পলি মাটি জমে মরা খালে পরিণত নদী, বোরো আবাদ ব্যাহত
জাহিদ হাসান, যশোরঃ
ভবদহ স্লুইচগেট সংলগ্ন শ্রী, টেকা ও হরিনদীতে পলি মাটি জমে মরা খালে পরিণত হয়েছে। গেল বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি তেমন না হলেও ভবদহ সংলগ্ন বিলবোকড়, বিল কেদেরিয়া, দামোখালি, বিল আড়পাতা, বিলকপালিয়ায় জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ে কিন্তু ভবদহ স্লুইসগেট দিয়ে পানি নিস্কাশন না হওয়ায় চলতি বোরো মৌসুমে ধানের আবাদ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
অথচ জলাবদ্ধতা ঠেকাতে ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়ে শ্রী, হরি ও টেকা নদী খননের পাইলট প্রকল্পের কাজ শেষ হতেই তা আবার পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে। তারপরও নদী খননে ৮০৭ কোটি ৯২ লাখ ১২ হাজার টাকার প্রকল্প ছাড়ের অপেক্ষায় রয়েছে। ভবদহ পানি নিস্কাশন সংগ্রাম কমিটির আশংকা, আগামাী বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতার কারণে এ অঞ্চলের ৬ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়বে। সেই সাথে হুমকির মধ্যে পড়বে জীব-বৈচিত্র।
নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে না আনলে মানুষের ভোগান্তি চরম পর্যায় পৌঁছাবে। ভুক্তোভোগী ভবদহপাড়ের হাজারো কৃষকের দাবি, টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) বা জোয়াধার চালুই এই সংকট উত্তরণের একমাত্র পথ।
সরেজমিনে দেখা যায়, ভবদহ স্লইচগেট সংলগ্ন নদীগুলোতে পলি জমে ভরাট হওয়ায় নদী থেকে বিলের গভীরতা ৬ থেকে ১০ ফুট নিচু। গত কয়েক বছর ধরে বোরো মৌসুমে সেচ দিয়ে ধানের আবাদ করে আসছিল ভবদহ অঞ্চলের কৃষক। কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন। পলি জমে নদী ভরাট হওয়ায় সেচ দিলেও কোনভাবেই পানি নিস্কাশন সম্ভব হচ্ছে না। যেকারণে ভবদহপাড়ের হাজারো কৃষক হতাশ হয়ে পড়েছেন।
ভবদহ অঞ্চলের বিলকপালিয়া পাড়ের কৃষক বিষ্ণু মন্ডল বলেন, ‘প্রতি কাঠা হাজার টাহাই লীজ নিয়ে ৩ কাঠা জমিতি পাতা (বীজতলা) লাগাইছিলাম। এবার আমাদের না খাইয়ে মরতি হবে। বছরে একবারই ধান হয়। তাই দিয়ে সারাবছর খাই। কিন্তু এবার জল সরাতি না পারাই ধান লাগাতি পারছিনে’।
পাঁচাকড়ি রাজবংশি পাড়ার ইউপি সদস্য শুধাণ্যু বিশ্বাস বলেন, এবার আমাদের কোন উপায় নেই। ধানতো দূরের কথা, আগামী বর্ষা মৌসুমে সামান্য বৃষ্টিতে বাড়ি-ঘরে থাকা দায় হয়ে পড়বে। বার বার টিআরএম চালুর আশ্বাস দিলেও রহস্যজনক কারণে তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
মণিরামপুর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, ভবদহ সংলগ্ন উপজেলার মনোহরপুর, কপালিয়া, নেহালপুর, হরিদাসকাটি, কুলটিয়া, হাটগাছা, সুজাতপুর, বাজে কুলটিয়া, বালিধাহ, পাঁচাকড়ি, বাগডাঙ্গা, ডাঙ্গামহিষদিয়াসহ কমপক্ষে অর্ধশত গ্রামের কৃষকের এবার বোরা আবাদ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। গেল বোরো মৌসুমে কপালিয়া এলাকায় ৩০০ হেক্টর, নেহালপুর এরাকায় ১৯৫ হেক্টর, কুলটিয়া ইউনিয়নে ২৪৮৫ হেক্টর, হরিদাসকাটি ইউনিয়নে ১৮৩২ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হলেও বিল কপালিয়া, বিল শায়লা, বিল আড়পাতা, বিল কেদেরিয়ায় জলাবদ্ধতার কারনে গড়ে শতকরা ৭০ ভাগ জমিতে বোরো আবাদ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
