ঢাকা ০৩:৩০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দেশে ধর্ষণ-শিশু নির্যাতন বেড়েছে: আইন ও শালিস কেন্দ্র

Reporter Name

ঢাকা:

এ বছরের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) দেশে ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতন বেড়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা পর্যালোচনায়, এ নয় মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনে, ক্রসফায়ারে, গুলিবিনিময় বা কথিত বন্দুকযুদ্ধে অনেক নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন। এসময় গুলিতে এক সাংবাদিক নিহত হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হামলা-মামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৫৪ সাংবাদিক।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য বিশ্লেষণ ও নিজেদের সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। এতে বেশ কিছু ঘটনার চিত্রও বর্ণনা করা হয়েছে।

এরমধ্যে গত ৩ আগস্ট রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানায় পুলিশের রিমান্ডে থাকা অবস্থায় মো. লিটন (৪০) নামের এক ট্রাকচালকের মৃত্যু হয়। পুলিশ লিটনের মৃত্যুর ঘটনাকে ‘আত্মহত্যা’ বলে দাবি করলেও পরিবারের সদস্যসহ ট্রাক শ্রমিকদের পক্ষ থেকে থানা হেফাজতে নির্যাতনের কারণে লিটনের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়।

আসকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ ও গুমের ঘটনার পাশাপাশি ‘নিখোঁজ’র ঘটনাও ঘটছে। মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি ছাত্র রিজওয়ান হাসান রাকিন তার স্ত্রীর বড় ভাই মাহফুজুর রহমানের সঙ্গে গত ৪ আগস্ট সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে এমিরেটসের একটি ফ্লাইটে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামেন।

রিজওয়ানের নানা সেলিম সারোয়ার আসক প্রতিনিধিদের জানান, প্লেন থেকে নামার পর মাহফুজ ফোনে তাকে পৌঁছানোর খবর জানান। এরপর তিনি বিমানবন্দর এলাকায় তাদের কোনো খোঁজ না পেয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন। ওই দিন (৪ আগস্ট) রাত সাড়ে ১১টার দিকে চোখ বাঁধা অবস্থায় মাহফুজকে যাত্রাবাড়ী এলাকায় নামিয়ে দেয় অজ্ঞাতপরিচয় অপহরণকারীরা।

বাসায় ফিরে মাহফুজ পরিবারের লোকদের জানান, বিমানবন্দরের ভেতরে অভিবাসন ডেস্ক পার হওয়ার পর তাদের দুজনকেই (সঙ্গে থাকা রিজওয়ানসহ) চোখ বেঁধে গাড়িতে তোলা হয়। এরপর অপরিচিত জায়গায় নিয়ে তাদের পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রিজওয়ানের রাজনৈতিক পরিচয় এবং কোনো অপরাধকর্মে জড়িত কি না, তা জানতে চাওয়া হয়। পরিবারের সদস্যরা রিজওয়ানের এখনো কোনো সন্ধান পাননি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনাগুলো ক্রমবর্ধমান হারে ঘটে চলেছে। এছাড়া মতপ্রকাশের অধিকার হরণ ও ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে গণমাধ্যমকর্মীসহ ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলার অনেক ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা-নির্যাতনের ঘটনা ছিল উল্লেখযোগ্য। বিশেষত, দুর্গাপূজা সামনে রেখে প্রতিবারের মতো এবারও হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে।

আসকের প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মুহিবুল্লাহ হত্যার ঘটনাও তুলে ধরা হয়েছে। এ বিষয়ে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে সংগ্রামরত আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাকে ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের উখিয়ায় লাম্বাশিয়া রোহিঙ্গা শিবিরে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। মুহিবুল্লাহ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিলেন।

ধর্ষণ ও হত্যা
চলতি বছরের নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৮৫ জন নারী, এরমধ্যে একক ধর্ষণের শিকার হন ৮৭৯ জন এবং দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ২০৩ নারী। ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হন ৩৯ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন আট নারী। এছাড়া ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ঘটেছে ২৫৬টি। গত বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ৯৭৫ নারী।

যৌন হয়রানি ও সহিংসতা
চলতি বছর যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১০১ জন নারী। এরমধ্যে ১০ নারী আত্মহত্যা করেছেন এবং হত্যার শিকার হয়েছেন তিন নারী। এছাড়া যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন ৭১ জন পুরুষ, খুনের শিকার ৪ জন।

পারিবারিক নির্যাতন ও হত্যা
চলতি বছর পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৫২৭ নারী। এরমধ্যে স্বামী, স্বামীর পরিবার এবং নিজ পরিবারের মাধ্যমে হত্যার শিকার হন ৩০৩ নারী এবং পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১১৮ নারী। গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ৪৩২ নারী।

যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতন-হত্যা
এ বছর নয় মাসে যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছেন ১৮২ নারী। যৌতুকের জন্য নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে ৬০ জনকে এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন নারী। এর মধ্যে যৌতুকের কারণে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৯৮ জন।

গৃহকর্মী নির্যাতন ও হত্যা
বাসাবাড়িতে কাজ করতে গিয়ে এ বছর ৩৮ জন গৃহকর্মী নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে হত্যার শিকার হয়েছেন ১২ জন এবং ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৬ গৃহকর্মী।

সালিশ ও ফতোয়া
চলতি বছর সালিশ ও ফতোয়ার ঘটনা ঘটেছে ১২টি। এছাড়া এসিড সন্ত্রাসের শিকার হন ১৯ নারী।

শিশু নির্যাতন-হত্যা
শিশুর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন সংক্রান্ত পরিসংখ্যানও উদ্বেগজনক। এ বছরের নয় মাসে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৬৩৬ শিশু। এর মধ্যে হত্যার শিকার হন ৪৭১ জন এবং শারীরিক ও যৌন নির্যাতনসহ নানাভাবে সহিংসতার শিকার হয় এক হাজার ১৬৫ জন শিশু। এই এক হাজার ১৬৫ জনের মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয় ৬৪৮ শিশু এবং বলাৎকারের শিকার হয় ৬৪ জন শিশু। গত বছরের এ সময়ে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিল এক হাজার ৫২৩ শিশু।

বিচারবহির্ভূত হত্যা-হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগ
সংবাদমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে আসক জানিয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে এবং ‘ক্রসফায়ারে’ ৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘ক্রসফায়ার’/‘বন্দুকযুদ্ধ’/‘গুলিবিনিময়’/‘অ্যানকাউন্টারে’ নিহত হন ৩৪ জন, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে নয় জন ও নির্যাতনে চার জন মারা যান। এছাড়া গ্রেফতারের পরে হার্ট অ্যাটাকে (পুলিশের ভাষ্যমতে) একজনের মৃত্যু হয়।

কারা হেফাজতে মৃত্যু
বছরের নয় মাসে কারাগারে অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে মারা গেছেন ৬৭ জন। এরমধ্যে কয়েদি ২৫ জন এবং হাজতি ৪২ জন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে অপহরণ
সংবাদমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে আসক জানিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে এ বছরের নয় মাসে অপহরণ বা গুমের শিকার হয়েছেন মোট ছয় জন। এর মধ্যে পরবর্তীতে তিন জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এবং নিখোঁজ রয়েছেন আরও তিন জন।

সাংবাদিক নির্যাতন-হয়রানি
পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে এ বছরের প্রথম নয় মাসে একজন সাংবাদিক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন এবং বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হামলা-মামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৫৪ সাংবাদিক। নির্যাতিত সাংবাদিকদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আট জন, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মীদের মাধ্যমে ১৪ জন, স্থানীয় পরিষদ নির্বাচন ঘিরে ১৩ জন, হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতাল চলাকালে ১৩ জন সাংবাদিক আহত হন। এ সময়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, স্থানীয় প্রভাবশালী মহল ও সন্ত্রাসীদের হাতে ১০৬ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হন।

ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন
এ বছর নয় মাসে হিন্দু সম্প্রদায়ের ১০২টি বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিমা, মন্দির ও পারিবারিক পূজামণ্ডপে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে ৭৮টি। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন সাত জন। জমি ও বাড়িঘর দখল এবং উচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে সাতটি। এছাড়া বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পরিবার ও বাড়িঘরে হামলার ঘটনা ঘটেছে একটি। গত বছরের এ সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের সাতটি বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ এবং ৪৮টি প্রতিমা, মন্দির ও পারিবারিক পূজামণ্ডপে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

সীমান্ত সংঘাত
বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে ভারত সীমান্তে ১১ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে নয় জন, শারীরিক নির্যাতনে এক জন এবং বিএসএফের ধাওয়ায় পানিতে ডুবে এক জন নিহত হন। এছাড়া আহত ছয় জন ও অপহরণের শিকার হয়েছেন তিন জন।

রাজনৈতিক সংঘাত
এ বছরের নয় মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে মোট ৩২১টি। এতে নিহত ৬৪ জন এবং আহত হয়েছেন চার হাজার ৪০৫ জন। এর মধ্যে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে সহিংসতা ও সংঘর্ষের ১৬৭টি ঘটনায় আহত এক হাজার ৯৪২ জন এবং নিহত হন ৩০ জন।

গণপিটুনি
গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে সারাদেশে গণপিটুনির ঘটনায় ২৬ জন নিহত হয়েছেন। গত বছর একই সময়ে গণপিটুনিতে মারা যান ৩০ জন।

About Author Information
আপডেট সময় : ০৭:২০:০৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২ অক্টোবর ২০২১
১৪৯ Time View

