্প্রতি ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালের এক বক্তব্যে বিষয়টি প্রকাশ করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, তারা একটি ‘গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ, প্রগতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ’ চায়। এতে ‘গণতান্ত্রিক’ শব্দটির মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি নির্বাচিত সরকার চাইছে ভারত। আর ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ শব্দের মাধ্যমে, সমাজে সংখ্যালঘুদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হচ্ছে।

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত ভিনা সিক্রি মনে করেন, বাংলাদেশ ভারতের জন্য একটি ‘প্রায়োরিটি কান্ট্রি’। তবে, বাংলাদেশে পাকিস্তান যেভাবে সম্পর্ক গড়তে চাইছে, সেটি ভারতের জন্য একটি নিরাপত্তা হুমকি। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন এবং সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি ভারতীয় মিডিয়ার অতিরঞ্জন বাদ দিয়ে, বাংলাদেশ সরকার এই ইস্যুগুলোকে বাস্তবভাবে নেয়, তবে সম্পর্কের উন্নতির পথ তৈরি হবে।

অন্যদিকে, ভারতের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলেন, খুব শীঘ্রই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের নাটকীয় উন্নতি হবে। তবে তিনি এই বিষয়টি মানছেন, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ইতিবাচক চিন্তা শোনা গেছে, যেমন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রধান বা পররাষ্ট্র উপদেষ্টাদের বক্তব্য, যা সম্পর্কের উন্নতির প্রতি ইঙ্গিত দেয়। তবে, তার আশঙ্কা— নির্বাচনের আগে যদি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ইস্যু সমাধান না করতে পারে, তাহলে ভারত সম্ভবত আবার অসহযোগিতার পথে যেতে পারে।

এছাড়া, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কোনো মামলা থাকলে, সে বিষয়টি সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভারত ও বাংলাদেশ বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে, এবং সেটি উভয় দেশের স্বার্থে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ২০ কোটি মানুষের বাজার ভারত কখনওই ছাড়তে চাইবে না, আবার বাংলাদেশও ভারী পণ্য আমদানির জন্য ভারতকে উপযুক্ত উৎস হিসেবে দেখে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক দুই দেশের মধ্যে একটি ‘অটো পাইলট’ মোডে চলছে, যেখানে সরকারের তেমন হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই।

ভারতের অর্থনীতিবিদ প্রবীর দে বলেন, বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। উভয় দেশই একে অপরের উপর নির্ভরশীল। তিনি মনে করেন, যদিও আগের মতো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গভীরতা নেই, কিন্তু ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচক লক্ষণ রয়েছে।

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মধ্যে সীমান্ত এবং স্থলবন্দর চালু থাকার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশের মধ্যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি এবং বাণিজ্যিক কনসাইনমেন্ট বাতিল হয়নি, যা সম্পর্কের উন্নতির সম্ভাবনা তৈরি করে। যদিও বাংলাদেশে ভারতের রফতানিমুখী শিল্পগুলো কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবুও ভারতের এক্সপোর্ট প্রোমোশন কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, তাদের গার্মেন্ট রফতানি বেড়েছে, যা ভারতের লাভজনক।

এছাড়া, ভারত যে বাংলাদেশে কিছু অবকাঠামো প্রকল্পে কাজ করছে, সেগুলো এখনও চলমান রয়েছে, এবং এগুলো যেকোনো সময় আবার শুরু হতে পারে। আশুগঞ্জ-আখাউড়া হাইওয়ে নির্মাণ এবং চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের সাথে বাংলাদেশের সমঝোতা এখনো বাতিল হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অর্থনৈতিক স্বার্থের দিক থেকে বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে, এবং উভয় দেশের এই সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য বিশেষভাবে তাগিদ থাকবে। তবে, সম্পর্কের উন্নতি নির্ভর করবে বাংলাদেশে নির্বাচন, সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা এবং পাকিস্তান থেকে কোন ধরনের হুমকি এড়িয়ে চলা নিশ্চিত করতে পারলে।

সূত্র: বিবিসি