বিশেষ প্রতিনিধিঃ

চারিদিকে নীল জলরাশি আর মাঝখানে ছোট্ট দ্বীপ সেন্ট মার্টিন। টেকনাফ থেকে নাফ নদী ধরে জাহাজ যখনই সমুদ্রে প্রবেশ করে নীলের আবেশে প্রবেশ করি আমরাও। অপূর্ব সেই রঙ, একবার দেখলে ভুলে যাবার নয়। বরং তার ডাকে বার বার ছুটে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।  আমাদের ভ্রমণ তালিকায় বছরের শেষ ভ্রমণ ছিল সেন্ট মার্টিন। সকল ব্যস্ততাকে পিছনে ফেলে শহরের কোলাহল থেকে দূরে থাকতে এক সন্ধ্যায় বেরিয়ে পড়ে আমাদের ছোট্ট দলটি। টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনগামী জাহাজ কেয়ারী সিন্দবাদের টিকেট করে রাখলাম। হোটেল ও বুক করলাম।   

জেটি থেকেই পিপাসু চোখ নাফ নদীর দিকে তাকিয়ে, হায়! কখন পৌছব সেই সমুদ্রে! যাত্রা শুরু করে বোঝা গেল নাফ নদীটিও সৌন্দর্য্যে অপরূপা। নদীর একদিকে পাহাড়, যা কিনা আমাদের টেকনাফ। অন্যদিকে দূরে মায়ানমার। অপূর্ব সবুজ প্রকৃতি। জাহাজ চলার কিছুক্ষণের মাঝেই গাঙচিল হল আমাদের সাথী। জাহাজের যাত্রীরা চিপস, বাদাম, চকলেট যার কাছে যা ছিল ছুঁড়ে দিচ্ছিল ওদের। জাহাজ ঘিরে শত শত গাঙচিল। আমরা চলেছি ,ওরাও চলেছে আমাদের সাথে। এভাবেই চললো নাফ নদী পর্যন্ত। মোহনার দিকে যতই এগিয়ে এলাম গাঙচিলের সংখ্যা কমে এল।

এবার আমাদের সমূদ্রজয়ের পালা। ঢেউ বেড়ে গেল। বড় বড় ঢেউ জানান দিল সমূদ্র এসে গেছে। রঙ ও বদলে গেল জলের। কিছুক্ষণ পরেই দূরে দেখা যেতে লাগলো দ্বীপটি। ঢেউ এর সাথে তালে তালে আমরা পৌছলাম সেন্ট মার্টিন। বুকের ভেতর সে এক অন্য অনুভূতি। লাল পতাকা গুলো দেখছি আর ভাবছি ওই সুন্দর জায়গাটায় যাওয়া নিষেধ। কিন্তু বাকী পুরো দ্বীপই তো পড়ে আছে বেড়ানোর জন্য! কটেজ বুক করেছি। জানিও না কেমন সেটা। প্রথমেই রওনা দিলাম সেদিকে। নাম কিংসুক ইকো বীচ রিসোর্ট। পর্যটন সেভাবে গড়ে না উঠলেও সেন্টমার্টিনের একটা অংশ যেন শহরের মতোই কোলাহলপূর্ণ। বাজার, ভ্যান, খাবার হোটেল, ডিসপেনসারি, লণ্ড্রী কি নেই সেখানে! জেটি থেকে এই কোলাহলের পথ মাড়িয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম আমাদের নিরিবিলি রিসোর্টের দিকে। বেশ ভেতরের দিকে কিন্তু বীচের কাছে ছিল আমাদের কটেজটি। ছিমছাম, দোতলা। কিন্তু রুম থেকে বীচ দেখা যায় না। তবু পরিবেশটা ভালই লাগল। ততক্ষণে দুপুর হয়ে গেছে। গনগনে সূর্য আকাশে।

৬ ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি আমরা। তবু কারো চোখে কোন ক্লান্তি নেই। অবাক হয়ে দেখছি ঢেউ। সেন্ট মার্টিনে আসা অধিকাংশ পর্যটক জাহাজে এসে আবার সেই জাহাজেই ফিরে যায়। ১২টা থেকে ৩ টা পর্যন্ত তাই সরগরম থাকে জেটির কাছের বীচটি। জাহাজ ছেড়ে গেলেই কাঙ্ক্ষিত সেই নিরবতা। বিকেলে সমুদ্রের নীল হয় আরো গাঢ়। সেই নীলের দিকে তাকিয়ে বোধ হয় পার করে দেয়া যায় এক জীবন।

পরের দিন সকালে আমরা ছেঁড়া দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। সেন্ট মার্টিনের শেষ প্রান্ত থেকে কিছুটা দূর হলেও জেটি থেকে ইঞ্জিন নোকায় ঘন্টাখানেকের কম লাগলো না। নীল জল চিরে এগিয়ে যেতে লাগলাম আমরা। ছেরা দ্বীপের কাছাকাছি যেতেই নৌকার চালক দূরে বড় একটি পাথর দেখিয়ে বললেন ওটা মৌসুমী পাথর! আমরা দেখলাম সমুদ্রের অথৈ জলরাশির মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক পাথর। কেন এটি মৌসুমী পাথর? জানা গেল কোন এক সিনেমার শুটিং এর সময় চিত্রনায়িকা মৌসুমী বসেছিলেন ওই পাথরে!   ছেঁড়াদ্বীপটিও বেশ বড়। একদিয়ে ঘন জঙ্গল আর একদিকে কোরাল বিছানো বীচ। জঙ্গলে নারিকেল গাছের মত গাছগুলো আসলে কিন্তু নারিকেল গাছ নয়। স্থানীয়রা এদের কিয়া গাছ বলে। ছেঁড়া দ্বীপের একটি বড় অংশ এই গাছ। বর্ষায় নাকি দ্বীপ ডুবে গেলে দূর থেকে শুধু এই জঙ্গলই দেখা যায়।

পুরো দ্বীপ বেড়ানোর আগেই ফেরার ডাক এল। মনে দুঃখ নিয়ে নৌকায় উঠলাম সবাই। আবার নীল জল কেটে কেটে ফিরলাম মূল দ্বীপে।  সেন্টমার্টিনে সামূদ্রিক তাজা মাছের যেন উৎসব। নানান জাতের মাছের মেলা বসে হোটেলগুলোর সামনে। কোনটা খাবেন, কিভাবে খাবেন বললেই হল। মাছের লোভনীয় বারবিকিউ এর আয়োজন আছে সব হোটেলেই। এমনি সবজি, মাংস, ডাল ও পাওয়া যায়। কিন্তু সমুদ্রে গিয়ে মাছ না খাওয়া বোকামী। বেলায় বেলায় পেট পুরে মাছ খেয়েই চলল আমাদের উদরপূর্তি।

পরদিন ৩ টায় জাহাজে করে ফিরলাম আমরা। ফেরার পথটা চুপচাপ তাকিয়ে থাকলাম ফেলে আসা দ্বীপটার দিকে। এত সুন্দরকে ছেড়ে যেতে মন খারাপ হবে যে কারো। বিকেলের গাঢ় নীল জল কেটে কেটে  চলে এলাম নাফ নদী। মন ভাল করে দিতে আবার আমাদের সাথে যোগ দিল গাঙচিলের দল। তাদের সাথে খেলতে খেলতে শেষ হল এবারের সমূদ্র যাত্রা।  

কীভাবে যাবেন:ঢাকা থেকে সরাসরি সেন্ট মার্টিন যেতে হলে তাহলে শ্যামলী পরিবহন, হানিফ, ইউনিক পরিবহন এবং সেন্ট মার্টিন পরিবহণ সহ বেশ কিছু বাস সরাসরি টেকনাফ ঘাটের উদ্দেশ্যে রাত ৬:৩০-৮:৩০ এর মধ্যে ছেড়ে যায়। তারপর ঘাট থেকে কয়েকটি জাহাজ ছাড়ে সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশ্যে সকাল ৯টায়। যা দ্বীপে পৌছায় ১২ টার মধ্যে। এটি আবার ফিরে আসে ৩ টার দিকে সেন্ট মার্টিন থেকে। তবে অফ সিজনে (এপ্রিল এর মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) জাহাজ চলে না। তবে ট্রলার ছাড়ে সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশ্যে সারা বছরই।  আর কেউ যদি কক্সবাজার থেকে যান, তাহলে সকালে টেকনাফের উদ্দেশ্যে বাস, মাইক্রো, চান্দের গাড়ি ছাড়ে। অনেক প্যাকেজ অফার ও থাকে । যেই হোটেলে থাকবেন কক্সবাজারে, তাদের কাছে বললেও তারা ব্যবস্থা করে দিবে। তবে তাদের কাছে শুধু ট্রান্সপোর্ট এর সুবিধা ও আলাদা করে নেয়া যায়। যেমন শিপ এর টিকেট আর সকালে টেকনাফ যাবার সহায়তাটুকু নিতে পারবেন। 

খরচ: বাস নন এ সি- ৯০০ টাকা, এসি ১৫৫০ টাকা । তবে আসার টিকেট সেন্ট মারটিন থেকে কাটলে প্রতি টিকেটে ৩০-৫০ টাকা তারা চার্জ হিসেবে বেশি রাখবে। 

জাহাজ– নিচ তলা ৫৫০ টাকা, দো-তলা ওপেন ডেক ৭০০/৭৫০ টাকা, ভি আই পি ৮৫০/৯০০ টাকা।আর শিপের টিকেট এর মুল্য আসা এবং যাওয়া সহ এটা ধরা হয়। কেু যাবার টিকেট নেয়ার সময় বলে নিতে হয় কবে ব্যাক করবেন, সেইভাবেই ফেরার টিকেট শিপ দেয়া হয়। গ্রীনলাইনের টিকেট ওয়ান ওয়ে-ও দেয়, ৫০০/৬০০ দুই ধরনের ক্যাটাগরি আছে। আসা যাওয়া ১০০০/১২০০ টাকা। 

রিসোর্ট– রিসোর্ট এর ভাড়া সিজন এর সময় কোন নির্দিষ্ট নেই তেমন, ট্যুরিস্ট এর উপর নির্ভর করে রিসোর্ট মালিক রা ভাড়া বাড়ায় কমায়। তবে সিজনে ১৫০০-২০০০ টাকার কমে রুম পাওয়া কষ্ট সাধ্য, যদি না সেখানে পরিচিত কেও থাকে। আর অফ সিজনে ৭০০-১২০০ টাকায় পাওয়া যাবে সি রিসোর্ট গুলো। আর রিসোর্টের প্রতি রুমে ৪ জন করে আরামে থাকা যায়। চেক আউট সময় ১১ টা। 

ছেঁড়া দ্বীপ– ছেঁড়া দ্বীপ যাবার জন্য ট্রলার ভাড়া ১৬০-২০০ টাকা করে, আর রিজার্ভ নিলে ১৫০০-৪৫০০ টাকা নেয় নৌকার আকার আর যাত্রীর উপর ভিত্তি করে। 

যা যা করবেন না-– যেখানে সেখানে চিপসের প্যাকেট, পলিথিন যাতীয় কিছু ফেলবেন না। এমন কি সিগারেটের অবশিষ্টাংশও দ্বীপের জন্য ক্ষতিকর।- ভাঁটার সময় পানিতে নামবেন না।- লাল পতাকা চিহ্নিত এলাকাগুলো খেয়াল করুন, সেখানে যাবেন না- সেন্ট মার্টিনে প্রচুর কোরাল রয়েছে সারা বীচ জুড়ে। এগুলো খুবই ধারালো। তাই সাবধানে বীচে নামুন। প্রকৃতির কাছে গিয়ে নীরবতা বজায় রাখুন। নিজে উপভোগ করুন অন্যকেও উপভোগ করতে দিন। 

তথ্যঃ সংগৃহীত, ছবিঃ শাহরিয়ার আলম সোহাগ।

ভিডিও দেখুন…

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here