পড়ার টেবিল, খেলার মাঠ ছেড়ে মোবাইলে ধুকছে শিক্ষার্থীরা!
যখন তাদের পড়ার টেবিলে থাকার কথা সেই সময়ে ঝিনাইদহ শহরের পায়রা চত্ত্বরে মোবাইল নিয়ে খেলছে তিন কিশোর। ছবিঃ আসিফ কাজল
আসিফ কাজল, ঝিনাইদহঃ
প্রবাদ আছে “অলস মস্তিস্ক শয়তানের কারখানা”। বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে দীর্ঘ মেয়াদী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে প্রযুক্তি ভিত্তিক অপরাধ যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি ঝিনাইদহ শহরের পাড়া মহল্লায় উঠতি বয়সী শিক্ষার্থীদের আড্ডা বেড়েছে চোখে পড়ার মতো। এ থেকেই হয়তো অপরাধের গ্যাং গ্রুপ তৈরী হওয়ার আশংকা থাকে। বড় ধরণের কোন অপরাধে জড়িয়ে না পড়লেও তাদের অভ্যসগত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে ব্যাপক ভাবে। পড়ার টেবিল ছেড়ে মাদক ও বিড়ি সিগারেটে আসক্ত, ফেসবুক, ইউটিউব এবং প্রযুক্তি ভিত্তিক কর্মে তাদের সময় কাটছে। ইমো, ভাইবার, টুইটার ও হোয়াটসআপে নতুন নতুন ছবি আপ ও চ্যাটিং করছে। সময় নষ্ট করে তৈরী করছে টিকটক ভিডিও। এই কাজে নারীরাও পিছিয়ে নেই। রাত জেগে ইন্টারনেটে খেলছে ফাইটিং ফ্রি ফায়ার ও পাবজির মতো নেশা ধরা গেম। কারোর পর্ন ভিডিওতে আসক্ত হয়ে নৈতিক স্খলণ ঘটছে।
আর এসবই হচ্ছে প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনে। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতাকে কাজে লাগিয়ে স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া যুবক কিশোররা মোবাইলে এমন ভাবে আসক্তি হয়ে পড়ছে যা মাদকের চেয়ে ভয়ংকর। বিকালের সময় ঝিনাইদহের অধিকাংশ অঞ্চলে দেখা গেছে যুবা কিশোররা ইন্টারনেটে ফাইটিং ফ্রি ফায়ার গেম নিয়ে পড়ে আছে, যাদের বেশির ভাগ স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী। মাসের পর মাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অলস সময়ে তারা মারণনেশা এ গেমসে জড়িয়ে পড়ছে। এমনকি রাতের বেলাও কেও কেও সারা রাত জেগে এই খেলায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। অভিভাবকরা নিষেধ করলে তাদের সাথে বাক বিতন্ডা ও মনোমালিন্য হচ্ছে। পড়ালেখার টেবিল ও খেলার মাঠ ছেড়ে ১০ থেকে ২৫ বছরের উড়তি বয়সের তরুণরা অ্যান্ড্রয়েড ফোন নিয়ে সর্বক্ষন সময় কাটাচ্ছে। এতে তাদের মননশীলতার বিকাশ যেমন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে তেমনি অল্প বয়সে চোখ ও কানের বারোটা বেজে যাচ্ছে। ‘স্মার্টফোন’ ছাড়া আধুনিক জীবন যেন কল্পনাই করা যায় না। অধিকাংশ তরুণ-তরুণীকেই আজকাল কানে স্মার্টফোন গুঁজে রাখতে দেখা যায়। অর্থাৎ এদের বেশিরভাগই অত্যাধুনিক সব মুঠোফোনে আসক্ত।
কিন্তু আসক্তি মাত্রই তো ক্ষতিকর! আর স্মার্টফোনে আসক্তি যে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে, তা আবারো নতুন করে জানান দিলেন চিকিৎসকরা। বললেন, অতিরিক্ত স্মার্টফোনের ব্যবহার এবং স্মার্টফোন থেকে নির্গত আলো চোখের দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা তৈরি করে। ধীরে ধীরে ডেকে আনে সর্বনাশ, এমনকি কাছের জিনিস দেখার ক্ষমতাটুকুও হারিয়ে যেতে পারে এর ফলে।
ব্রিটিশ চক্ষুরোগ-চিকিৎসক অ্যান্ডি হেপওর্থ জানান, মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় চোখের পলক কম পড়ে এবং স্বাভাবিকের তুলনায় স্মার্টফোন চোখের বেশি কাছাকাছি এনে কোনো বিষয় দেখা হয়। তাই টানা, দীর্ঘ সময় ধরে মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ট্যাবলেট ও ফ্ল্যাট স্ক্রিন টিভি দেখার বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলেছেন চক্ষুরোগ-বিশেষজ্ঞরা।
