ঢাকা ০৫:১৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পালাবি কোথায়?

Reporter Name

লোকে বলে আমি নাকি রাজধানী। বাংলাদেশের সব শহরের রাজা। আমার বয়স ৪০০ বছর হলো। দুনিয়া খ্যাত শহর মেলবোর্ন, সিডনি, অটোয়া, নিউইয়র্কের  চেয়েও আমি পুরোনো। তবু তো আমার সম্মান নেই, সুখে নেই আমি। কারণ, সুখে নেই আমার বুকে থাকা প্রজারা। সবাই তো আমায় দোষে। বলে, ‘এ শহর অসহ্য’। ‘এ শহর বসবাসের অযোগ্য’। শুনেছি, ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) বার্ষিক জরিপে বসবাসের অযোগ্য দ্বিতীয় শহর হিসেবে আমার নাম এসেছে। তা নিয়ে কত বিশেষজ্ঞ, বুদ্ধিমান লোক কত কথা লিখছেন। কিন্তু শোনো, আমি কি শুরু থেকেই এমন ছিলাম? আমার এই অবস্থার জন্য কি আমি দায়ী?

আজ থেকে কত বছর আগের কথা। তখন তো আমার বুকে কত সবুজ গাছ ছিল। তোমরাই তো গাছগুলো কাটলে। রাস্তা চওড়া করলে। রাস্তা চওড়া আর বড় করা তো আজও শেষ হলো না। আজ মগবাজারে খোঁড়ো তো কাল মালিবাগে। আজ গ্রিন রোডে পিচ ঢালো তো কাল খিলগাঁওয়ে। এই যে এত খোঁড়াখুঁড়ি, এতে আমার কষ্ট হয় না, বলো? তোমাদেরও তো কত কষ্ট। আজ রিকশা উল্টে পড়ল তো কাল গাড়ির চাকা আটকাল। ওদিকে জুরাইনের মতো জায়গা তো সারা বছর নর্দমা উপচানো কালো পিচের মতো দুর্গন্ধ-নোংরায় সয়লাব। কিন্তু আমি কীই-বা করতে পারি, বলো? শুধু নীরবে সহ্য করা ছাড়া।

বর্ষাকাল এলে তোমরা আমাকে কতই গালিগালাজ করো। আমার বড় লজ্জা করে। আমি যেন তখন নদীর মতো হয়ে যাই। কুলকুল করে বয়ে চলি। এমনকি আমার রাস্তায় যেখানে দাপিয়ে বেড়ায় ট্রাক আর বাস, দামি প্রাইভেট গাড়ি চলে, ভাবতে পারো, সেই রাস্তায় কিনা নৌকা চলে। পানিতে কত ময়লা ভাসে। সে ময়লা কারা ফেলে, বলো? ঘিনঘিন লাগে না? কিন্তু কে আমায় উদ্ধার করবে? ওয়াসা বলে, কাজটা নাকি সিটি করপোরেশনের। সিটি করপোরেশন বলে ওয়াসার। তাদের ধাক্কাধাক্কিতে আমি কেবল পিং পং বলের মতো লাফিয়ে বেড়াই।

শুধু কি বর্ষা? আমি বড় নোংরা শহর। তোমরাই তো যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলো। উড়ালসেতু আর আন্ডারপাসগুলো নোংরা করো। ফুটপাত যেন তোমাদের গণশৌচাগার। মাঝে মাঝে বড় বমি পায় আমার। নিজের মনে করলে কি আর এমন করতে পারতে।

আমারও তো ইচ্ছে করে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার মতো বা অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের মতো বসবাসযোগ্য শহর হতে। ভিয়েনা নাকি এবার বসবাসযোগ্য শহরের এক নম্বরে। আমার কি আর সে সৌভাগ্য হবে কোনোকালে? হয়তো হতো, যদি ভিয়েনাবাসীর মতো হতে তোমরা। মানে ঢাকাবাসী। যদি ভিয়েনার প্রশাসনের মতো হতো ঢাকার প্রশাসন।

এত দুঃখের মধ্যেও মাঝে মাঝে আশা জাগে, জানো? মাঝে মাঝে মনে হয় সম্ভব। বেশি দিন আগের কথা নয়। এই তো কিছুদিন আগে। খুদে খুদে ছেলেমেয়ে কী কাণ্ডই করল, বলো?

