নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ নেই জাতিসংঘের : মাসুদ বিন মোমেন
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে জাতিসংঘের কোনো উদ্বেগ নেই বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। তিনি বলেন, জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত কোনো দেশে নির্বাচন হলে তারা বিষয়টি সাধারণ রুটিন-কাজ হিসেবে দেখে। গতকাল নিউইয়র্কে বাংলাদেশ মিশনের স্থায়ী কার্যালয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।
মাসুদ বিন মোমেন বলেন, নির্বাচন-সংক্রান্ত জাতিসংঘের যে রাজনৈতিক বিভাগ আছে এবং যারা এ-সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখভাল করে, তারা আমাদের কাছে কখনো কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেননি। বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এই সফরটিও তারা দেখছেন ধারাবাহিক একটি সাধারণ বিষয় হিসেবে। জাতিসংঘ তখনই একটা দেশকে নির্বাচনী সহায়তা দিতে পারে বা নির্বাচন পর্যবেক্ষণের বিষয়টি আসে, যখন সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা থাকে। এই এজেন্ডাগুলো আসবে নিরাপত্তা পরিষদ থেকে। অথবা সাধারণ পরিষদ থেকে। সুতরাং জাতিসংঘ চাইলেই কোনো দেশের নির্বাচনের বিষয়ে নিজ উদ্যোগে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না, হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কোনো সুযোগ নেই। আর এ ছাড়া জাতিসংঘকে যদি সেই দেশের সরকার বা কোনো কর্তৃপক্ষ থেকে কোনো আমন্ত্রণ জানানো হয় সহায়তার জন্য, তখনই কেবল জাতিসংঘ যেতে পারে। এ ছাড়া যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত কোনো দেশে নির্বাচন হলে তখন জাতিসংঘ বিষয়টি তাদের সাধারণ রুটিনমাফিক দেখে। সংশ্লিষ্ট দেশে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি যিনি থাকেন, তার মাধ্যমে বা পর্যবেক্ষক পাঠানো বিষয়ে জাতিসংঘ সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এ জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের সমর্থন লাগে। জাতিসংঘের সদর দফতরে যারা আছেন, আমার সঙ্গে তারা নির্বাচন নিয়ে কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেননি বা আগ্রহ প্রকাশ করেননি। সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন করতে সব সময় জাতিসংঘের আহ্বান থাকে। আমাদের সরকারও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ একটি ইনক্লুসিভ, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে।’ বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার টানা ১০ বার জাতিসংঘে ভাষণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে বিশ্বের সবাই স্বীকার করেছে, বাংলাদেশ উন্নয়নের একটা রোল মডেল। এবং রোল মডেল হওয়ার প্রধান কারণ ভিশনারি, শক্তিশালী ও ধারাবাহিক নেতৃত্ব। এটা সবাই স্বীকার করতে বাধ্য যে, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য বলিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রয়োজন। স্বপ্নচারী নেতৃত্বের প্রয়োজন আছে। সুতরাং এটা সবাই এমনিতেই স্বীকার করছে যে, দেশে গত ১০ বছরের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার যে নীতিগুলো গ্রহণ করা হয়েছিল, যে ভিশন থেকে এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশল থেকে, বিশেষ করে বিদ্যুৎ খাতে একসময় বাংলাদেশ প্রচুর ডেভিশিড ছিল এবং লোডশেডিং একটা নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল, গত ১০ বছরে আমরা লোডশেডিংয়ের মাত্রা কমিয়ে আনতে পেরেছি, নেই বললেই চলে। কয়েক দিন আগে দেখলাম যে আমাদের এটাই রেকর্ড স্থাপিত হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে এটা আরও বাড়বে। বিশেষ করে যখন রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রটা চালু হয়ে যাবে, এ ছাড়া জাপানের সঙ্গেও বড় একটা প্রকল্প আছে। আরও কয়েকটা বড় প্রকল্প নেওয়া আছে। এ ছাড়া এলএনজির ক্ষেত্রেও প্রকল্প নেওয়া আছে। প্রকল্পগুলো যখন বাস্তবায়িত হবে তখন আমাদের এনার্জির দিক থেকে কোনো সমস্যা থাকবে না। আমরা জানি যে শিল্পায়নের জন্য ধারাবাহিক চাহিদা থাকবে এনার্জির। এই গ্যাপটা আর আগামীতে থাকবে না। তাতে করে আরও নতুন করে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে। এ সবকিছুই সম্ভব, যদি একটি ধারাবাহিক নেতৃত্ব চলমান থাকে। অনেক দেশ আছে, যেখানে হয়তো পাঁচ বছর এক ধরনের পলিসি নেওয়া হলো, আবার তার পরের পাঁচ বছর অনেক প্রকল্প বাদ হয়ে গেল বা একটা নতুন সরকার এলো। সুতরাং আমরা এটা দেখেছি, যেসব দেশে শক্তিশালী, দায়িত্বশীল ও ধারাবাহিক নেতৃত্ব চলমান থাকে, সেই দেশগুলো খুব দ্রুতই এগিয়ে যায়। বাংলাদেশেও আমরা সে রকম লক্ষ্য করেছি বা সবাই সেটা স্বীকারও করে।’
মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘সবাই জানে যে বাংলাদেশ অতিসম্প্রতি স্বল্পোন্নত দেশের যে ক্যাটাগরি ছিল সেখান থেকে যেসব এলিজিবিলিটি ক্রাইটেরিয়া আছে, সেই তিনটি ক্রাইটেরিয়াতে আমরা বেশ উল্লেখযোগ্য ব্যবধানে অতিক্রম করেছি। ২০২১ সালে আরেকবার একটি রিভিউ হবে। সেই রিভিউতে যদি এমন ফলাফল পাওয়া যায়, তাহলে স্বল্পোন্নত ক্যাটাগরি থেকে আমরা স্থায়ীভাবে বেরিয়ে আসব। আমরা উন্নয়নশীল দেশের যে কাতার আছে তাতে চলে আসব। এখন বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ অবশ্যই আছে। তবে আমরা যেটা দেখছি, আমাদের যে মাইক্রো ইকোনমি ইন্ডিকেটরগুলো আছে, সবই পজেটিভ আছে। আমাদের যে সামাজিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি আছে, সেগুলো এত ভালো করছে অতিসম্প্রতি, মানব উন্নয়নে জাতিসংঘের যে সূচক প্রকাশ হয় সেখানেও আমরা ১৩৮ থেকে ১৩৬-এ উঠে এসেছি। সুতরাং আমরা তেমন কোনো তাত্ক্ষণিক সমস্যা দেখতে পাচ্ছি না। তবে কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। বৈশ্বিক কিছু টেন্ড আছে, সেগুলো যদি খুব বেশি আমাদের বিপক্ষে চলে যায়, বিভিন্ন দেশ নতুন করে শুল্ক আরোপ করার উদ্যোগ নিচ্ছে—এগুলো চিন্তার বিষয়। আমরাও সে ব্যাপারে চিন্তিত। আরেকটি হলো জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে স্বাভাবিক দুর্যোগ আছে, হঠাৎ করে সেগুলো আসে এবং সেগুলো অনেক বড় বড় দেশ, সম্প্রতি দেখেছি যুক্তরাষ্ট্র একটি হারিকেনের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। তারাও কতটা অসহায় হয়ে গেল। সুতরাং এই দিকগুলো যদি অতিক্রম করতে পারি, তাহলে আমরা ওই রকম কোনো বড় বাধা দেখছি না। আর এলডিসি বিষয়ে আমরা যেসব সুযোগ-সুবিধা পেতাম, তিন বছর বা তার কিছু সময় পর সেগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা এখন থেকেই তৈরি হচ্ছি, কীভাবে আমরা নিজেদের অর্থে আমাদের উন্নয়নের অগ্রগতি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। একসময় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বেশির ভাগ আসত বৈদেশিক সাহায্য থেকে। এখন নেই বললেই চলে, কমে এসেছে। আমাদের আয় বেড়েছে, সক্ষমতা বেড়েছে। অভ্যন্তরীণ মার্কেটটিও এখন বড়। প্রায় ১৬০ বিলিয়ন ডলারের। ফলে এখন বিদেশিরাও বিনিয়োগ করতে আসছে। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। যে অর্থনৈতিক জোন হচ্ছে, সেগুলো চালু হয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে সবকিছুই আমাদের পক্ষে আছে। আমরা আগে যেসব সুবিধা পেতাম, সেগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা তা মোকাবিলা করতে প্রস্তুত।