ঢাকা ০৪:২৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পূণ্যেভরা যিলহাজের প্রথম দশক

Reporter Name

ফারুক নোমানীঃ

হিজরী সনের শেষ মাসটির নাম যিলহাজ। যার অর্থ হলো হজের মাস। এ মাসেই ইসলামের অন্যতম বিধান হজের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম সংঘটিত হয়। সাথে সাথে যারা হজে যেতে পারেনি, এমন সচ্ছল ব্যক্তির ওপর কুরবানীর বিধানটিও এই মাসেই। আবার কুরআনে মহান আল্লাহ যিলহাজ মাসের প্রথম দশকের শপথও করেছেন। আল্লাহর কাছে চারটি সম্মানিত মাসের একটি মাস হলো যিলহাজ। রমযানের পর ইবাদতের বড় একটি মৌসুম হলো যিলহজের প্রথম দশক। তাই প্রতিটি মুমিনের উচিৎ এই পূণ্যেভরা সময়কে মূল্যায়ন করা। অধিক পরিমাণে ইবদত করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা।

চারটি সম্মানিত মাস সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন-‘আল্লাহ যেদিন আসমান জমিন সৃষ্টি করেছেন সেইদিন থেকেই মাসসমূহের গণনা আল্লাহ তাআলার নিকট তাঁর বিধান মতে বারটি। তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত।’ (সুরা তাওবা ৩৬)

এই চারটি মাসের অন্যতম হল যিলহাজ মাস। আর এ মাসের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ও ফযিলতপূর্ণ সময় হল ‘আশারায়ে যিলহাজ’ অর্থাৎ যিলহাজ মাসের প্রথম দশক।

যিলহাজ মাসের প্রথম দশকের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা আল্লাহ তাআলা এই দশকের রাত্রীর শপথ করেছেন কুরআনুল কারীমে। আল্লাহ বলেছেন-‘শপথ ভোরবেলার, শপথ দশ রাত্রির।’ (সূরা ফাজর ১-২)

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. ও মুজাহিদ রাহ.সহ অনেক সাহাবী, তাবেঈ ও মুফাসসির বলেন, এখানে ‘দশ রাত্রি’ দ্বারা যিলহাজের প্রথম দশ রাতকেই বুঝানো হয়েছে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর ৪/৫৩৫)

এই দশ দিনের নেক আমল আল্লাহ তাআলার নিকট সবচেয়ে প্রিয়। এ সম্পর্কে হযরত ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন-‘আল্লাহর নিকট যিলহাজের দশ দিনের নেক আমলের চেয়ে অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও (এর চেয়ে উত্তম) নয়? তিনি বললেন, না, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়। তবে হাঁ, সেই ব্যক্তির জিহাদের চেয়ে উত্তম যে নিজের জান-মাল নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য বের হয়েছে। অতপর কোনো কিছু নিয়ে ঘরে ফিরে আসেনি।’ (সুনানে আবু দাউদ২৪৩৮; সহীহ বুখারী ৯৬৯; জামে তিরমিযী ৭৫৭; সুনানে ইবনে মাজাহ ১৭২৭; মুসনাদে আহমদ ১৯৬৮)

আরেকটি হাদীসে এসেছে, হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন- ‘দুনিয়ার সর্বোত্তম দিনগুলো হল, যিলহাজের দশদিন। জিজ্ঞাসা করা হল, আল্লাহর রাস্তায়ও কি তার সমতুল্য নেই? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায়ও তার সমতুল্য নেই। তবে ঐ ব্যক্তি যার চেহারা ধুলিযুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ শাহাদাত বরণ করেছে।’ (মুসনাদে বাযযার ১১২৮; মুসনাদে আবু ইয়ালা ২০১০; মাজমাউল যাওয়াইদ ৪/৮)

এসব হাদীসের কারণেই যিলহাজের প্রথম দশকের আমলকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই দশকের মধ্যে বেশ কয়েকটি আমল রয়েছে।

১. নখ-চুল না কাটা:
উম্মে সালামা রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সা. বলেছেন- ‘যখন যিলহাজের দশক শুরু হবে তখন তোমাদের মধ্যে যে কুরবানী করবে সে যেন তার চুল নখ না কাটে।’ (সহীহ মুসলিম ১৯৭৭; জামে তিরমিযী ১৫২৩)