তাঁদের দাবি, যে যন্ত্রগুলো থেকে আলো নির্গত হয় তা চোখের জন্য শুধু ক্ষতিকরই নয়, বিষাক্তও বটে এতে করে ঘাড়ে ব্যথা, মাথাব্যথা বা মাইগ্রেনও হতে পারে। তবে শুধু চোখের ক্ষতিই নয়, মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার শুক্রাণুর সংখ্যাও কমিয়ে দিতে পারে। অধিকাংশ পুরুষই মোবাইল ফোন তাঁদের প্যান্টের পকেটে রাখেন। এ সময় রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন পুরুষের প্রজননতন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে। বলাই বাহুল্য, এ ধরনের ক্ষতিকর তরঙ্গ শুক্রাণুর ওপর প্রভাব ফেলে এবং শুক্রাণুর ঘনত্ব কমিয়ে দেয়। এছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে মুঠোফোনে মেসেজ বা বার্তা টাইপ করা হলে আঙুলের জয়েন্টগুলোতেও ব্যথা হতে পারে, দেখা দিতে পারে আর্থ্রাইটিসের মতো রোগ।
একাধিক গবেষণার ফলের বরাতে হাফিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুঠোফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারে শারীরিক ও মানসিক নানা সমস্যায় পড়ছেন ব্যবহারকারীরা।
হারানোর ভয়ঃ মুঠোফোন সব সময় ঠিক জায়গায় আছে কিনা তা নিয়ে মন সব সময় সতর্ক থাকে। মোবাইল হারানো ভয় থেকে মনের মধ্যে জন্ম নেয় এক সমস্যা। গবেষকেরা মুঠোফোন ও সঙ্গে যোগাযোগ হারানোর এই ভয়জনিত অসুখের নাম দিয়েছেন ‘নোমোফোবিয়া’। যার পুরো নাম ‘নো মোবাইল-ফোন ফোবিয়া’। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের ৫৩ শতাংশ এবং ২৯ শতাংশ ভারতীয় তরুণরা এ রোগের শিকার। ৫ বছর আগেও যে রোগের অস্তিত্ব কল্পিত ছিল না, আধুনিকতার সে রোগ নিয়ে দেশে-বিদেশে চিন্তিত মনোবিজ্ঞানী-মহল। অতিরিক্ত মুঠোফোন নির্ভরতা কমিয়ে ফেলতে পরামর্শ দেন গবেষকেরা।
ঘুমের মধ্যে বার্তা পাঠানোঃ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে অতিরিক্ত সময় বার্তা পাঠানো, চ্যাটিং করার ফলে ঘুমের মধ্যেও এর প্রভাব পড়তে পারে। হতে পারে স্লিপ টেক্সটিং’ সমস্যা। এ সমস্যা হলে রাতে ঘুমের মধ্যে কাকে কী বার্তা পাঠানো হয় তা আর পরে মনে থাকে না। বার্তা পাঠানোর বিষয়টি মাথায় থাকে বলে ঘুমের মধ্যেও হাতের কাছে থাকা মুঠোফোন থেকে অনাকাংক্ষিত নম্বরে বার্তা চলে যায়। মনোবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, দুশ্চিন্তা, কাজের চাপ আর মুঠোফোন নিয়ে অনেকের দিন কাটে। এমন অবস্থায় স্লিপ টেক্সটিং ঘটতে পারে। রাতে বিছানার পাশে মুঠোফোন না রাখার পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকেরা।
কমতে পারে চোখের জ্যোতিঃ যুক্তরাজ্যের চক্ষু বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে জানিয়েছেন, মুঠোফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারে দৃষ্টি বৈকল্য সৃষ্টি হতে পারে। এতে করে ক্ষীণ দৃষ্টির সমস্যা দেখা দিতে পারে। স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা সাধারণত চোখ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার দূরত্ব রেখে তা ব্যবহার করেন। তবে, অনেকের ক্ষেত্রে এ দূরত্ব মাত্র ১৮ সেন্টিমিটার। সংবাদপত্র, বই বা কোনো কিছু পড়ার ক্ষেত্রে সাধারণত চোখ থেকে গড়ে ৪০ সেন্টিমিটার দূরত্ব থাকে। চোখের খুব কাছে রেখে অতিরিক্ত সময় ধরে স্মার্টফোন ব্যবহার করলে জিনগত সমস্যা দেখা দিতে পারে। ক্ষীণদৃষ্টি সৃষ্টির জন্য যা ভূমিকা রাখতে সক্ষম। গবেষকেরা একে ‘এপিজেনেটিকস’ সংক্রান্ত বিষয় বলেন। গবেষকেরা দীর্ঘক্ষণ ধরে স্মার্টফোনে চোখ না রাখতে পরামর্শ দিয়েছেন। দৈনিক কিছু সময় মোবাইল ফোন থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন তাঁরা। স্মার্টফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে বয়স বিবেচনার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের গবেষকেরা।
