ঢাকা ০৯:৫৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বন্দুকের মুখে ভারতীয় মুসলমানদের বাংলাদেশে ‘পুশ-ইন’

  • সবুজদেশ ডেস্ক:
  • Update Time : ১০:১৫:৩৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৫ জুন ২০২৫
  • ৫২ বার পড়া হয়েছে।

মালেকা খাতুন এখনো বাংলাদেশে রয়েছেন। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী একটি পরিবার তাঁকে অস্থায়ী আশ্রয় দিয়েছে। ছবি: বিবিসি

 

গত কয়েক দিনের কথা মনে করে ভারতের আসাম রাজ্যের বরপেটা জেলার ৫৮ বছর বয়সী সোনা বানু এখনো শিউরে ওঠেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, গত ২৫ মে তাঁকে স্থানীয় থানায় ডেকে নেওয়া হয়। পরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে গিয়ে, সেখান থেকে তাঁকে ও আরও প্রায় ১৩ জনকে বন্দুকের মুখে জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেন তাঁকে এমন করা হয়েছে, তা জানানো হয়নি বলে জানান সোনা বানু।

সম্প্রতি ভারত থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্তে একাধিক পুশ ইনের ঘটনা ঘটেছে। ভারতের দাবি, তারা অবৈধ অভিবাসীদের শনাক্ত করে বাংলাদেশে পুশ ব্যাক করছে। শুরুটা হয়েছিল গত ২২ এপ্রিল ভারত শাসিত কাশ্মীরের পেহেলগাম হত্যাকাণ্ডের পর। ভারতের নানা রাজ্যে শুরু হয় এক বিশেষ অভিযান—‘অবৈধ বাংলাদেশি চিহ্নিত’ করার অভিযান। প্রথম অভিযানটা হয়েছিল গুজরাটে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বিষয়টি নিয়ে একটি সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ভুক্তভোগী অনেকের সঙ্গে কথা বলে বিবিসি জানতে পেয়েছে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য।

সোনা বানু, সারা জীবন আসামেই বসবাস করেছেন। কিন্তু কয়েক বছর ধরে তাঁকে বারবার প্রমাণ করতে হচ্ছে, তিনি ভারতীয় নাগরিক। বাংলাদেশের ‘অবৈধ অভিবাসী’ নন। চোখের জল মুছতে মুছতে বানু বলেন, ‘বন্দুক ঠেকিয়ে আমাকে ওপারে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। দুদিন ধরে আমি ভারত ও বাংলাদেশের মাঝখানে, হাঁটুসমান জলের মাঠে মশার কামড় ও জোঁকের মধ্যে খাবার-পানি ছাড়া কাটিয়েছি।’ দুই দিন পর তাঁকে বাংলাদেশ সীমান্তের একটি পুরোনো জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দুই দিন থাকার পর, তাঁকে ও আরও কয়েকজনকে বাংলাদেশি কর্মকর্তারা সীমান্তের ওপারে নিয়ে যান। পরবর্তী সময় ভারতীয় কর্মকর্তারা তাঁদের গ্রহণ করেন এবং বাড়িতে ফেরত পাঠান।

ভারত ও বাংলাদেশের মাঝখানের নির্জন এলাকা — শোনা বানুর দাবি, তিনি এখানে একটি মাঠের মধ্যে দু’দিন কাটিয়েছেন। ছবি: বিবিসি

সোনা বানুকে কেন হঠাৎ বাংলাদেশে পাঠানো হলো এবং আবার কেন ফিরিয়ে আনা হলো, তা স্পষ্ট নয়। তবে তাঁর ঘটনাটি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এমন একাধিক ঘটনার মধ্যে একটি। আসামের কর্তৃপক্ষ তাদের ট্রাইব্যুনাল থেকে ঘোষিত সন্দেহভাজন ‘অবৈধ বাংলাদেশি’দের ধরে নিয়ে সীমান্তে ঠেলে দিচ্ছেন। বিবিসি এমন ছয়টি ঘটনা খুঁজে পেয়েছে। ভুক্তভোগী এই মানুষজন অভিযোগ করেছেন, তাঁদের পরিবারের সদস্যদের তুলে নিয়ে সীমান্তে পাঠানো হয়েছে এবং ‘ওপারে (বাংলাদেশে) ঠেলে দেওয়া হয়েছে’।

বিবিসির পক্ষ থেকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ), আসাম পুলিশ ও রাজ্য সরকারের কাছে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলেও কোনো জবাব মেলেনি।

ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে, যার অনেক সংবেদনশীল এলাকা কড়া পাহারায় থাকা সত্ত্বেও সীমান্ত পেরোনো তুলনামূলক সহজ। তবে আইনজীবীরা বলছেন, নিয়ম মেনে আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া হঠাৎ কাউকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে অন্য দেশে ঠেলে দেওয়ার ঘটনা বিরল। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ ধরে এই ধরনের ঘটনা বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে।

ভারতের সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি, সাম্প্রতিক অভিযানে কতজনকে ওপারে পাঠানো হয়েছে। তবে বাংলাদেশি প্রশাসনের কয়েকটি উচ্চপদস্থ সূত্র দাবি করেছে, শুধু মে মাসেই ভারত ‘অবৈধভাবে’ ১ হাজার ২০০-এর বেশি মানুষকে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে। শুধু আসাম নয়, অন্যান্য রাজ্য থেকেও এসেছে। এই সূত্রগুলো নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরও জানিয়েছে, বাংলাদেশ এই ১ হাজার ২০০ জনের মধ্যে ১০০ জনকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করে আবার তাঁদের ভারতে ফেরত পাঠিয়েছে।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এসব চেষ্টা রুখতে তারা সীমান্তে টহল বাড়িয়েছে। তবে ভারত বাংলাদেশ বা বিজিবির এই অভিযোগগুলো নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।

বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, সাম্প্রতিক এই অভিযানে অন্যান্য রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মুসলিমরাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে আসামের পরিস্থিতি তুলনামূলক জটিল ও উত্তেজনাপূর্ণ, যেখানে নাগরিকত্ব আর জাতিগত পরিচয় দীর্ঘদিন ধরেই রাজনীতির প্রধান বিষয়।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আসামের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। এসব সীমান্তবর্তী এলাকার অনেক মানুষই সুযোগের সন্ধানে বা ধর্মীয় নিপীড়ন থেকে বাঁচতে ভারতে প্রবেশ করেন। ফলে আসামের স্থানীয়দের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। স্থানীয় অনেকেই মনে করছেন, এর ফলে জনসংখ্যার বিন্যাস বদলে যাচ্ছে ও স্থানীয়দের সম্পদ কমে যাচ্ছে।

আসাম ও কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বারবার অবৈধ অভিবাসন বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজ্যের জাতীয় নাগরিক পুঞ্জি (এনআরসি) তৈরির কাজকেও অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এই পঞ্জিকা এমন একটি তালিকা যেখানে বলা হয়েছে, যাঁরা ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের (বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার আগের দিন) মধ্যে আসামে এসেছিলেন, কেবল তাঁরাই স্থান পেয়েছেন। তালিকাটি একাধিকবার সংশোধন করা হয়েছে। এ ছাড়া যাঁদের নাম বাদ পড়েছিল, তাঁদের ‘ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল’ নামক আধা বিচারিক ফোরামে সরকারি নথি দেখিয়ে ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।

তবে নানান আলোচনা-সমালোচনার পর একটি বিশৃঙ্খল প্রক্রিয়ায় ২০১৯ সালে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়। এতে আসামের প্রায় ২০ লাখ বাসিন্দা বাদ পড়েন। তাঁদের মধ্যে অনেককে ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা হয়, অন্যরা তাঁদের বাদ পড়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করেন। সোনা বানু জানান, তাঁর মামলাটিই সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন রয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এটা জেনেও তাঁকে জোর করে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে।

বিবিসি আসামের আরও ছয়জন মুসলিমের কাছ থেকে একই ধরনের কথা শুনেছে। এরা সবাই অভিযোগ করেছেন, তাঁদের পরিবারের সদস্যদেরও সোনা বানুর সঙ্গে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা দাবি করেন, তাঁদের প্রয়োজনীয় নথি ছিল ও তাঁরা কয়েক প্রজন্ম ধরে ভারতে বসবাস করছেন জেনেও প্রশাসন এই কাজ করেছে। এই ছয়জন মুসলিমের মধ্যে চারজন এখন বাড়িতে ফিরে এসেছেন। কিন্তু কেন তাঁদের তুলে নেওয়া হয়েছিল, তার কোনো উত্তর এখনো তাঁরা পাননি।

আসামের ৩ কোটি ২০ লাখ বাসিন্দার এক-তৃতীয়াংশ মুসলিম। তাদের মধ্যে অনেকে ব্রিটিশ শাসনের সময় এখানে বসতি স্থাপনকারী অভিবাসীদের বংশধর।