এই হাদীসের উপর ভিত্তি করে ফকীহগণ কুরবানীকারীর জন্য নখ-চুল না কাটাকে মুস্তাহাব বলেছেন। তবে এ হুকুম তাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে যারা যিলকদের শেষে নখ-চুল কেটেছে। অন্যথায় নখ-চুল বেশি লম্বা হয়ে যাবে। যা সুন্নাতের খেলাফ। এ আমলটি যারা কুরবানী করবেন তাদের জন্য সুন্নাত। আবার কুরবানী যারা করবে না তাদের জন্যও। এ সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবন আমর রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সা. বলেছেন- ‘আমাকে কুরবানীর দিনে ঈদ (পালনের) আদেশ করা হয়েছে। যা আল্লাহ এ উম্মতের জন্য নির্ধারণ করেছেন। এক সাহাবী আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি আমার কাছে শুধু একটি মানিহা থাকে (অর্থাৎ অন্যের থেকে নেওয়া দুগ্ধ দানকারী উটনী) আমি কি তা কুরবানী করতে পারি? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, তবে তুমি চুল, নখ ও মোঁচ কাটবে এবং নাভীর নিচের পশম পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর দরবারে তোমার পূর্ণ কুরবানী বলে গণ্য হবে।’ (সুনানে আবু দাউদ ২৭৮৯; সুনানে নাসায়ী ৪৩৬৫)

এসব দলীলের কারণে সকলের জন্যই যিলহজ্বের প্রথম দশকে নখ, গোফ ও চুল না-কাটা উত্তম। এবং এটি হাজীদের ইহরামের সাথে সাদৃশ্য পূর্ণ। কারণ ইহরাম বেঁধে চুল নখ ইত্যাটি কাটা যায় না।

২. যিলহজ্বের প্রথম দশদিন বেশি বেশি ইবাদত ও যিকর করা:
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন- ‘আল্লাহ তাআলার নিকট আশারায়ে যিলহাজের আমলের চেয়ে অধিক মহৎ এবং অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। সুতরাং তোমরা এই দিনগুলোতে বেশি বেশি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার এবং আলহামদু লিল্লাহ পড়।’
(মুসনাদে আহমদ ২/৫৭, হাদীস ৫৪৪৬; তবারানী কাবীর ১১/৬৮ হাদীস, ১১১১৬; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১৪১১০)

৩. যিলহজের প্রথম নয় দিন রোযা রাখা:
নবীজী সা. যিলহাজের এই নয়টি দিবসে রোযা রাখতেন। (সুনানে আবু দাউদ ২৪৩৭; মুসনাদে আহমদ ২২২৩৪; সুনানে নাসাঈ ২৪১৬)

৪. নয় যিলহাজ রোযা রাখা মুস্তাহাব:
স্বাভাবিকভাবে যদি কেউ যিলহাজের প্রথম আটদিন রোযা রাখতে না পারে, তাহলে অন্তত নয় তারিখের রোযা যেন বাদ না দেয়। গুরুত্বপূর্ণ এই রোযা সম্পর্কে আবু কাতাদা রা. বলেন, নবীজী সা. বলেছেন- ‘ইয়াওমে আরাফার (নয় যিলহাজ) রোযার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী, তিনি এর দ্বারা এর আগের এক বছরের এবং পরের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দিবেন।’ (সহীহ মুসলিম ১১৬২; জামে তিরমিযী ৭৪৯; সুনানে আবু দাউদ ২৪২৫)

এখানে একটি বিষয় মনে রাখেতে হবে যে, উক্ত হাদীসে বর্ণিত ইয়াওমে আরাফা দ্বারা যিলহাজের নয় তারিখ উদ্দেশ্য। এই তারিখের পারিভাষিক নাম হচ্ছে ইয়াওমে আরাফা। কেননা এই রোযা আরাফার ময়দানের আমল নয় বরং আরাফার দিন তো হাজীদের জন্য রোযা না রাখাই মুস্তাহাব।

