দৈনন্দিন কাজ ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য গত এক বছরে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ নেয়নি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। অথচ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নিজেদের জন্য একটি আইনি কাঠামো প্রণয়ন এবং তা প্রয়োগ করে ভোটারদের নির্দ্বিধায় ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল প্রতিষ্ঠানটি।

এই লক্ষ্যে ইসি গত বছর অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ করেছিল। সংলাপের সুপারিশগুলোকে রাজনৈতিক, সাংবিধানিক এবং নির্বাচন কমিশনের নিজের এখতিয়ারভুক্ত কাজ হিসেবে চিহ্নিত করে তারা। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কোনো সুপারিশ বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।

অংশীজনদের বেশির ভাগ বলছেন, কার্যত এক বছর আগে ইসি যে অবস্থানে ছিল, এখন পর্যন্ত সেই অবস্থানেই আছে। ৩১ অক্টোবর থেকে জাতীয় নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হবে। হাতে সময় তিন মাসও নেই। ফলে ইসির বহুল আলোচিত সংলাপের উদ্দেশ্য ও সফলতা এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন করার সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এরই মধ্যে গত ৭ আগস্ট প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনে কোথাও কোনো অনিয়ম হবে না-এমন নিশ্চয়তা দেওয়ার সুযোগ নেই। নির্বাচনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ ধরনের বক্তব্য সাধারণ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে আস্থাহীনতা তৈরি করবে। অনেকে মনে করছেন, সিইসির বক্তব্যে ইসির অসহায়ত্ব ও বাস্তবতা প্রকাশ পেয়েছে।

আবার সিইসির এই বক্তব্যের জেরে এই ইসির ভেতরে চলমান মতবিরোধ আরও প্রকাশ্যে এসেছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর ইসির কর্মকর্তাদের বদলি নিয়ে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছিল। এরপর জাতীয় নির্বাচনে সেনা মোতায়েন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারে সাংসদের অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার প্রশ্নে এই দুজনের মতবিরোধ সামনে এসেছিল। এবার মাহবুব তালুকদারসহ আরও তিন কমিশনার সিইসির মতের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।

গত বছরের ১৬ জুলাই একাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সাতটি কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল ইসি। এগুলো হচ্ছে আইনি কাঠামো পর্যালোচনা ও সংস্কার, নির্বাচনপ্রক্রিয়া সহজ ও যুগোপযোগী করার জন্য সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ গ্রহণ, সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণ, নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সরবরাহ, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও নিবন্ধিত দলের নিরীক্ষা এবং নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সবার সক্ষমতা বাড়ানো।

এই সাতটি বিষয় সামনে রেখে সংলাপ করেছিল ইসি। ৩৯টি রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধি, পর্যবেক্ষক সংস্থা, নারীনেত্রী ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা সংলাপে অংশ নেন।

সংলাপের সুপারিশগুলো নিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে ইসি একটি বই প্রকাশ করে। তাতে সুপারিশগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। কিন্তু ইসি কী ভাবছে বা কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, তার উল্লেখ নেই বইয়ে।

জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন, ইভিএম ব্যবহার, ‘না’ ভোটের বিধান চালু করাসহ কয়েকটি বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে সুপারিশ এসেছিল সংলাপে। গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়গুলো ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল’ হিসেবে চিহ্নিত করেই দায়িত্ব শেষ করে ইসি।

আর সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল, কিছু মন্ত্রণালয়কে নির্বাচনের সময় ইসির অধীনে নেওয়াসহ ছয়টি সুপারিশকে ‘সাংবিধানিক বিষয়’ হিসেবে চিহ্নিত করে। ইসি বলেছে, এ ক্ষেত্রে তাদের কিছু করার নেই।

নির্বাচনী আইনের সংস্কার, সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করাসহ ৩৪টি প্রস্তাব ও সুপারিশকে ইসি নিজেদের এখতিয়ারভুক্ত বলেছে। কিন্তু এসব বিষয়েও কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি।

ইসির কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী গত বছরের ডিসেম্বরে আইন সংস্কারের খসড়া প্রস্তুত এবং এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা। ইসির আইন ও বিধিমালা সংস্কারসংক্রান্ত কমিটি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) ৩৫টি সংশোধনী সুপারিশ করেছিল। গত এপ্রিলে ইসি এই সুপারিশ আরও পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নেয়। এখন ইসি বলছে, আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে আরপিওতে কোনো সংশোধনী আনা হচ্ছে না।