আসামের বরপেটার ৬৭ বছর বয়সী মালেকা খাতুন এখনো বাংলাদেশে রয়েছেন। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী একটি পরিবার তাঁকে অস্থায়ী আশ্রয় দিয়েছে। তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘এখানে আমার কেউ নেই।’ তাঁর পরিবার তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পেরেছে, কিন্তু তিনি কখন ফিরতে পারবেন, তা জানেন না। তিনি ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল ও রাজ্যের হাইকোর্টে মামলা হেরেছিলেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেননি, তাই তাঁকে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

বিবিসি বরপেটা থেকে প্রায় ১৬৭ কিলোমিটার দূরে মরিগাঁওয়ের রিতা খানমের সঙ্গে কথা বলে। তিনি একটি টেবিলের কাছে বসেছিলেন, যেখানে অনেকগুলো কাগজের স্তূপ ছিল। তাঁর স্বামী খাইরুল ইসলাম (৫১), একজন স্কুলশিক্ষক। রিতা খানম জানান, সোনা বানুর সঙ্গে তাঁর স্বামী খাইরুল ইসলামকেও তুলে নিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। একটি ট্রাইব্যুনাল ২০১৬ সালে তাঁকে বিদেশি ঘোষণা করেছিল। এরপর প্রায় দুই বছর তিনি একটি ডিটেনশন সেন্টারেও কাটান। সোনা বানুর মতো, তাঁর মামলাও সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন।

রিতা খানম বলেন, ‘আমার স্বামী ভারতীয়, তাঁর প্রমাণ হিসেবে সব নথি রয়েছে।’ তিনি তাঁর স্বামীর স্কুল থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার সনদপত্র ও কিছু জমির রেকর্ডও দেখান। কিন্তু কর্তৃপক্ষের কাছে জাতীয়তা প্রমাণ করার জন্য এগুলো যথেষ্ট ছিল না।

রিতা খানম জানান, গত ২৩ মে পুলিশ তাঁদের বাড়িতে এসে কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই খাইরুল ইসলামকে নিয়ে যায়। কয়েক দিন পর যখন একজন বাংলাদেশি সাংবাদিকের খাইরুল ইসলামকে নিয়ে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়—তখনই পরিবার জানতে পারে তিনি কোথায় আছেন। সোনা বানুর মতো খাইরুল ইসলামকেও এখন ভারতে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাঁর পরিবার তাঁর ফেরার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তবে আসাম পুলিশ বিবিসিকে জানিয়েছে, তাদের কাছে খাইরুল ইসলামের ফেরত আসার ‘কোনো তথ্য নেই’।

সাঞ্জিমা বেগমের হাতে সরকারি কাগজপত্র রয়েছে, যেগুলো তাঁর দাবি অনুযায়ী তাঁর বাবার পরিচয় প্রমাণ করে। ছবি: বিবিসি

হঠাৎ বিশেষ অভিযান কেন শুরু হলো, কেনই-বা ভারতে আটক হওয়ার পরে কয়েকজনকে বাংলাদেশে দেখা গেল, তা নিয়ে কোনো প্রশ্নের জবাব দেয়নি আসাম পুলিশ।

পুলিশের মহানির্দেশকের কাছে এই বিষয়ে তথ্য চেয়ে ই-মেইল করা হয়েছে, তবে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তার জবাব আসেনি।

সম্প্রতি এ ধরনের ঘটনা শুরু হওয়ার কয়েক দিন পর, মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্ব শর্মা ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের একটি নির্দেশের কথা উল্লেখ করেন। যেখানে বলা হয়েছে, ‘বিদেশি ঘোষিত’ কিন্তু ডিটেনশন সেন্টারে থাকা ব্যক্তিদের পুশ ব্যাক করার প্রক্রিয়া শুরু করার নির্দেশ দিয়েছিল সরকার। হেমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেন, ‘যাঁরা বিদেশি হিসেবে ঘোষিত, কিন্তু আদালতে আপিল করেননি, আমরা তাঁদের ফেরত পাঠাচ্ছি।’ তিনি দাবি করেন, যাঁদের আদালতের আপিল বিচারাধীন, তাঁদের ‘বিরক্ত করা হচ্ছে না’।

তবে আসামে নাগরিকত্ব মামলা নিয়ে কাজ করা আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক ভূঁইয়া অভিযোগ করেছেন, সাম্প্রতিক অনেক ঘটনায় নিয়ম মেনে (ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সমন্বয় করে) কাজ করা হয়নি। তিনি বলেন, ‘যা ঘটছে তা আদালতের আদেশের ইচ্ছাকৃত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপব্যাখ্যা।’

আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক ভূঁইয়া সম্প্রতি একটি ছাত্রসংগঠনের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদন করেছিলেন, যেখানে তাঁরা ‘জোরপূর্বক ও অবৈধ পুশ ব্যাক নীতি’ বন্ধ করার জন্য আদালতের হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন। তবে সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের প্রথমে আসাম হাইকোর্টে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

সবুজদেশ/এসইউ

বন্দুকের মুখে ভারতীয় মুসলমানদের বাংলাদেশে ‘পুশ-ইন’

Update Time : ১০:১৫:৩৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৫ জুন ২০২৫

 

গত কয়েক দিনের কথা মনে করে ভারতের আসাম রাজ্যের বরপেটা জেলার ৫৮ বছর বয়সী সোনা বানু এখনো শিউরে ওঠেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, গত ২৫ মে তাঁকে স্থানীয় থানায় ডেকে নেওয়া হয়। পরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে গিয়ে, সেখান থেকে তাঁকে ও আরও প্রায় ১৩ জনকে বন্দুকের মুখে জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেন তাঁকে এমন করা হয়েছে, তা জানানো হয়নি বলে জানান সোনা বানু।

সম্প্রতি ভারত থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্তে একাধিক পুশ ইনের ঘটনা ঘটেছে। ভারতের দাবি, তারা অবৈধ অভিবাসীদের শনাক্ত করে বাংলাদেশে পুশ ব্যাক করছে। শুরুটা হয়েছিল গত ২২ এপ্রিল ভারত শাসিত কাশ্মীরের পেহেলগাম হত্যাকাণ্ডের পর। ভারতের নানা রাজ্যে শুরু হয় এক বিশেষ অভিযান—‘অবৈধ বাংলাদেশি চিহ্নিত’ করার অভিযান। প্রথম অভিযানটা হয়েছিল গুজরাটে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বিষয়টি নিয়ে একটি সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ভুক্তভোগী অনেকের সঙ্গে কথা বলে বিবিসি জানতে পেয়েছে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য।

সোনা বানু, সারা জীবন আসামেই বসবাস করেছেন। কিন্তু কয়েক বছর ধরে তাঁকে বারবার প্রমাণ করতে হচ্ছে, তিনি ভারতীয় নাগরিক। বাংলাদেশের ‘অবৈধ অভিবাসী’ নন। চোখের জল মুছতে মুছতে বানু বলেন, ‘বন্দুক ঠেকিয়ে আমাকে ওপারে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। দুদিন ধরে আমি ভারত ও বাংলাদেশের মাঝখানে, হাঁটুসমান জলের মাঠে মশার কামড় ও জোঁকের মধ্যে খাবার-পানি ছাড়া কাটিয়েছি।’ দুই দিন পর তাঁকে বাংলাদেশ সীমান্তের একটি পুরোনো জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দুই দিন থাকার পর, তাঁকে ও আরও কয়েকজনকে বাংলাদেশি কর্মকর্তারা সীমান্তের ওপারে নিয়ে যান। পরবর্তী সময় ভারতীয় কর্মকর্তারা তাঁদের গ্রহণ করেন এবং বাড়িতে ফেরত পাঠান।

ভারত ও বাংলাদেশের মাঝখানের নির্জন এলাকা — শোনা বানুর দাবি, তিনি এখানে একটি মাঠের মধ্যে দু’দিন কাটিয়েছেন। ছবি: বিবিসি

সোনা বানুকে কেন হঠাৎ বাংলাদেশে পাঠানো হলো এবং আবার কেন ফিরিয়ে আনা হলো, তা স্পষ্ট নয়। তবে তাঁর ঘটনাটি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এমন একাধিক ঘটনার মধ্যে একটি। আসামের কর্তৃপক্ষ তাদের ট্রাইব্যুনাল থেকে ঘোষিত সন্দেহভাজন ‘অবৈধ বাংলাদেশি’দের ধরে নিয়ে সীমান্তে ঠেলে দিচ্ছেন। বিবিসি এমন ছয়টি ঘটনা খুঁজে পেয়েছে। ভুক্তভোগী এই মানুষজন অভিযোগ করেছেন, তাঁদের পরিবারের সদস্যদের তুলে নিয়ে সীমান্তে পাঠানো হয়েছে এবং ‘ওপারে (বাংলাদেশে) ঠেলে দেওয়া হয়েছে’।