আরাফার দিন আল্লাহর রাসূল রোযা রাখেননি। একারণে ফিকহবিদগণ হাজীদের জন্য আরাফার দিন রোযা না রাখা উত্তম বলেছেন। আবু কাতাদা রা. -এর উক্ত হাদীস দ্বারা ইয়াওমে আরাফায় রোযা রাখা মুস্তাহাব প্রমাণিত হয়। সুতরাং বুঝা গেল আবু কাতাদাহ রা.-এর হাদীসে ‘ইয়াওমে আরাফা’ দ্বারা নয় যিলহজ্ব অর্থাৎ ঈদের আগের দিনই উদ্দেশ্য। সুতরাং আমাদের দেশের চাঁদের হিসেবে যেদিন নয় তারিখ হয় সে দিনই ইয়াওমে আরাফা হিসেবে রোযা রাখা মুস্তাহাব হবে। সৌদীর হিসাবে আরাফার দিন অনুযায়ী নয়। উল্লেখ্য তাকবীরে তাশরীক সংক্রান্ত নিন্মোক্ত হাদীসেও ইয়াওমে আরাফা দ্বারা নয় যিলহাজই উদ্দেশ্য। কেননা এ আমল ও আরাফার সাথে নির্দিষ্ট কোনো আমল নয়।

৫. তাকবীরে তাশরীক পড়া:
নয় যিলহাজ হতে তের যিলহাজ আছর পর্যন্ত মোট তেইশ ওয়াক্তের নামাযের পর একবার করে তাকবীরে তাশরীক বলা ওয়াজিব। জামাতে নামায পড়া হোক বা একাকি, পুরুষ বা নারী, মুকীম বা মুসাফির সকলের উপর ওয়াজিব। তাকবীরে তাশরীক পুরুষের জন্য জোরে পড়া ওয়াজিব। আস্তে পড়লে তাকবীরে তাশরীক পড়ার হক আদায় হবে না। আর মহিলাগণ নি¤œ আওয়াজে অর্থাৎ নিজে শুনতে পায় এমন আওয়াজে পড়বে। (রদ্দুল মুহতার ২/১৭৮; এলাউস সুনান ৮/১৫২)

আল্লাহ তাআলা বলেছেন-‘আর তোমরা আল্লাহকে স্মরণ কর (আইয়ামে তাশরীকের) নির্দিষ্ট দিনগুলোতে।’ (সূরা বাকারা ২০৩)

একাধিক সাহাবা-তাবেয়ীন থেকে প্রমাণিত আছে যে, তারা নয় তারিখ আরাফার দিন ফজর থেকে তের তারিখ আসর পর্যন্ত তাকবীর পড়তেন। তন্মধ্যে হলেন, উমার ইবনুল খাত্তাব, আলী ইবনে আবি তালিব, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. যুহরী, মাকহুল, সুফিয়ান সাওরীসহ প্রমুখ সাহাবা-তাবেয়ীগণ।

তাকবীরে তাশরীকের জন্য বিভিন্ন শব্দ হাদীসে উল্লেখ হয়েছে। তন্মধ্যে সর্বোত্তম ও সর্বজনবিদিত পাঠ হল- ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’

(মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৫৬৯৬-৯৯; আল আওসাত, ইবনে মুনযির ৪/৩৪৯; এলাউস সুনান ৮/১৫৬; বাদায়েউস সানায়ে ১/৪৫৮)

৬. ঈদুল আযহার নামায:
হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. যখন হিজরত করে মদীনায় আসলেন তখন মদীনাবাসীর দুটি উৎসবের দিবস ছিল। রাসূলুল্লাহ সা. তাদের জিজ্ঞেস করলেন, এ দুটি দিবস কী? (কী হিসেবে তোমরা এ দু’দিন উৎসব পালন কর?) তারা বলল, জাহেলিয়াত তথা ইসলামপূর্ব যুগে আমরা এ দিনদুটিতে উৎসব পালন করতাম। তখন রাসূলুল্লাহ সা. বললেন-‘ আল্লাহ তোমাদেরকে এ দুটি দিনের পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম দুটি দিন দান করেছেন- ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর।’ (সুনানে আবু দাউদ ১১৩৪; সুনানে নাসায়ী ১৫৫৬; মুসনাদে আহমাদ ১২০০৬)

ঈদুল আযহার নামায প্রত্যেক সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন পুরুষের উপর ওয়াজিব। মেয়েদের উপর ওয়াজিব নয়। মেয়েরা ঈদের নামাযের জন্য ইদগাহে যাবে না। তেমনিভাবে নিজ গৃহে নিজেরা জামাত করেও পড়বে না।

নাফে রাহ. বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. তাঁর নারীদেরকে দুই ঈদে ঈদগাহে যেতে দিতেন না। (আল আওসাত ৪/৩০১)

উরওয়া তার পিতা (যুবাইর রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি নিজ পরিবারের নারীদেরকে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহাতে যেতে দিতেন না। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা ৫৮৪৬)

