সবুজদেশ ডেক্স: ফ্লাইওভারে যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো হচ্ছে। এতে যাত্রীদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। এ ছাড়া সড়কবাতি না থাকায় রাতের বেলায় ফ্লাইওভারগুলো ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। আলো না থাকায় রাতের বেলায় সেখানে ভুতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাত্রীদের চলতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও দুই সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ কোনো দায়িত্ব নিচ্ছে না। রাজধানীর মৌচাক-মগবাজার, মহাখালী, খিলগাঁও, কুড়িল ও মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার সরেজমিন ঘুরে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এক সপ্তাহ ঘুরে দেখা গেছে, ফ্লাইওভারগুলোর যত্রতত্র ও বেপরোয়াভাবে বাস থামিয়ে চালকরা যাত্রী ওঠানো-নামানোর কাজ করছে। মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে এক প্রকার ফ্রি স্টাইলে বাস চালানো হয়। ফ্লাইওভারের বিভিন্ন স্থানে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা বাস থামানো হয়। ফ্লাইওভারটির দায়িত্বে থাকা শ্রমিকরাও যাত্রী ওঠানো-নামানোতে চালকদের সহযোগিতা করে। এ জন্য তারা বাস চালক-হেলপারদের কাছ থেকে ১০-২০ টাকা নেয়। যাত্রাবাড়ী থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পর্যন্ত ফ্লাইওভারটির ছয়টি স্থানে বাস স্টপেজ রয়েছে। অঘোষিত এসব স্টপেজে বাসসহ বিভিন্ন যানবাহন দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বাসচালক ও হেলপার জানান, এই ফ্লাইওভার দিয়ে চলতে গেলে সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী থেকে যাত্রী পাওয়া যায় না। তাদের প্রায় লোকসান হয়। তাই তারা ফ্লাইওভারে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী তোলেন। ফ্লাইওভারে দায়িত্বরত শ্রমিকরাও এটা ভালো করেই জানেন। স্টপেজ না দিলে ফ্লাইওভার দিয়ে চলাচল করবে না অধিকাংশ বাস। তাই যাত্রী ওঠানো-নামানোতে তারা সহযোগিতা করেন। শ্রমিক বাতেন জানান, ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত বিভিন্ন স্টপেজে শত শত যাত্রী ওঠানো-নামানো হয়। এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই। কর্তৃপক্ষও নিষেধ করেনি। তিনি বলেন, জীবনের ঝুঁকি জেনেও যাত্রীরা ফ্লাইওভারের ওপর ওঠা-নামা করছেন। রাজধানী মার্কেট সংলগ্ন র‌্যাব-৩ কার্যালয়ের কাছাকাছি ফ্লাইওভারটির ওপরে পরপর তিনটি স্টপেজ রয়েছে। প্রচণ্ড গতিতে আসা গাড়িগুলো কার আগে কে যাত্রী ওঠাবে-নামাবে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা করে। একাধিক ট্রাফিক পুলিশ বলেন, ফ্লাইওভারের ওপরে তাদের ডিউটি নেই।

‘গাড়ি দাঁড়ানো, যাত্রী পারাপার নিষেধ’ সাইনবোর্ড লেখা থাকলেও কেউই তা মানছে না। তারা বলেন, আইন দিয়ে নয়, যাত্রীদের আগে সচেতন হতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফ্লাইওভারগুলো রাজধানীর পরিবহন সেবায় কিছুটা স্বস্তি আনলেও রাতের বেলায় ফ্লাইওভারগুলো এখন চরম আতঙ্কের নাম। এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারি না থাকায় এগুলো অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। রাতের বেলায় চলাচলকারী প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল আরোহীরা অপরাধ চক্রের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন। গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর কুড়িল ফ্লাইওভারে ছিনতাইকারীরা একটি দৈনিক পত্রিকার বিজ্ঞাপন নির্বাহী ফারুক আহমেদ ফরহাদের পকেট থেকে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এটিএম কার্ড ছিনিয়ে নেয়। এরপর কার্ড দিয়ে তারা ৪০ হাজার টাকা তুলে নেয়। একই ফ্লাইওভারে রাতে এক তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। গত বছর খিলগাঁও ফ্লাইওভারের ওপর থেকে এক তরুণীর বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করা হয়। মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের বাতিগুলো অনেক দিন ধরে অকেজো। বাতি না থাকায় যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। অভিভাবকহীন এ ফ্লাইওভারটি দিয়ে উল্টোপথে চলে মোটরসাইকেল, অটোরিকশা এমনকি বাসও। এখানে যৌনকর্মী, মাসকাসক্ত ও ছিনতাইকারীদের আনাগোনা চোখে পড়ে। এই ফ্লাইওভারে কয়েকবার ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। রাতের বেলায় ফ্লাইওভারটিতে থাকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এর আশপাশের লোকজন জানায়, খুঁটির গোড়া থেকে চোররা বারবার বৈদ্যুতিক তার কেটে নিয়ে যায়। এ কারণে ল্যাম্প পোস্টের লাইট জ্বলে না। ফ্লাইওভারে সিসিটিভি ক্যামেরাও নেই। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) কর্মকর্তারা জানান, ল্যাম্প পোস্টের খুঁটির গোড়া থেকে বিদ্যুতের তার কেটে নেয়ায় বাতি ও সিসি ক্যামেরা লাগিয়েও রক্ষা করা যাচ্ছে না। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই সব চুরি হয়ে যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছু ডিএসসিসির এক কর্মকর্তা জানান, মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভারে ১০ বছর পর্যন্ত লাইট পোস্ট ও বাতি লাগানোর দায়িত্ব নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের। সেখানে সিটি কর্পোরেশনের কোনো দায়ভার নেই। এ বিষয়ে তমা কনস্ট্রাকশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. হাতেম আলী মজুমদার জানান, তাদের পক্ষ থেকে তিনবার বাতি লাগানো হয়েছে। কিন্তু তিনবারই বাতিসহ তার চুরি হয়ে গেছে। এখন এ কাজে কোনো অর্থ বরাদ্দ নেই। কাজটি এলজিইডিকে বুঝিয়েও দেয়া হয়েছে। এর প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী সুশান্ত কুমার পাল বলেন, বিষয়টি নিয়ে তারা খুবই উদ্বিগ্ন। বাতি লাগানোর পর সপ্তাহখানের মধ্যে চুরি হয়ে যাচ্ছে। আবারও বাতি লাগানো হবে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা তো বাতি লাগাতে পারি। কিন্তু নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব তো আমাদের নয়। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, এটি মূলত র‌্যাবের কাজ নয়। ফ্লাইওভারগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সড়কবাতি লাগানো নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক জানান, ফ্লাইওভারে বিভিন্ন যানবাহন দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো ঠিক নয়। মাসের পর মাস ফ্লাইওভারে বাতি না থাকা অন্য কোনো দেশে সম্ভব নয়। দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে। প্রয়োজনে ব্যর্থতার জন্য তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here