অভয়নগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা গোলাম সামদানি জানান, ভবদহ সংলগ্ন পায়রা, সুন্দলী ও চলশিয়া ইউনিয়নে ৮০০ হেক্টর জমিতে এবার বোরো আবাদ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
ভবদহ পানি নিস্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক রনজিৎ বাওয়ালী বলেন, যশোর-খুলনা জেলার ২৭ বিলের মধ্যে চলতি বোরো মৌসুমে অন্তঃত ২০ বিলে এবার বোরো আবাদ হবে না।
তার দাবি, খনন করে এ সংকট দূর হবে না। প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা খননের নামে মহালুটপাটের আয়োজন করা হয়। কাজের কাজ কিছুই হয় না।
প্রকৃতিগতভাবে নদীগুলোর প্রবাহ চলতে না দিলে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে বড় প্রকল্প নিয়েও কোন কাজে আসবে না। তিনি আরো বলেন, দর্শনার মাথাভাঙ্গা-পদ্মার সাথে ভৈরব নদের পুনস্থাপন পূর্বক ভৈরব ও শ্রী নদীর সংযোগ করা হলে নাব্যতা ফিরে পাবে।
দামোখালির সাজ্জাত হোসেন নামের এক কৃষক বলেন, এক পাশ দিয়ে পলি কেটে যাওয়ার কয়েকদিন পর সেখানে আরো বেশি পলি জমে উচু হয়ে যাচ্ছে।
যশোর পাউবো (পানি উন্নয়ন বোর্ড) সূত্র জানায়, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে টিআরএম ছাড়াই ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা দূরীকরণে ৮০৭ কোটি ৯২ লাখ ১২ টাকা ব্যয়ে ‘ভববদহ ও তৎসংলগ্ন বিল এলাকার জলাবদ্ধতা দূরিকরণ প্রকল্পের ( দ্বিতীয় পর্যায়)’ উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিডিপি) পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। তা ছাড়ের অপেক্ষায় রয়েছে। এতে নদী পুনখনন ও ড্রেজিং, খাল পুণ খনন ও সংস্কার, খালের উপর কালভার্ট নির্মাণ, স্লইচগেট নির্মাণ ও মেরামত, বাঁধ নির্মাণ, সড়ক নির্মাণ, উন্নয়ন ও মেরামত এবং প্রতিরক্ষা কাজের উল্লেখ করা হয়েছে।
রনজিৎ বাওয়ালী আরো বলেন, ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ যশোর বিডি হলে তৎকালিন পানি সম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, হল্যান্ডের বিশেষজ্ঞ টিমের উপস্থিতিতে এক কর্মশালায় টিআরএম বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। সে মোতাবেক হলান্ডের বিশেষজ্ঞ টিম যাচাই-বাচাই পূর্বক ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে ৪৪৮ কোটি ৭১ লাখ ২৩ হাজার টাকার ‘ভবদহ ও তৎসংলগ্ন বিল এলাকার জলাবদ্ধতা দুরীকরণ প্রকল্পের প্রস্তাবনা পাউবো পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। পরে একই সালের ১২ সেপ্টেম্বরের যাচাই কমিটির সভায় টিআরএম নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে বিরোধ দেখা দেয়ায় তা বাতিল হয়ে যায়।
পাউবো’র যশোর জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ তাওহীদুল ইসলাম বলেন, স্থায়ী সমাধানের জন্য ইতোমধ্যে গৃহীত ৮০৭ কোটি ৯২ লাখ ১২ হাজার টাকার প্রকল্প একনেকে ছাড়ের অপেক্ষায় রয়েছে। দ্রুত সমাধানে পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে নদী খনন করা হচ্ছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সম্প্রতি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ভবদহ অঞ্চলে আসলে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মহোদয় টিআরএম প্রকল্প গ্রহণপূর্বক বাস্তবায়নের সুপারিশ করেন।