নিজস্ব প্রতিবেদক:
ঝিনাইদহের জাহেদা খাতুন ৩৫ বছর পর বাবার বাড়ি ফিরেছেন। এখন তার বয়স অনুমান ৫৫ বছর। ১৯৮৫ সালের দিকে পাকিস্তানে পাচার করা হয় তাকে। জেলা শহরের ভুটিয়ারগাতী গ্রামের মৃত জব্বার আলী শেখের বড় মেয়ে তিনি।
২০ বছর বয়সে (১৯৮০ সালের দিকে) পাবনা জেলার ঈশ্বরদী গ্রামের রহিমের সঙ্গে বিয়ে হয় জাহেদা খাতুনের। রহিমের আরও একটি স্ত্রী ছিল। সতিনের ঘর। বিবাদ লেগেই থাকত।
বিয়ের ৫ বছর পর শ্বশুরবাড়ির লোকজন নেশাজাতীয় ওষুধ খাইয়ে নারী পাচারকারী চক্রের কাছে বিক্রি করে দেয় জাহেদা খাতুনকে। গোপন থেকে যায় সেই খবর। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাকে না পেয়ে পরিবারের লোকজন ভেবেছিল মারা গেছেন তিনি। অবশেষে রোববার বাবার বাড়ি ফিরে এসেছেন জাহেদা।
এই ফিরে আসার গল্প বেশ লম্বা। বাংলাভাষা ভুলে গেছেন জাহেদা। নানা ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলা করতে হয়েছে তাকে। উর্দুতে সে জানায়, নারী পাচারকারীরা পাকিস্তানের করাচি শহরে নিয়ে যায় তাকে। সেখানেও তাকে দুই দফায় বিক্রি করা হয়। সব শেষ এক মৌলভী সাহেব কিনে নেন তাকে। ঠাঁই হয় পাকিস্তানের একটি মাদ্রাসায়।
ভাগ্য ভালো! ওই মাদ্রাসার মৌলভী সাহেব এক পাকিস্তানি যুবক গুল্লা খানের সঙ্গে বিয়ে দেন। দ্বিতীয় সংসারে দুই সন্তানের মা হন জাহেদা। ছেলে মারা গেছেন। একমাত্র মেয়ে ইয়াসমিন (২২) ও পাকিস্তানি স্বামীকে নিয়ে এখন সংসার তার। মেয়ের বিয়ে হয়েছে। নাতি-পুতি নিয়ে ভালোই কাটছিল তার। এখন তার বয়স আনুমানিক ৫৫ বছর।
দেশের মায়া তাকে তাড়া করে। কিন্তু কীভাবে ফিরবেন? ২০১৮ সালের দিকে পাকিস্তানি যুবক ওয়ালিউল্লাহ মারুফের কাছে জীবনের কথাগুলো খুলে বলেন জাহেদা খাতুন। ফেসবুক পেজে জাহেদাকে নিয়ে ভিডিওসহ উর্দুতে পোস্ট লিখতে থাকেন ওই যুবক। তার দেওয়া পোস্ট চোখে পড়ে নেত্রকোনা জেলার ছেলে মনজুর আহমেদের। তিনি সেটি বাংলায় অনুবাদ করেন।
এরপর শুরু হয় জাহেদার শিকড়ের সন্ধান। মনজুর আহমেদ ছুটে আসেন ঝিনাইদহের ভুটিয়ারগাতী গ্রামে। পেয়ে যান জাহেদার মা-বাবার ঠিকানা। যোগাযোগ করেন পাকিস্তানের ওই যুবকের সঙ্গে। তার মাধ্যমে মায়ের সঙ্গে কথা হয় জাহেদার। মায়ের সঙ্গে কথা বলার পর দেশে ফিরে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেন তিনি। টাকা ও পাসপোর্টের অভাবে ফিরতে পারছিলেন না জাহেদা খাতুন।
পাকিস্তানের ওই যুবক (ওয়ালিউল্লাহ মারুফ) সব ব্যবস্থা করে দেন। অবশেষে ২৮ আগস্ট শনিবার রাতে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে ঢাকায় আসেন জাহেদা। রোববার বিকালে মনজুর আহমেদ জাহেদাকে নিয়ে ঝিনাইদহে ফেরেন।
সোমবার সকালে খবর ছড়িয়ে পড়লে গ্রামের মানুষ ছুটে আসেন তার কাছে। জাহেদা কথা বলছেন উর্দু ভাষায়। তবে বাংলা ভাষায় প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে পারেন। মাত্র ৩ মাসের ভিসা নিয়ে এসেছেন। আবারো ফিরে যেতে হবে পাকিস্তানে।
শুধু জাহেদা নয়, হাজারো নারী পাচার হয়েছেন পাকিস্তান, ভারতসহ মধ্যপ্রাচ্যর বিভিন্ন দেশে। লোকলজ্জার ভয়ে অধিকাংশের পরিবার বিষয়টি জানাজানি করেন না। ধরা পড়ে না পাচারকারী চক্রের গডফাদারের দল। যারা ধরা পড়ে তারা আইনের ফাঁকে ঘুরে বেড়ান প্রকাশ্যে। অথচ পাচার হওয়া নারীদের নীরব কান্নার আওয়াজ কষ্ট দেয় না কারও?
ঝিনাইদহ পৌরসভার মেয়র সাইদুল করিম মিন্টু বলেন, দীর্ঘ ৩৫ বছর পর জাহেদা তার বাবার বাড়ি ফিরে আসায় তিনি খুব খুশি হয়েছেন। তাকে ফিরিয়ে আনতে যারা কাজ কাজ করেছেন, তাদের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। একইসঙ্গে পাচারের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেন তিনি।