সাইদুল করিম মিন্টুঃ

সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম একজন সংগ্রামী মানুষ ছিলেন। কখনোই অপশক্তির কাছে আপস করেননি বরং সকল লড়াই-সংগ্রাম সামনে থেকে মোকাবিলা করে গেছেন। কিন্তু তিনি জীবনযুদ্ধে আটদিন লড়াই করে শনিবার বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর শ্যামলীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

রক্তচাপজনিত সমস্যা নিয়ে গত ১ জুন হাসপাতালে ভর্তি হন মোহাম্মদ নাসিম। ওই দিনই তার করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এরপর ৪ জুন অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও ৫ জুন ভোরে তিনি স্ট্রোক করেন। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত সমস্যার কারণে দ্রুত অস্ত্রোপচার করে তাকে আইসিইউতে রাখা হয়। এরপর দুই দফায় ৭২ ঘণ্টায় করে পর্যবেক্ষণে রাখে মেডিকেল বোর্ড। এর মধ্যেই পরপর তিনবার নমুনা পরীক্ষা করে করোনাভাইরাস পাওয়া যায়নি তার শরীরে।

কয়েক দিন স্থিতিশীল থাকলেও গত বৃহস্পতিবার রক্তচাপ অস্বাভাবিক ওঠানামা করতে থাকে নাসিমের। এরপর গতকাল শুক্রবার পরিস্থিতি আরও জটিল হতে থাকে। হৃদযন্ত্রে জটিলতা দেখা দেয়।

কিন্তু আমরা আশা করেছিলেন, মোহাম্মদ নাসিম সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন। কিন্তু তিনি সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন। এই সংকটকালীন অবস্থায় মোহাম্মদ নাসিম ভাইয়ের চলা যাওয়া কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। সিরাজগঞ্জ-১ আসন (কাজীপুর ও সদর উপজেলার একাংশ) থেকে তিনি পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের হুইপ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময় স্বরাষ্ট্র, ডাক ও টেলিযোগাযোগ, গৃহায়ন ও গণপূর্ত এবং সর্বশেষ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম কমিটির সদস্য মোহাম্মদ নাসিম দলের মুখপাত্র হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছিলেন।

রাজনীতির সঙ্গে মোহাম্মদ নাসিম সম্পৃক্ত হন ষাটের দশকে। শুরুর দিকে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হলেও পরবর্তীতে ছাত্রলীগ করতে শুরু করেন। পাবনার অ্যাডওয়ার্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন।

মোহাম্মদ নাসিমের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২ এপ্রিল, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলায়। তার পিতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশে সরকারের মন্ত্রী, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী।

পঁচাত্তরে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারের হত্যাকাণ্ড ও জেলখানায় আরও তিন জাতীয় নেতার সঙ্গে তার পিতা এম মনসুর আলী হত্যাকাণ্ডের পরে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পুরোপুরি সম্পৃক্ত হয়ে ওঠেন। পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পর মোহাম্মদ নাসিমকেও গ্রেফতার করা হয়। সেইসময় দীর্ঘদিন তাকে কারাগারে থাকতে হয়েছে।

১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে মোহাম্মদ নাসিম যুব সম্পাদক হন। তখন থেকেই কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে আসেন মোহাম্মদ নাসিম। পরবর্তীতে ১৯৮৭ তিনি আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হন। তার আগের বছর, ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সিরাজগঞ্জ থেকে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মোহাম্মদ নাসিম।

আওয়ামী লীগের ‘৯২ ও ‘৯৭ সালের জাতীয় সম্মেলনে তাকে দলের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। ২০১২ সালে কাউন্সিলে তাকে প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত করা হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর স্বরাষ্ট্র, গৃহায়ন ও গণপূর্ত, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী করা হয়।

রাজনীতির বিভিন্ন পর্যায়ে মোহাম্মদ নাসিমকে অনেকবার কারাবন্দী হতে হয়েছে। প্রথম তাকে কারাগারে যেতে হয় ১৯৬৬ সালে, যখন তিনি এইচএসসি পড়ছিলেন। সেই সময় পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ভুট্টা খাওয়ানোর চেষ্টার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে পিতা এম মনসুর আলীর সঙ্গে কারাগারে যেতে হয় মোহাম্মদ নাসিমকেও। এক বছর পর তিনি ছাড়া পান।

১৯৭৫ সালে সপরিবারে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের পর গ্রেফতার করা হয়েছিল মোহাম্মদ নাসিমকে। ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিযানে আরও অনেক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে তাকেও গ্রেফতার করা হয়।

সেই সময় অবৈধভাবে এক কোটি ২৬ লাখ টাকার সম্পদ অর্জন ও ২০ লাখ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি মামলায় বিশেষ জজ আদালত ২০০৭ সালে মোহাম্মদ নাসিমকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেয়। তবে ২০১০ সালে উচ্চ আদালত ওই সাজা ও মামলা বাতিল করে দেন।

কিন্তু মামলায় সাজা হওয়ার কারণে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি মোহাম্মদ নাসিম। সেই আসনে তার ছেলে অংশ নিয়ে বিজয়ী হন। মামলা ও সাজা উচ্চ আদালতে বাতিল হয়ে যাওয়ার পর ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মোহাম্মদ নাসিম। এরপর তাকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী করা হয়, ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকেন।

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মন্ত্রী না হলেও তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও দলের মুখপাত্র হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৯৬ সালে মোহাম্মদ নাসিম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন। সেই সময়ে ঝিনাইদহ এলাকায় সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, খুনখারাপি হতো। কিন্তু মোহাম্মদ নাসিমের ডাকে সাড়া দিয়ে সেই সময় অনেকে আত্মসমর্পণ করেন। এই এলাকাকে মোহাম্মদ নাসিম সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ মুক্ত করেন। যে কারণে এই অঞ্চলের জনসাধারণ আজও তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। মোহাম্মদ নাসিমের বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আমাকে বিমোহিত করে।

মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুর আমরা একজন বর্ষীয়ান, আদর্শবান, সাহসী নেতাকে হারালাম। যা কখনোই এই দেশের রাজনীতিতে পূরণ হওয়ার নয়। তার মৃত্যুতে সব মহলে শোকের ছায়া পড়ে গেছে। আজ হৃদয়জুড়ে শোকের আবহ সৃষ্টি হয়েছে। কারণ বিভিন্ন সময় মোহাম্মদ নাসিম ভাইয়ের সান্নিধ্য পেয়েছি। ২০১৪ সালে ঝিনাইদহে পুরোহিত হত্যার পরের দিন মোহাম্মদ নাসিম ভাই ঝিনাইদহে আসেন। তখন তিনি অসুস্থ ছিলেন। একা মঞ্চে উঠতে পারছিলেন। তারপর আমার কাঁধে ভর করে মঞ্চে ওঠেন। সেই স্মৃতি কখনোই ভোলার নয়।

মোহাম্মদ নাসিম ভাই এদেশের বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণকারী প্রত্যেক ব্যক্তির মাঝে রাজনীতির কিংবদন্তি হিসেবে বেঁচে থাকবেন। মোহাম্মদ নাসিম ভাইয়ের অবদান এদেশের মানুষ চিরদিন স্মরণ করবে। মোহাম্মদ নাসিম ভাইয়ের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। ভালো থাকবেন নাসিম ভাই।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগ।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here