আমার বুকে কত উড়ালসড়ক, আন্ডারপাস, উড়ালসেতু। কত সড়ক বিভাজক। তবু মানুষ হুড়মুড় করে রাস্তা পার হয়। কত সিগন্যাল বাতি বলো মোড়ে মোড়ে। তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে ট্রাফিক পুলিশ। বাঁশিতে ফুঁ দেয়, দড়ি দিয়ে আটকে রাখে। তবু কত গাড়ি উল্টো পথে চলে, বলো? আর মুড়ির টিনের মতো বাসগুলো আমার বুকের ওপর দিয়ে গড়গড়িয়ে চলে। ইচ্ছে হলে ধুপধাপ থামিয়ে দেয়। মানুষগুলো দৌড়ে দৌড়ে ওঠে। দোষ হয় আমার। সবাই বলে, ঢাকা গেলে কত-কী হয়। তবু কি কখনো টুঁ শব্দ করেছি। মুখ বুজে সব সয়ে গেছি।

মাঝে মাঝে দুই বাসের যে কী পাল্লাপাল্লি হয়। এ ওর আগে যাবে। ও এর আগে যাবে। জানালায় জানালায় ঘষা খেয়ে ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে কাচ। কত বলি, ‘ওরে, থাম থাম। সাবধান। মানুষগুলোর প্রাণ যে তোদের হাতে।’ কে শোনে আমার কথা? কত প্রাণ যায়। কত রক্ত ঝরে আমার বুকে। কত চোখের জলে ভিজি আমি। কী করব, বলো। সবই সয়ে নিতে হয়।

যা বলছিলাম, এত বছরে কখনো দেখিনি এমন কাণ্ড। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে স্কুলড্রেস পরা। পিঠে ব্যাগ। বন্ধুরা দল বেঁধে দিব্যি বাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশার চালকগুলোকে সোজা করে দিল। তাদের হাতের ইশারায় সব গাড়ি কেমন নিয়ম মেনে চলতে শুরু করল। অবাক কাণ্ড। নিয়ম না-মানা মানুষগুলোও কেমন খুশি। খুদেদের পাশে দাঁড়াল সবাই। আমি তো আনন্দে বাঁচি না। এবার বুঝি যানজটের আর দুর্ঘটনার বদনাম থেকে রেহাই পাব। কিন্তু হায়, খুদেরা চলে যাওয়ার পর আবার সেই আগের চেহারা। বদনাম বুঝি আর কখনো ঘুচবে না আমার।

আমিইবা কী করি, বলো? তোমরা যে ঝাঁকে ঝাঁকে আসো আমার কাছে। ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে ভালো বিশ্ববিদ্যালয় বা স্কুলটা যে আমার কাছেই। পড়াশোনা শেষে চাকরি করবে। সব চাকরি তো আমার বুকেই। গ্রাম থেকে গরিব লোকগুলোও আসে। কত কষ্ট করে বস্তিতে থাকে। গ্রামে কাজ পায় না। আমার এখানেই যত কাজের জোগান। এই এত মানুষকে আমি কোথায় জায়গা দিই, বলো তো? দুই কোটির বেশি লোককে তো ধারণ করেছি আমি। আর কত পারি, বলো?

কেউ কেন কিছু ভাবে না? সব কাজ, সব চাকরি, সব ভালো প্রতিষ্ঠান কেন শুধু আমার বুকেই। তোমাদের যদি কাজের তাগিদে আমার কাছে না আসতে হতো, কত ভালোই না হতো। তোমরা যদি একটু পরিকল্পনা করতে এসব নিয়ে। একটু জোরেশোরে দাবি জানাতে। সরকার আর প্রশাসন যদি আরেকটু ভাবত।

এবার বলো তো, দায় কি আমার? তোমরাই তো থাকো আমার বুকে। তোমরা আমায় যেমন রাখো, আমিও তেমন থাকি। তোমরাই বলো ঢাকা ছেড়ে পালাতে চাই। আমারও ইচ্ছে করে একটু রেহাই পেতে। কিন্তু উপায় নেই। অসহায় আমি কোথায় পালাই, বলো তো?

About Author Information
আপডেট সময় : ০৫:৩৭:৪৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৮ অগাস্ট ২০১৮
১১৭৩ Time View

পালাবি কোথায়?