কানে কম শোনাঃ মুঠোফোন ব্যবহারের ফলে কানের সমস্যা তৈরির বিষয়টি অভ্যাসের ওপর নির্ভর করে। হেডফোন ব্যবহার করে উচ্চশব্দে গান শুনলে অন্তকর্ণের কোষগুলোর ওপর প্রভাব পড়ে এবং মস্তিষ্কে অস্বাভাবিক আচরণ করে। একসময় বধির হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
শরীরের অস্থি-সন্ধিগুলোর ক্ষতিঃ অতিরিক্ত সময়ে ধরে মেসেজ বা বার্তা টাইপ করা হলে আঙুলের জয়েন্টগুলোতে ব্যথা হতে পারে এবং অবস্থা বেশি খারাপ হলে আর্থরাইটিসের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ ছাড়াও অনেকে অনেকেই কাজের সময় মুঠোফোন ব্যবহার করতে গিয়ে কাঁধ ও কানের মাঝে ফোন রেখে কথা বলেন। অনেকেই অতিরিক্ত ঝুঁকে বসে দীর্ঘ সময় ধরে বার্তা পাঠাতে থাকেন। বসার ভঙ্গির কারণেও শরীরে নানা অসুবিধা দেখা দিতে পারে। চিকিত্সকের পরামর্শ হচ্ছে অতিরিক্ত সময় ধরে মুঠোফোনে বার্তা লিখবেন না, এতে করে শরীরের জয়েন্ট বা সন্ধির সমস্যা থেকে সুস্থ থাকতে পারবেন।
কমে যেতে পারে শুক্রাণুঃ গবেষকেরা জানান, মুঠোফোন থেকে হাই ফ্রিকোয়েন্সির ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন নির্গত হয়। এই ক্ষতিকর তরঙ্গের সঙ্গে মস্তিষ্কে ক্যানসারের যোগসূত্র থাকতে পারে। এ ছাড়াা শরীরের অন্য কোষকলা এই ক্ষতিকর তরঙ্গের প্রভাবে ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে পুরুষের প্রজননতন্ত্রেরও।
গবেষকেদের দাবি, মুঠোফোন থেকে নির্গত ক্ষতিকর তরঙ্গ শুক্রাণুর ওপর প্রভাব ফেলে এবং শুক্রাণুর ঘনত্ব কমিয়ে দিতে পারে।
যখন তখন রিং টোনঃ এ সমস্যা মূলত উদ্বিগ্নতা বা বিষন্নতা থেকে ঘটতে পারে। এ ধরনের সমস্যা হলে ব্যবহারকারী ফোনের রিং না বাজলে কিংবা ভাইব্রেশন না হলেও হঠাৎ করেই তা শুনতে পান বা অনুভব করেন। অতিরিক্ত মুঠোফোন ব্যবহারের কারণে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ ধরনের সমস্যা ভুগতে শুরু করলে তা টেরও পান না অনেক ব্যবহারকারী।
ঘুম নেইঃ স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ, ডেস্কটপের অতিরিক্ত ব্যবহার ও অতিরিক্ত টেলিভিশন দেখার ফলে সবচে বেশি দেখা দেয় ঘুমের সমস্যা বা নিদ্রাহীনতা। যারা ঘুমাতে যাওয়ার আগে এ ধরনের প্রযুক্তি-পণ্য অতিমাত্রায় ব্যবহার করেন তাদের শরীরে মেলাটোনিনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে; যার কারণ প্রযুক্তিপণ্য থেকে নির্গত উজ্জ্বল আলো। এক পর্যায়ে ঘুমের মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয় এবং স্লিপ ডিজঅর্ডারের ঝুঁকি তৈরি হয়।
টয়লেটের চেয়েও নোংরাঃ মার্কিন গবেষকেরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, টয়লেট সিটের তুলনায় ১০ গুণ বেশি ব্যাকটেরিয়াা থাকে মুঠোফোনে। মুঠোফোন নিয়মিত পরিষ্কার না করায় এটি জীবাণুর অভয়ারণ্য হয়ে ওঠে।
গবেষকেরা বলেন, মুঠোফোনে ব্যাকটেরিয়াগুলো ব্যবহারকারীর জন্য খুব বেশি ক্ষতিকারক না হলেও এটি থেকে সংক্রমণ বা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে।