পতাকা আক্রান্ত, সুশীল বুদ্ধিজীবীরা এখন কোথায়?
কলকাতার বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন ঘেরাওয়ের পর ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনে হামলা হয়েছে, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা আগুনে পোড়ানো হয়েছে। ফেনী সীমান্ত ও সিলেট সীমান্ত দিয়ে ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নেতারা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করেছে। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর ‘আমাদের প্রস্তাব, কেন্দ্র রাষ্ট্রপুঞ্জের (জাতিসংঘ) কাছে বাংলাদেশে শান্তিসেনা পাঠানোর আরজি জানাক।’ মন্তব্য নিয়ে তোলপাড় চলছে। প্রতিবাদে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঢাকায় কর্মরত ভারতের হাইকমিশনার প্রণব মুখার্জীকে ডেকে কড়া বার্তা দিয়েছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। আইন উপদেষ্টা স্পষ্টভাবে বার্তা দিয়েছেন যে ‘ভারতকে বুঝতে হবে এটা শেখ হাসিনার সরকার নয়’। বিএনপি, জামায়াতসহ ডান-বাম সব রাজনৈতিক দল ভারতের এই আক্রমণ, ষড়যন্ত্র ও জাতীয় পতাকা পোড়ানোর হিংস্র আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
আগরতলা উপ-হাইকমিশনে হামলা ও পতাকা পোড়ানোর প্রতিবাদে মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে এসে বিক্ষোভ করেছে। ভারতকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বানে সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় বইছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক কমিটি, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠন প্রতিবাদে মিছিল, মিটিং, মানবন্ধন করছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নেটিজেনরা প্রতিবাদের ঝড় তুলেছেন। দেশপ্রেমী কিছু জাতীয়তাবাদী চেতনার ব্যক্তি তীব্র প্রতিবাদ করছেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘ভারতের ষড়যন্ত্র রুখতে’ জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। কিন্তু মুখচেনা তথাকথিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা এবং বিজাতীয় চেতনাধারী গণমাধ্যম এখনো নীরবতা পালন করছেন। আগরতলায় উপ- হাইকমিশনে হামলা, জাতীয় পতাকা পোড়ানো ও বাংলাদেশ অভিমুখে যাত্রাকে ‘মামুলি’ বিষয় হিসেবে নিয়ে গণমাধ্যমে নিউজ করতে হয় তাই পাঠকদের জন্য খবর প্রচার করছে। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী বুদ্ধিজীবীরা কার্যত উট পাখির মতো গর্তে মুখ লুকিয়ে রেখেছেন। পান থেকে চুন খসলেই যারা প্রতিবাদে হৈ হৈ করে উঠেন, চেতনার ব্যাপারী হিসেবে দেশ রক্ষার ধুয়া তুলে রাস্তায় নামেন, কলমের ডগায় প্রতিবাদের ঝড় তুলে গণমাধ্যমে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেন; সেই বুদ্ধিজীবীরা এখন কোথায়? সর্বত্রই এ প্রশ্ন উচ্চারিত হচ্ছে।
৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালানোর পর থেকে হিন্দুত্ববাদী ভারত একের পর এক ষড়যন্ত্রের তীর ছুড়ছে বাংলাদেশ অভিমুখে। ‘প্রতি বিপ্লবের’ নামে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা করছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা নষ্টের অপচেষ্টা চালাচ্ছে। সর্বশেষ হিন্দুত্ববাদী সংগঠন হিন্দু সংঘ সমিতি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) আগরতলায় বাংলাদেশের উপ-দূতাবাসে হামলা করে বাংলাদেশের লাল সবুজের জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে দিয়েছে। এর প্রতিবাদে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-মাদরাসার শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নেটিজেনরা প্রতিবাদের ঝড় তুলেছেন। প্রতিবাদের সে গরম হাওয়া তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও সুশীলসমাজকে স্পর্শ করছে না। ভারতের কলকাতা ও আগরতলায় উপ-হাইকমিশনে হামলার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশের ওপর আক্রমণ। দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ হয় কিন্তু শত্রু দেশের দূতাবাস ও হাইকমিশন থাকে সুরক্ষিত। শত্রু দেশই সে সুরক্ষা দেয়। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী বিদেশের মাটিতে গড়ে তোলা দূতাবাস ও হাইকমিশন সংশ্লিষ্ট দেশের অংশবিশেষ। কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে যে দেশে দূতাবাস স্থাপন করা হয় সে দেশকে অন্য দেশের দূতাবাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়। ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনে আক্রমণ কার্যত বাংলাদেশের ওপর আক্রমণের নামান্তর। গত এপ্রিল মাসে সিরিয়ার দামেস্কের পশ্চিম মেজেহ জেলার একটি হাইওয়েতে অবস্থিত ইরানি কনস্যুলেট ভবনে ইসরাইলি বিমান হামলা করেছিল। এর প্রতিবাদে ইরান থেকে তিনশ’ মিশাইল ছোড়া হয়েছিল ইসরাইলের দিকে। ইরানের জনগণ, সুশীলসমাজ ও বু্িদ্ধজীবীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দামেস্কের ইরানি কনস্যুলেটে হামলার প্রতিবাদে ইসরাইলের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিল। কিন্তু আগরতলায় বাংলাদেশের উপ-হাইকমিনে আক্রমণ ও পতাকা পুড়িয়ে দেয়ার পর দেশ-বিদেশে তোলপাড় চললেও চেতনাধারী সুশীল একেবারে নিশ্চুপ। গত সপ্তাহেও শিশুদের বলাৎকার ও নারীদের সঙ্গে অবৈধ যৌন কাজে লিপ্ত থাকার অপরাধে ইসকন থেকে বহিষ্কৃত চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতারের পর চেতনাধারী কিছু বুদ্ধিজীবীকে আফসোস লীগের ভূমিকায় দেখা গেছে। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতার করা উচিত হয়নি বলে বক্তব্য দেন। কিন্তু মমতার বক্তব্য ও আগরতলার ঘটনার পর ওই বুদ্ধিজীবীরা পর্দার আড়ালে চলে যান। দিল্লির উচ্ছিষ্টভোগী ওই বুদ্ধিজীবীরা এখনো খোয়াব দেখছেন হাসিনা ফিরে আসবেন!
১৯৭২ সালে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ বইয়ে আহমদ ছফা লিখেছেন ‘বুদ্ধিজীবীদের কথা শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, এখন স্বাধীনতার পরও তাঁদের মত অনুযায়ী চললে বাংলাদেশের উন্নতি হবে না।’ চেতনাধারী বুদ্ধিজীবীদের পোস্টমর্টেম তিনি ভালোভাবেই করেছিলেন। শেখ হাসিনা ১৫ বছর গণভবনে সংবাদ সম্মেলনের নামে তোয়াজ পার্টি করতেন; সেখানে চেতনাধারী বুদ্ধিজীবী, দালাল শ্রেণির গণমাধ্যম, সাংবাদিক, সুশীলরা শরিক হতেন, পিঠা-পুলি খেতেন। ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে তোয়াজ করে প্লট, ফ্ল্যাট, বিভিন্ন সেক্টরে পদ-পদবি, কন্ট্রাক্টরি, লাইসেন্স, প্রশাসনে নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য করেছেন। জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আমজনতা রাস্তায় নেমে এলে হাসিনার নির্দেশে পুলিশ, র্যাব, সেনা, বিজিবি দিয়ে পাখির মতো গুলি করে মানুষ মেরেছে। সে সময়ও সুশীল ও বু্িদ্ধজীবীরা ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে বিশৃঙ্খলার অভিযোগ তুলে তাদের ‘ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা’ করার পরামর্শ দিয়েছেন। হাসিনার পক্ষে অবস্থান নিয়ে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে হিংস্র হিসেবে অভিহিত করে প্রবন্ধ নিবন্ধ লিখেছেন। কেউ কেউ ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) হেমলেট বাহিনী, লাঠিয়াল বাহিনীকে উস্কে দিতেন। ছাত্র-জনতা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, দেশ ধ্বংস করছে অভিযোগ তুলে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে ঢাকার রাজপথে আরো রক্ত ঝরাতে লাশ ফেলার পরামর্শ দিয়েছেন। দেশরক্ষার (!) লক্ষ্যে পুলিশ-র্যাব-বিজিবির স্নাইপার দিয়ে গুলি করে মানুষ হত্যা, হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে ছাত্র হত্যার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ফেরাতে এবং দেশ রক্ষায় যে বুদ্ধিজীবীরা এত সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, রাজপথে মিছিল করেছেন, প্রবন্ধ- নিবন্ধ লিখে কলমে রক্ত ঝরিয়েছেন, সেই বুদ্ধিজীবীরা এখন নীরব। ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনে আক্রমণকে তারা কি দেশের বিরুদ্ধে আক্রমণ মনে করছেন না? কলকাতা ও আগরতলায় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ছিঁড়ে ফেলা এবং পুড়িয়ে দেয়াকে তাদের কাছে অবমাননা মনে হচ্ছে না?
বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার সময় সমর্থকরা পছন্দের দলের পক্ষে সে দেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ক্রিকেট খেলার সময়ও সমর্থকদের মধ্যে এটা দেখা যায়। ভিনদেশের পতাকা ওড়ানোকে খেলার অংশ হিসেবে ধরে নেয়া হয়। বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলার সময় পুরান ঢাকার আরমানিটোলার পাকিস্তান দলের সমর্থক জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেলের বাড়িতে পাকিস্তানি পতাকা উড়ানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য ক্রিকেট দলকে সমর্থন করা। কিন্তু ওই পতাকা ওঠানোকে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর হুমকি আওয়াজ তুলে বুদ্ধিজীবী ও সুশীলরা তীব্র প্রতিবাদে রাজপথ কাঁপিয়ে তুলেছিলেন। গণমাধ্যমে প্রবন্ধ-নিবন্ধ-সম্পাদকীয় লিখে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন। ওই ঘটনায় জাতীয় পার্টির নেতা জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেলের দুই পুত্র তারেক আদেল ও জোবায়েদ আদেলের বিরুদ্ধে ৫০টি মামলা দায়ের করা হয়। ‘দেশ গেল দেশ গেল’ বলে যারা রাস্তায় নেমে এসেছিলেন সেই বুদ্ধিজীবী ও সুশীলরা ভারতে বাংলাদেশের পতাকা অবমাননায় নীরব হয়ে রয়েছেন। ওই ঘটনায় যেসব গণমাধ্যম বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলনের প্রতিবাদে পত্রিকার পাতায় পাতায় খবর, প্রবন্ধ, নিবন্ধে দেশপ্রেমের (!) স্বাক্ষর রেখেছিলেন সে গণমাধ্যমগুলোর এখন ভূমিকা কি? শিশু ধর্ষক সাবেক ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস গ্রেফতার হওয়ায় যারা ‘সংখ্যালঘু নির্যাতন’ আফসোস করছেন; সে বুদ্ধিজীবীদের কাছে ২০১২ সালের পুরান ঢাকায় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হাতে দর্জি বিশ্বজিৎ খুনের ঘটনা সংখ্যালঘু নির্যাতন মনে হয়নি। ভারতের ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ করেছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ। অথচ চেতনাধারী সুশীলের ঘুম এখনো ভাঙছে না?
সবুজদেশ/এসইউ