ইয়াহইয়া বিন সাঈদ আল আলআনসারী রাহ. (১৪৩ হি.) বলেন-‘আমাদের সময়ে দুই ঈদের জন্য যুবতী নারীদের বের হওয়ার প্রচলন ছিল না। (আল আওসাত ৪/৩০২; উমদাতুল কারী ৩/৩০৫)

ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. বলেন-‘উভয় ঈদে মহিলাদের (নামাযের জন্য) বাইরে যাওয়া মাকরূহ।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৪/২৩৪)

৭. কুরবানী করা:
ঈদের নামাযের পর কুরবানী করা ইসলামের বিধান। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন- ‘আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামায পড়–ন এবং কুরবানী করুন।’ (সূরা কাউসার ২)

কুরবানী সম্পর্কে নবীজী সা. ইরশাদ করেন- ‘কুরবানীর দিন আদম সন্তান এমন কোনও আমল করতে পারে না, যা আল্লাহ তাআলার কাছে রক্তপ্রবাহ অপেক্ষা বেশি প্রিয়। কিয়ামতের দিন কুরবানীর পশু তার শিং, তার ক্ষুর ও পশমসহ হাজির হবে। জবাইয়ের পর তার রক্ত মাটিতে পড়ার আগে আল্লাহ তা‘আলার কাছে কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা এর দ্বারা মনেপ্রাণে খুশি হয়ে যাও।’ (তিরমিযী ১৫৬৭, ইবনে মাজাহ ৩১২৬)

পাঠক, রমযানের পর বরকতময় এই ইবাদতের সিজনকে আমাদের মূল্যায়ন করা উচিৎ। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এ দশককে ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করা মুমিন বান্দার ঈমানের দাবী। তাই প্রস্তুত হোন, নিজেকে তৈরি করুন- পূণ্যেভরা যিলহাজের প্রথম দশককে ইবাদতের মাধ্যমে স্বাগত জানাতে।

লেখক: ইমাম, মেইন বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদ, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।
মুহাদ্দিস, বলিদাপাড়া মাদরাসা, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।

About Author Information
আপডেট সময় : ১০:২৪:২৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২০ জুলাই ২০২০
৬০৫ Time View

পূণ্যেভরা যিলহাজের প্রথম দশক

আপডেট সময় : ১০:২৪:২৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২০ জুলাই ২০২০

ফারুক নোমানীঃ

হিজরী সনের শেষ মাসটির নাম যিলহাজ। যার অর্থ হলো হজের মাস। এ মাসেই ইসলামের অন্যতম বিধান হজের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম সংঘটিত হয়। সাথে সাথে যারা হজে যেতে পারেনি, এমন সচ্ছল ব্যক্তির ওপর কুরবানীর বিধানটিও এই মাসেই। আবার কুরআনে মহান আল্লাহ যিলহাজ মাসের প্রথম দশকের শপথও করেছেন। আল্লাহর কাছে চারটি সম্মানিত মাসের একটি মাস হলো যিলহাজ। রমযানের পর ইবাদতের বড় একটি মৌসুম হলো যিলহজের প্রথম দশক। তাই প্রতিটি মুমিনের উচিৎ এই পূণ্যেভরা সময়কে মূল্যায়ন করা। অধিক পরিমাণে ইবদত করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা।

চারটি সম্মানিত মাস সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন-‘আল্লাহ যেদিন আসমান জমিন সৃষ্টি করেছেন সেইদিন থেকেই মাসসমূহের গণনা আল্লাহ তাআলার নিকট তাঁর বিধান মতে বারটি। তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত।’ (সুরা তাওবা ৩৬)

এই চারটি মাসের অন্যতম হল যিলহাজ মাস। আর এ মাসের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ও ফযিলতপূর্ণ সময় হল ‘আশারায়ে যিলহাজ’ অর্থাৎ যিলহাজ মাসের প্রথম দশক।

যিলহাজ মাসের প্রথম দশকের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা আল্লাহ তাআলা এই দশকের রাত্রীর শপথ করেছেন কুরআনুল কারীমে। আল্লাহ বলেছেন-‘শপথ ভোরবেলার, শপথ দশ রাত্রির।’ (সূরা ফাজর ১-২)