তবে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ ও প্রশিক্ষণ-এই মূল কাজগুলো হয়েছে। সক্ষমতা বাড়ানো, ইসির নিজস্ব পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলো সংলাপের বিষয়বস্তু ছিল। কিছু সুপারিশ ছিল রাজনৈতিক সমঝোতা ও সাংবিধানিক বিষয়। এগুলো সরকারকে করতে হবে। তিনি বলেন, আইন সংশোধন একটি চলমান প্রক্রিয়া। নির্বাচনী আইনগুলো জটিল। তাই কিছুটা সময় নেওয়া হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ইসির সংলাপে সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছিল জাতীয় নির্বাচনে সেনা মোতায়েন ও ইভিএমের ব্যবহার। এ দুটি বিষয়ে বড় দুই জোটের অবস্থান বিপরীতমুখী। কিন্তু ইসি কী চায়, তা তারা সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি।

সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে ইসির সংলাপে অংশ নিয়েছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যেসব সুপারিশ বা প্রস্তাব এসেছিল, সেগুলো ইসি বিবেচনার যোগ্য মনে করছে কি না, তা-ও জানা গেল না। ইসি যদি মনে করে, সংসদ বহাল থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা তৈরি হতে পারে, তাহলে তার উচিত এটি সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো। আওতাভুক্ত নয় বলে এড়িয়ে যাওয়া ঠিক নয়। তিনি বলেন, স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে ইসির ‘গা ছাড়া ভাব’ দেখা গেছে। জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু করতে বিশেষ কোনো উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না।

ইসি নিজের এখতিয়ারভুক্ত হিসেবে যেসব সুপারিশ চিহ্নিত করেছে, তার মধ্যে আছে নির্বাচনী আইনের সংস্কার, সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি, নির্বাচনকালীন ও পরবর্তী সন্ত্রাস দমন, কালোটাকা ও পেশিশক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা, নির্বাচনী ব্যয় পর্যবেক্ষণ, নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, আচরণবিধি প্রতিপালনে পদক্ষেপ নেওয়া, নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও অনিয়ম করলে ব্যবস্থা নেওয়া ইত্যাদি।

নির্বাচনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এসব বিষয়েও ইসি এখন পর্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো বিবেচনায় নিলে এর প্রমাণ মেলে। বিশেষ করে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত খুলনা, গাজীপুর, রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি ইসি। এসব নির্বাচনে ইসির চেয়ে পুলিশকেই বড় ভূমিকায় দেখা গেছে। পেশিশক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, নির্বাচনী ব্যয় পর্যবেক্ষণ বা আচরণবিধি প্রতিপালনে কঠোর হতেও দেখা যায়নি।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, সংলাপের পর এক বছরে কোনো অগ্রগতি হয়নি, বরং পশ্চাদ্গতি হয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সব কটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকার যেভাবে চেয়েছে, ইসি সেভাবে কাজ করেছে। তারা ভোটার ও প্রার্থীদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি। এ থেকেই বোঝা যায়, জাতীয় নির্বাচনেও ইসি সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হবে।

অবশ্য আওয়ামী লীগ মনে করে, জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে ইসি কাজ করে যাচ্ছে। দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান প্রথম আলোকে বলেন, সংলাপ ছিল জাতীয় নির্বাচন নিয়ে, তবে সেখানে সব নির্বাচন আলোচনায় এসেছিল। আওয়ামী লীগ ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছিল। তা স্থানীয় নির্বাচনে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার হয়েছে। তিনি বলেন, ভোটার তালিকাসহ নির্বাচনের প্রয়োজনীয় সব ব্যাপারে ইসির কাজে অগ্রগতি আছে। কিছু সমালোচনা থাকলেও সেগুলো আমলে নিয়ে জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে ইসি।

ইসি সূত্র বলছে, আগামী ৩১ অক্টোবর থেকে যেকোনো দিন ইসি চাইলে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে পারবে। ডিসেম্বরের শেষে অথবা জানুয়ারির শুরুতে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। সে লক্ষ্যে বিধিবদ্ধ কাজগুলো ইসি করে যাচ্ছে।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ হিসেবে ইসির সংলাপে যোগ দিয়েছিলেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সংলাপে সুপারিশ ছিল মূলত আরপিওর কিছু জায়গা সংশোধন এবং ইসিকে শক্তিশালী করা। সংলাপের পর ইসি একটি ‘বুকলেট’ দিয়েছে। সেখানে শুধু কে কী বলেছে, সেটাই আছে; ইসি কী করবে, তা নেই। আইনি কাঠামো সংস্কারের প্রস্তাব এখনো না পাঠিয়ে থাকলে ইতিমধ্যে তারা দেরি করে ফেলেছে বলা যায়। তিনি বলেন, সংলাপের মাধ্যমে যা পাওয়ার কথা, তার অগ্রগতি চোখে পড়ে না।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here