দেশে ধর্ষণ-শিশু নির্যাতন বেড়েছে: আইন ও শালিস কেন্দ্র

আপডেট সময় : ০৭:২০:০৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২ অক্টোবর ২০২১

ঢাকা:

এ বছরের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) দেশে ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতন বেড়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা পর্যালোচনায়, এ নয় মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনে, ক্রসফায়ারে, গুলিবিনিময় বা কথিত বন্দুকযুদ্ধে অনেক নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন। এসময় গুলিতে এক সাংবাদিক নিহত হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হামলা-মামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৫৪ সাংবাদিক।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য বিশ্লেষণ ও নিজেদের সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। এতে বেশ কিছু ঘটনার চিত্রও বর্ণনা করা হয়েছে।

এরমধ্যে গত ৩ আগস্ট রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানায় পুলিশের রিমান্ডে থাকা অবস্থায় মো. লিটন (৪০) নামের এক ট্রাকচালকের মৃত্যু হয়। পুলিশ লিটনের মৃত্যুর ঘটনাকে ‘আত্মহত্যা’ বলে দাবি করলেও পরিবারের সদস্যসহ ট্রাক শ্রমিকদের পক্ষ থেকে থানা হেফাজতে নির্যাতনের কারণে লিটনের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়।

আসকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ ও গুমের ঘটনার পাশাপাশি ‘নিখোঁজ’র ঘটনাও ঘটছে। মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি ছাত্র রিজওয়ান হাসান রাকিন তার স্ত্রীর বড় ভাই মাহফুজুর রহমানের সঙ্গে গত ৪ আগস্ট সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে এমিরেটসের একটি ফ্লাইটে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামেন।

রিজওয়ানের নানা সেলিম সারোয়ার আসক প্রতিনিধিদের জানান, প্লেন থেকে নামার পর মাহফুজ ফোনে তাকে পৌঁছানোর খবর জানান। এরপর তিনি বিমানবন্দর এলাকায় তাদের কোনো খোঁজ না পেয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন। ওই দিন (৪ আগস্ট) রাত সাড়ে ১১টার দিকে চোখ বাঁধা অবস্থায় মাহফুজকে যাত্রাবাড়ী এলাকায় নামিয়ে দেয় অজ্ঞাতপরিচয় অপহরণকারীরা।

বাসায় ফিরে মাহফুজ পরিবারের লোকদের জানান, বিমানবন্দরের ভেতরে অভিবাসন ডেস্ক পার হওয়ার পর তাদের দুজনকেই (সঙ্গে থাকা রিজওয়ানসহ) চোখ বেঁধে গাড়িতে তোলা হয়। এরপর অপরিচিত জায়গায় নিয়ে তাদের পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রিজওয়ানের রাজনৈতিক পরিচয় এবং কোনো অপরাধকর্মে জড়িত কি না, তা জানতে চাওয়া হয়। পরিবারের সদস্যরা রিজওয়ানের এখনো কোনো সন্ধান পাননি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনাগুলো ক্রমবর্ধমান হারে ঘটে চলেছে। এছাড়া মতপ্রকাশের অধিকার হরণ ও ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে গণমাধ্যমকর্মীসহ ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলার অনেক ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা-নির্যাতনের ঘটনা ছিল উল্লেখযোগ্য। বিশেষত, দুর্গাপূজা সামনে রেখে প্রতিবারের মতো এবারও হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে।

আসকের প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মুহিবুল্লাহ হত্যার ঘটনাও তুলে ধরা হয়েছে। এ বিষয়ে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে সংগ্রামরত আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাকে ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের উখিয়ায় লাম্বাশিয়া রোহিঙ্গা শিবিরে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। মুহিবুল্লাহ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিলেন।

ধর্ষণ ও হত্যা
চলতি বছরের নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৮৫ জন নারী, এরমধ্যে একক ধর্ষণের শিকার হন ৮৭৯ জন এবং দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ২০৩ নারী। ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হন ৩৯ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন আট নারী। এছাড়া ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ঘটেছে ২৫৬টি। গত বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ৯৭৫ নারী।

যৌন হয়রানি ও সহিংসতা
চলতি বছর যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১০১ জন নারী। এরমধ্যে ১০ নারী আত্মহত্যা করেছেন এবং হত্যার শিকার হয়েছেন তিন নারী। এছাড়া যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন ৭১ জন পুরুষ, খুনের শিকার ৪ জন।

পারিবারিক নির্যাতন ও হত্যা
চলতি বছর পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৫২৭ নারী। এরমধ্যে স্বামী, স্বামীর পরিবার এবং নিজ পরিবারের মাধ্যমে হত্যার শিকার হন ৩০৩ নারী এবং পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১১৮ নারী। গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ৪৩২ নারী।

যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতন-হত্যা
এ বছর নয় মাসে যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছেন ১৮২ নারী। যৌতুকের জন্য নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে ৬০ জনকে এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন নারী। এর মধ্যে যৌতুকের কারণে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৯৮ জন।

গৃহকর্মী নির্যাতন ও হত্যা
বাসাবাড়িতে কাজ করতে গিয়ে এ বছর ৩৮ জন গৃহকর্মী নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে হত্যার শিকার হয়েছেন ১২ জন এবং ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৬ গৃহকর্মী।

সালিশ ও ফতোয়া
চলতি বছর সালিশ ও ফতোয়ার ঘটনা ঘটেছে ১২টি। এছাড়া এসিড সন্ত্রাসের শিকার হন ১৯ নারী।

শিশু নির্যাতন-হত্যা
শিশুর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন সংক্রান্ত পরিসংখ্যানও উদ্বেগজনক। এ বছরের নয় মাসে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৬৩৬ শিশু। এর মধ্যে হত্যার শিকার হন ৪৭১ জন এবং শারীরিক ও যৌন নির্যাতনসহ নানাভাবে সহিংসতার শিকার হয় এক হাজার ১৬৫ জন শিশু। এই এক হাজার ১৬৫ জনের মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয় ৬৪৮ শিশু এবং বলাৎকারের শিকার হয় ৬৪ জন শিশু। গত বছরের এ সময়ে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিল এক হাজার ৫২৩ শিশু।

বিচারবহির্ভূত হত্যা-হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগ
সংবাদমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে আসক জানিয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে এবং ‘ক্রসফায়ারে’ ৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘ক্রসফায়ার’/‘বন্দুকযুদ্ধ’/‘গুলিবিনিময়’/‘অ্যানকাউন্টারে’ নিহত হন ৩৪ জন, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে নয় জন ও নির্যাতনে চার জন মারা যান। এছাড়া গ্রেফতারের পরে হার্ট অ্যাটাকে (পুলিশের ভাষ্যমতে) একজনের মৃত্যু হয়।

কারা হেফাজতে মৃত্যু
বছরের নয় মাসে কারাগারে অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে মারা গেছেন ৬৭ জন। এরমধ্যে কয়েদি ২৫ জন এবং হাজতি ৪২ জন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে অপহরণ
সংবাদমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে আসক জানিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে এ বছরের নয় মাসে অপহরণ বা গুমের শিকার হয়েছেন মোট ছয় জন। এর মধ্যে পরবর্তীতে তিন জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এবং নিখোঁজ রয়েছেন আরও তিন জন।

সাংবাদিক নির্যাতন-হয়রানি
পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে এ বছরের প্রথম নয় মাসে একজন সাংবাদিক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন এবং বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হামলা-মামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৫৪ সাংবাদিক। নির্যাতিত সাংবাদিকদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আট জন, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মীদের মাধ্যমে ১৪ জন, স্থানীয় পরিষদ নির্বাচন ঘিরে ১৩ জন, হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতাল চলাকালে ১৩ জন সাংবাদিক আহত হন। এ সময়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, স্থানীয় প্রভাবশালী মহল ও সন্ত্রাসীদের হাতে ১০৬ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হন।

ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন
এ বছর নয় মাসে হিন্দু সম্প্রদায়ের ১০২টি বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিমা, মন্দির ও পারিবারিক পূজামণ্ডপে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে ৭৮টি। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন সাত জন। জমি ও বাড়িঘর দখল এবং উচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে সাতটি। এছাড়া বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পরিবার ও বাড়িঘরে হামলার ঘটনা ঘটেছে একটি। গত বছরের এ সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের সাতটি বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ এবং ৪৮টি প্রতিমা, মন্দির ও পারিবারিক পূজামণ্ডপে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

সীমান্ত সংঘাত
বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে ভারত সীমান্তে ১১ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে নয় জন, শারীরিক নির্যাতনে এক জন এবং বিএসএফের ধাওয়ায় পানিতে ডুবে এক জন নিহত হন। এছাড়া আহত ছয় জন ও অপহরণের শিকার হয়েছেন তিন জন।

রাজনৈতিক সংঘাত
এ বছরের নয় মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে মোট ৩২১টি। এতে নিহত ৬৪ জন এবং আহত হয়েছেন চার হাজার ৪০৫ জন। এর মধ্যে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে সহিংসতা ও সংঘর্ষের ১৬৭টি ঘটনায় আহত এক হাজার ৯৪২ জন এবং নিহত হন ৩০ জন।

গণপিটুনি
গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে সারাদেশে গণপিটুনির ঘটনায় ২৬ জন নিহত হয়েছেন। গত বছর একই সময়ে গণপিটুনিতে মারা যান ৩০ জন।