আপডেট সময় : ০৫:৩৭:৪৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৮ অগাস্ট ২০১৮

লোকে বলে আমি নাকি রাজধানী। বাংলাদেশের সব শহরের রাজা। আমার বয়স ৪০০ বছর হলো। দুনিয়া খ্যাত শহর মেলবোর্ন, সিডনি, অটোয়া, নিউইয়র্কের  চেয়েও আমি পুরোনো। তবু তো আমার সম্মান নেই, সুখে নেই আমি। কারণ, সুখে নেই আমার বুকে থাকা প্রজারা। সবাই তো আমায় দোষে। বলে, ‘এ শহর অসহ্য’। ‘এ শহর বসবাসের অযোগ্য’। শুনেছি, ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) বার্ষিক জরিপে বসবাসের অযোগ্য দ্বিতীয় শহর হিসেবে আমার নাম এসেছে। তা নিয়ে কত বিশেষজ্ঞ, বুদ্ধিমান লোক কত কথা লিখছেন। কিন্তু শোনো, আমি কি শুরু থেকেই এমন ছিলাম? আমার এই অবস্থার জন্য কি আমি দায়ী?

আজ থেকে কত বছর আগের কথা। তখন তো আমার বুকে কত সবুজ গাছ ছিল। তোমরাই তো গাছগুলো কাটলে। রাস্তা চওড়া করলে। রাস্তা চওড়া আর বড় করা তো আজও শেষ হলো না। আজ মগবাজারে খোঁড়ো তো কাল মালিবাগে। আজ গ্রিন রোডে পিচ ঢালো তো কাল খিলগাঁওয়ে। এই যে এত খোঁড়াখুঁড়ি, এতে আমার কষ্ট হয় না, বলো? তোমাদেরও তো কত কষ্ট। আজ রিকশা উল্টে পড়ল তো কাল গাড়ির চাকা আটকাল। ওদিকে জুরাইনের মতো জায়গা তো সারা বছর নর্দমা উপচানো কালো পিচের মতো দুর্গন্ধ-নোংরায় সয়লাব। কিন্তু আমি কীই-বা করতে পারি, বলো? শুধু নীরবে সহ্য করা ছাড়া।

বর্ষাকাল এলে তোমরা আমাকে কতই গালিগালাজ করো। আমার বড় লজ্জা করে। আমি যেন তখন নদীর মতো হয়ে যাই। কুলকুল করে বয়ে চলি। এমনকি আমার রাস্তায় যেখানে দাপিয়ে বেড়ায় ট্রাক আর বাস, দামি প্রাইভেট গাড়ি চলে, ভাবতে পারো, সেই রাস্তায় কিনা নৌকা চলে। পানিতে কত ময়লা ভাসে। সে ময়লা কারা ফেলে, বলো? ঘিনঘিন লাগে না? কিন্তু কে আমায় উদ্ধার করবে? ওয়াসা বলে, কাজটা নাকি সিটি করপোরেশনের। সিটি করপোরেশন বলে ওয়াসার। তাদের ধাক্কাধাক্কিতে আমি কেবল পিং পং বলের মতো লাফিয়ে বেড়াই।

শুধু কি বর্ষা? আমি বড় নোংরা শহর। তোমরাই তো যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলো। উড়ালসেতু আর আন্ডারপাসগুলো নোংরা করো। ফুটপাত যেন তোমাদের গণশৌচাগার। মাঝে মাঝে বড় বমি পায় আমার। নিজের মনে করলে কি আর এমন করতে পারতে।

আমারও তো ইচ্ছে করে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার মতো বা অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের মতো বসবাসযোগ্য শহর হতে। ভিয়েনা নাকি এবার বসবাসযোগ্য শহরের এক নম্বরে। আমার কি আর সে সৌভাগ্য হবে কোনোকালে? হয়তো হতো, যদি ভিয়েনাবাসীর মতো হতে তোমরা। মানে ঢাকাবাসী। যদি ভিয়েনার প্রশাসনের মতো হতো ঢাকার প্রশাসন।

এত দুঃখের মধ্যেও মাঝে মাঝে আশা জাগে, জানো? মাঝে মাঝে মনে হয় সম্ভব। বেশি দিন আগের কথা নয়। এই তো কিছুদিন আগে। খুদে খুদে ছেলেমেয়ে কী কাণ্ডই করল, বলো?