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. ও মুজাহিদ রাহ.সহ অনেক সাহাবী, তাবেঈ ও মুফাসসির বলেন, এখানে ‘দশ রাত্রি’ দ্বারা যিলহাজের প্রথম দশ রাতকেই বুঝানো হয়েছে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর ৪/৫৩৫)

এই দশ দিনের নেক আমল আল্লাহ তাআলার নিকট সবচেয়ে প্রিয়। এ সম্পর্কে হযরত ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন-‘আল্লাহর নিকট যিলহাজের দশ দিনের নেক আমলের চেয়ে অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও (এর চেয়ে উত্তম) নয়? তিনি বললেন, না, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়। তবে হাঁ, সেই ব্যক্তির জিহাদের চেয়ে উত্তম যে নিজের জান-মাল নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য বের হয়েছে। অতপর কোনো কিছু নিয়ে ঘরে ফিরে আসেনি।’ (সুনানে আবু দাউদ২৪৩৮; সহীহ বুখারী ৯৬৯; জামে তিরমিযী ৭৫৭; সুনানে ইবনে মাজাহ ১৭২৭; মুসনাদে আহমদ ১৯৬৮)

আরেকটি হাদীসে এসেছে, হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন- ‘দুনিয়ার সর্বোত্তম দিনগুলো হল, যিলহাজের দশদিন। জিজ্ঞাসা করা হল, আল্লাহর রাস্তায়ও কি তার সমতুল্য নেই? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায়ও তার সমতুল্য নেই। তবে ঐ ব্যক্তি যার চেহারা ধুলিযুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ শাহাদাত বরণ করেছে।’ (মুসনাদে বাযযার ১১২৮; মুসনাদে আবু ইয়ালা ২০১০; মাজমাউল যাওয়াইদ ৪/৮)

এসব হাদীসের কারণেই যিলহাজের প্রথম দশকের আমলকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই দশকের মধ্যে বেশ কয়েকটি আমল রয়েছে।

১. নখ-চুল না কাটা:
উম্মে সালামা রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সা. বলেছেন- ‘যখন যিলহাজের দশক শুরু হবে তখন তোমাদের মধ্যে যে কুরবানী করবে সে যেন তার চুল নখ না কাটে।’ (সহীহ মুসলিম ১৯৭৭; জামে তিরমিযী ১৫২৩)

এই হাদীসের উপর ভিত্তি করে ফকীহগণ কুরবানীকারীর জন্য নখ-চুল না কাটাকে মুস্তাহাব বলেছেন। তবে এ হুকুম তাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে যারা যিলকদের শেষে নখ-চুল কেটেছে। অন্যথায় নখ-চুল বেশি লম্বা হয়ে যাবে। যা সুন্নাতের খেলাফ। এ আমলটি যারা কুরবানী করবেন তাদের জন্য সুন্নাত। আবার কুরবানী যারা করবে না তাদের জন্যও। এ সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবন আমর রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সা. বলেছেন- ‘আমাকে কুরবানীর দিনে ঈদ (পালনের) আদেশ করা হয়েছে। যা আল্লাহ এ উম্মতের জন্য নির্ধারণ করেছেন। এক সাহাবী আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি আমার কাছে শুধু একটি মানিহা থাকে (অর্থাৎ অন্যের থেকে নেওয়া দুগ্ধ দানকারী উটনী) আমি কি তা কুরবানী করতে পারি? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, তবে তুমি চুল, নখ ও মোঁচ কাটবে এবং নাভীর নিচের পশম পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর দরবারে তোমার পূর্ণ কুরবানী বলে গণ্য হবে।’ (সুনানে আবু দাউদ ২৭৮৯; সুনানে নাসায়ী ৪৩৬৫)

এসব দলীলের কারণে সকলের জন্যই যিলহজ্বের প্রথম দশকে নখ, গোফ ও চুল না-কাটা উত্তম। এবং এটি হাজীদের ইহরামের সাথে সাদৃশ্য পূর্ণ। কারণ ইহরাম বেঁধে চুল নখ ইত্যাটি কাটা যায় না।

২. যিলহজ্বের প্রথম দশদিন বেশি বেশি ইবাদত ও যিকর করা:
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন- ‘আল্লাহ তাআলার নিকট আশারায়ে যিলহাজের আমলের চেয়ে অধিক মহৎ এবং অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। সুতরাং তোমরা এই দিনগুলোতে বেশি বেশি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার এবং আলহামদু লিল্লাহ পড়।’
(মুসনাদে আহমদ ২/৫৭, হাদীস ৫৪৪৬; তবারানী কাবীর ১১/৬৮ হাদীস, ১১১১৬; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১৪১১০)

৩. যিলহজের প্রথম নয় দিন রোযা রাখা:
নবীজী সা. যিলহাজের এই নয়টি দিবসে রোযা রাখতেন। (সুনানে আবু দাউদ ২৪৩৭; মুসনাদে আহমদ ২২২৩৪; সুনানে নাসাঈ ২৪১৬)

৪. নয় যিলহাজ রোযা রাখা মুস্তাহাব:
স্বাভাবিকভাবে যদি কেউ যিলহাজের প্রথম আটদিন রোযা রাখতে না পারে, তাহলে অন্তত নয় তারিখের রোযা যেন বাদ না দেয়। গুরুত্বপূর্ণ এই রোযা সম্পর্কে আবু কাতাদা রা. বলেন, নবীজী সা. বলেছেন- ‘ইয়াওমে আরাফার (নয় যিলহাজ) রোযার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী, তিনি এর দ্বারা এর আগের এক বছরের এবং পরের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দিবেন।’ (সহীহ মুসলিম ১১৬২; জামে তিরমিযী ৭৪৯; সুনানে আবু দাউদ ২৪২৫)

এখানে একটি বিষয় মনে রাখেতে হবে যে, উক্ত হাদীসে বর্ণিত ইয়াওমে আরাফা দ্বারা যিলহাজের নয় তারিখ উদ্দেশ্য। এই তারিখের পারিভাষিক নাম হচ্ছে ইয়াওমে আরাফা। কেননা এই রোযা আরাফার ময়দানের আমল নয় বরং আরাফার দিন তো হাজীদের জন্য রোযা না রাখাই মুস্তাহাব।

আরাফার দিন আল্লাহর রাসূল রোযা রাখেননি। একারণে ফিকহবিদগণ হাজীদের জন্য আরাফার দিন রোযা না রাখা উত্তম বলেছেন। আবু কাতাদা রা. -এর উক্ত হাদীস দ্বারা ইয়াওমে আরাফায় রোযা রাখা মুস্তাহাব প্রমাণিত হয়। সুতরাং বুঝা গেল আবু কাতাদাহ রা.-এর হাদীসে ‘ইয়াওমে আরাফা’ দ্বারা নয় যিলহজ্ব অর্থাৎ ঈদের আগের দিনই উদ্দেশ্য। সুতরাং আমাদের দেশের চাঁদের হিসেবে যেদিন নয় তারিখ হয় সে দিনই ইয়াওমে আরাফা হিসেবে রোযা রাখা মুস্তাহাব হবে। সৌদীর হিসাবে আরাফার দিন অনুযায়ী নয়। উল্লেখ্য তাকবীরে তাশরীক সংক্রান্ত নিন্মোক্ত হাদীসেও ইয়াওমে আরাফা দ্বারা নয় যিলহাজই উদ্দেশ্য। কেননা এ আমল ও আরাফার সাথে নির্দিষ্ট কোনো আমল নয়।

৫. তাকবীরে তাশরীক পড়া:
নয় যিলহাজ হতে তের যিলহাজ আছর পর্যন্ত মোট তেইশ ওয়াক্তের নামাযের পর একবার করে তাকবীরে তাশরীক বলা ওয়াজিব। জামাতে নামায পড়া হোক বা একাকি, পুরুষ বা নারী, মুকীম বা মুসাফির সকলের উপর ওয়াজিব। তাকবীরে তাশরীক পুরুষের জন্য জোরে পড়া ওয়াজিব। আস্তে পড়লে তাকবীরে তাশরীক পড়ার হক আদায় হবে না। আর মহিলাগণ নি¤œ আওয়াজে অর্থাৎ নিজে শুনতে পায় এমন আওয়াজে পড়বে। (রদ্দুল মুহতার ২/১৭৮; এলাউস সুনান ৮/১৫২)

আল্লাহ তাআলা বলেছেন-‘আর তোমরা আল্লাহকে স্মরণ কর (আইয়ামে তাশরীকের) নির্দিষ্ট দিনগুলোতে।’ (সূরা বাকারা ২০৩)

একাধিক সাহাবা-তাবেয়ীন থেকে প্রমাণিত আছে যে, তারা নয় তারিখ আরাফার দিন ফজর থেকে তের তারিখ আসর পর্যন্ত তাকবীর পড়তেন। তন্মধ্যে হলেন, উমার ইবনুল খাত্তাব, আলী ইবনে আবি তালিব, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. যুহরী, মাকহুল, সুফিয়ান সাওরীসহ প্রমুখ সাহাবা-তাবেয়ীগণ।

তাকবীরে তাশরীকের জন্য বিভিন্ন শব্দ হাদীসে উল্লেখ হয়েছে। তন্মধ্যে সর্বোত্তম ও সর্বজনবিদিত পাঠ হল- ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’

(মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৫৬৯৬-৯৯; আল আওসাত, ইবনে মুনযির ৪/৩৪৯; এলাউস সুনান ৮/১৫৬; বাদায়েউস সানায়ে ১/৪৫৮)

৬. ঈদুল আযহার নামায:
হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. যখন হিজরত করে মদীনায় আসলেন তখন মদীনাবাসীর দুটি উৎসবের দিবস ছিল। রাসূলুল্লাহ সা. তাদের জিজ্ঞেস করলেন, এ দুটি দিবস কী? (কী হিসেবে তোমরা এ দু’দিন উৎসব পালন কর?) তারা বলল, জাহেলিয়াত তথা ইসলামপূর্ব যুগে আমরা এ দিনদুটিতে উৎসব পালন করতাম। তখন রাসূলুল্লাহ সা. বললেন-‘ আল্লাহ তোমাদেরকে এ দুটি দিনের পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম দুটি দিন দান করেছেন- ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর।’ (সুনানে আবু দাউদ ১১৩৪; সুনানে নাসায়ী ১৫৫৬; মুসনাদে আহমাদ ১২০০৬)

ঈদুল আযহার নামায প্রত্যেক সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন পুরুষের উপর ওয়াজিব। মেয়েদের উপর ওয়াজিব নয়। মেয়েরা ঈদের নামাযের জন্য ইদগাহে যাবে না। তেমনিভাবে নিজ গৃহে নিজেরা জামাত করেও পড়বে না।

নাফে রাহ. বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. তাঁর নারীদেরকে দুই ঈদে ঈদগাহে যেতে দিতেন না। (আল আওসাত ৪/৩০১)

উরওয়া তার পিতা (যুবাইর রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি নিজ পরিবারের নারীদেরকে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহাতে যেতে দিতেন না। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা ৫৮৪৬)

ইয়াহইয়া বিন সাঈদ আল আলআনসারী রাহ. (১৪৩ হি.) বলেন-‘আমাদের সময়ে দুই ঈদের জন্য যুবতী নারীদের বের হওয়ার প্রচলন ছিল না। (আল আওসাত ৪/৩০২; উমদাতুল কারী ৩/৩০৫)

ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. বলেন-‘উভয় ঈদে মহিলাদের (নামাযের জন্য) বাইরে যাওয়া মাকরূহ।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৪/২৩৪)

৭. কুরবানী করা:
ঈদের নামাযের পর কুরবানী করা ইসলামের বিধান। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন- ‘আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামায পড়–ন এবং কুরবানী করুন।’ (সূরা কাউসার ২)

কুরবানী সম্পর্কে নবীজী সা. ইরশাদ করেন- ‘কুরবানীর দিন আদম সন্তান এমন কোনও আমল করতে পারে না, যা আল্লাহ তাআলার কাছে রক্তপ্রবাহ অপেক্ষা বেশি প্রিয়। কিয়ামতের দিন কুরবানীর পশু তার শিং, তার ক্ষুর ও পশমসহ হাজির হবে। জবাইয়ের পর তার রক্ত মাটিতে পড়ার আগে আল্লাহ তা‘আলার কাছে কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা এর দ্বারা মনেপ্রাণে খুশি হয়ে যাও।’ (তিরমিযী ১৫৬৭, ইবনে মাজাহ ৩১২৬)

পাঠক, রমযানের পর বরকতময় এই ইবাদতের সিজনকে আমাদের মূল্যায়ন করা উচিৎ। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এ দশককে ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করা মুমিন বান্দার ঈমানের দাবী। তাই প্রস্তুত হোন, নিজেকে তৈরি করুন- পূণ্যেভরা যিলহাজের প্রথম দশককে ইবাদতের মাধ্যমে স্বাগত জানাতে।

লেখক: ইমাম, মেইন বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদ, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।
মুহাদ্দিস, বলিদাপাড়া মাদরাসা, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।