আমার বুকে কত উড়ালসড়ক, আন্ডারপাস, উড়ালসেতু। কত সড়ক বিভাজক। তবু মানুষ হুড়মুড় করে রাস্তা পার হয়। কত সিগন্যাল বাতি বলো মোড়ে মোড়ে। তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে ট্রাফিক পুলিশ। বাঁশিতে ফুঁ দেয়, দড়ি দিয়ে আটকে রাখে। তবু কত গাড়ি উল্টো পথে চলে, বলো? আর মুড়ির টিনের মতো বাসগুলো আমার বুকের ওপর দিয়ে গড়গড়িয়ে চলে। ইচ্ছে হলে ধুপধাপ থামিয়ে দেয়। মানুষগুলো দৌড়ে দৌড়ে ওঠে। দোষ হয় আমার। সবাই বলে, ঢাকা গেলে কত-কী হয়। তবু কি কখনো টুঁ শব্দ করেছি। মুখ বুজে সব সয়ে গেছি।

মাঝে মাঝে দুই বাসের যে কী পাল্লাপাল্লি হয়। এ ওর আগে যাবে। ও এর আগে যাবে। জানালায় জানালায় ঘষা খেয়ে ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে কাচ। কত বলি, ‘ওরে, থাম থাম। সাবধান। মানুষগুলোর প্রাণ যে তোদের হাতে।’ কে শোনে আমার কথা? কত প্রাণ যায়। কত রক্ত ঝরে আমার বুকে। কত চোখের জলে ভিজি আমি। কী করব, বলো। সবই সয়ে নিতে হয়।

যা বলছিলাম, এত বছরে কখনো দেখিনি এমন কাণ্ড। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে স্কুলড্রেস পরা। পিঠে ব্যাগ। বন্ধুরা দল বেঁধে দিব্যি বাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশার চালকগুলোকে সোজা করে দিল। তাদের হাতের ইশারায় সব গাড়ি কেমন নিয়ম মেনে চলতে শুরু করল। অবাক কাণ্ড। নিয়ম না-মানা মানুষগুলোও কেমন খুশি। খুদেদের পাশে দাঁড়াল সবাই। আমি তো আনন্দে বাঁচি না। এবার বুঝি যানজটের আর দুর্ঘটনার বদনাম থেকে রেহাই পাব। কিন্তু হায়, খুদেরা চলে যাওয়ার পর আবার সেই আগের চেহারা। বদনাম বুঝি আর কখনো ঘুচবে না আমার।

আমিইবা কী করি, বলো? তোমরা যে ঝাঁকে ঝাঁকে আসো আমার কাছে। ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে ভালো বিশ্ববিদ্যালয় বা স্কুলটা যে আমার কাছেই। পড়াশোনা শেষে চাকরি করবে। সব চাকরি তো আমার বুকেই। গ্রাম থেকে গরিব লোকগুলোও আসে। কত কষ্ট করে বস্তিতে থাকে। গ্রামে কাজ পায় না। আমার এখানেই যত কাজের জোগান। এই এত মানুষকে আমি কোথায় জায়গা দিই, বলো তো? দুই কোটির বেশি লোককে তো ধারণ করেছি আমি। আর কত পারি, বলো?

কেউ কেন কিছু ভাবে না? সব কাজ, সব চাকরি, সব ভালো প্রতিষ্ঠান কেন শুধু আমার বুকেই। তোমাদের যদি কাজের তাগিদে আমার কাছে না আসতে হতো, কত ভালোই না হতো। তোমরা যদি একটু পরিকল্পনা করতে এসব নিয়ে। একটু জোরেশোরে দাবি জানাতে। সরকার আর প্রশাসন যদি আরেকটু ভাবত।

এবার বলো তো, দায় কি আমার? তোমরাই তো থাকো আমার বুকে। তোমরা আমায় যেমন রাখো, আমিও তেমন থাকি। তোমরাই বলো ঢাকা ছেড়ে পালাতে চাই। আমারও ইচ্ছে করে একটু রেহাই পেতে। কিন্তু উপায় নেই। অসহায় আমি কোথায় পালাই, বলো তো?