বিবিসির পক্ষ থেকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ), আসাম পুলিশ ও রাজ্য সরকারের কাছে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলেও কোনো জবাব মেলেনি।

ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে, যার অনেক সংবেদনশীল এলাকা কড়া পাহারায় থাকা সত্ত্বেও সীমান্ত পেরোনো তুলনামূলক সহজ। তবে আইনজীবীরা বলছেন, নিয়ম মেনে আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া হঠাৎ কাউকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে অন্য দেশে ঠেলে দেওয়ার ঘটনা বিরল। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ ধরে এই ধরনের ঘটনা বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে।

ভারতের সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি, সাম্প্রতিক অভিযানে কতজনকে ওপারে পাঠানো হয়েছে। তবে বাংলাদেশি প্রশাসনের কয়েকটি উচ্চপদস্থ সূত্র দাবি করেছে, শুধু মে মাসেই ভারত ‘অবৈধভাবে’ ১ হাজার ২০০-এর বেশি মানুষকে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে। শুধু আসাম নয়, অন্যান্য রাজ্য থেকেও এসেছে। এই সূত্রগুলো নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরও জানিয়েছে, বাংলাদেশ এই ১ হাজার ২০০ জনের মধ্যে ১০০ জনকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করে আবার তাঁদের ভারতে ফেরত পাঠিয়েছে।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এসব চেষ্টা রুখতে তারা সীমান্তে টহল বাড়িয়েছে। তবে ভারত বাংলাদেশ বা বিজিবির এই অভিযোগগুলো নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।

বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, সাম্প্রতিক এই অভিযানে অন্যান্য রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মুসলিমরাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে আসামের পরিস্থিতি তুলনামূলক জটিল ও উত্তেজনাপূর্ণ, যেখানে নাগরিকত্ব আর জাতিগত পরিচয় দীর্ঘদিন ধরেই রাজনীতির প্রধান বিষয়।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আসামের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। এসব সীমান্তবর্তী এলাকার অনেক মানুষই সুযোগের সন্ধানে বা ধর্মীয় নিপীড়ন থেকে বাঁচতে ভারতে প্রবেশ করেন। ফলে আসামের স্থানীয়দের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। স্থানীয় অনেকেই মনে করছেন, এর ফলে জনসংখ্যার বিন্যাস বদলে যাচ্ছে ও স্থানীয়দের সম্পদ কমে যাচ্ছে।

আসাম ও কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বারবার অবৈধ অভিবাসন বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজ্যের জাতীয় নাগরিক পুঞ্জি (এনআরসি) তৈরির কাজকেও অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এই পঞ্জিকা এমন একটি তালিকা যেখানে বলা হয়েছে, যাঁরা ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের (বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার আগের দিন) মধ্যে আসামে এসেছিলেন, কেবল তাঁরাই স্থান পেয়েছেন। তালিকাটি একাধিকবার সংশোধন করা হয়েছে। এ ছাড়া যাঁদের নাম বাদ পড়েছিল, তাঁদের ‘ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল’ নামক আধা বিচারিক ফোরামে সরকারি নথি দেখিয়ে ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।

তবে নানান আলোচনা-সমালোচনার পর একটি বিশৃঙ্খল প্রক্রিয়ায় ২০১৯ সালে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়। এতে আসামের প্রায় ২০ লাখ বাসিন্দা বাদ পড়েন। তাঁদের মধ্যে অনেককে ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা হয়, অন্যরা তাঁদের বাদ পড়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করেন। সোনা বানু জানান, তাঁর মামলাটিই সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন রয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এটা জেনেও তাঁকে জোর করে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে।

বিবিসি আসামের আরও ছয়জন মুসলিমের কাছ থেকে একই ধরনের কথা শুনেছে। এরা সবাই অভিযোগ করেছেন, তাঁদের পরিবারের সদস্যদেরও সোনা বানুর সঙ্গে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা দাবি করেন, তাঁদের প্রয়োজনীয় নথি ছিল ও তাঁরা কয়েক প্রজন্ম ধরে ভারতে বসবাস করছেন জেনেও প্রশাসন এই কাজ করেছে। এই ছয়জন মুসলিমের মধ্যে চারজন এখন বাড়িতে ফিরে এসেছেন। কিন্তু কেন তাঁদের তুলে নেওয়া হয়েছিল, তার কোনো উত্তর এখনো তাঁরা পাননি।

আসামের ৩ কোটি ২০ লাখ বাসিন্দার এক-তৃতীয়াংশ মুসলিম। তাদের মধ্যে অনেকে ব্রিটিশ শাসনের সময় এখানে বসতি স্থাপনকারী অভিবাসীদের বংশধর।

আসামের বরপেটার ৬৭ বছর বয়সী মালেকা খাতুন এখনো বাংলাদেশে রয়েছেন। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী একটি পরিবার তাঁকে অস্থায়ী আশ্রয় দিয়েছে। তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘এখানে আমার কেউ নেই।’ তাঁর পরিবার তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পেরেছে, কিন্তু তিনি কখন ফিরতে পারবেন, তা জানেন না। তিনি ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল ও রাজ্যের হাইকোর্টে মামলা হেরেছিলেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেননি, তাই তাঁকে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

বিবিসি বরপেটা থেকে প্রায় ১৬৭ কিলোমিটার দূরে মরিগাঁওয়ের রিতা খানমের সঙ্গে কথা বলে। তিনি একটি টেবিলের কাছে বসেছিলেন, যেখানে অনেকগুলো কাগজের স্তূপ ছিল। তাঁর স্বামী খাইরুল ইসলাম (৫১), একজন স্কুলশিক্ষক। রিতা খানম জানান, সোনা বানুর সঙ্গে তাঁর স্বামী খাইরুল ইসলামকেও তুলে নিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। একটি ট্রাইব্যুনাল ২০১৬ সালে তাঁকে বিদেশি ঘোষণা করেছিল। এরপর প্রায় দুই বছর তিনি একটি ডিটেনশন সেন্টারেও কাটান। সোনা বানুর মতো, তাঁর মামলাও সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন।

রিতা খানম বলেন, ‘আমার স্বামী ভারতীয়, তাঁর প্রমাণ হিসেবে সব নথি রয়েছে।’ তিনি তাঁর স্বামীর স্কুল থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার সনদপত্র ও কিছু জমির রেকর্ডও দেখান। কিন্তু কর্তৃপক্ষের কাছে জাতীয়তা প্রমাণ করার জন্য এগুলো যথেষ্ট ছিল না।

রিতা খানম জানান, গত ২৩ মে পুলিশ তাঁদের বাড়িতে এসে কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই খাইরুল ইসলামকে নিয়ে যায়। কয়েক দিন পর যখন একজন বাংলাদেশি সাংবাদিকের খাইরুল ইসলামকে নিয়ে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়—তখনই পরিবার জানতে পারে তিনি কোথায় আছেন। সোনা বানুর মতো খাইরুল ইসলামকেও এখন ভারতে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাঁর পরিবার তাঁর ফেরার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তবে আসাম পুলিশ বিবিসিকে জানিয়েছে, তাদের কাছে খাইরুল ইসলামের ফেরত আসার ‘কোনো তথ্য নেই’।

সাঞ্জিমা বেগমের হাতে সরকারি কাগজপত্র রয়েছে, যেগুলো তাঁর দাবি অনুযায়ী তাঁর বাবার পরিচয় প্রমাণ করে। ছবি: বিবিসি

হঠাৎ বিশেষ অভিযান কেন শুরু হলো, কেনই-বা ভারতে আটক হওয়ার পরে কয়েকজনকে বাংলাদেশে দেখা গেল, তা নিয়ে কোনো প্রশ্নের জবাব দেয়নি আসাম পুলিশ।

পুলিশের মহানির্দেশকের কাছে এই বিষয়ে তথ্য চেয়ে ই-মেইল করা হয়েছে, তবে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তার জবাব আসেনি।

সম্প্রতি এ ধরনের ঘটনা শুরু হওয়ার কয়েক দিন পর, মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্ব শর্মা ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের একটি নির্দেশের কথা উল্লেখ করেন। যেখানে বলা হয়েছে, ‘বিদেশি ঘোষিত’ কিন্তু ডিটেনশন সেন্টারে থাকা ব্যক্তিদের পুশ ব্যাক করার প্রক্রিয়া শুরু করার নির্দেশ দিয়েছিল সরকার। হেমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেন, ‘যাঁরা বিদেশি হিসেবে ঘোষিত, কিন্তু আদালতে আপিল করেননি, আমরা তাঁদের ফেরত পাঠাচ্ছি।’ তিনি দাবি করেন, যাঁদের আদালতের আপিল বিচারাধীন, তাঁদের ‘বিরক্ত করা হচ্ছে না’।

তবে আসামে নাগরিকত্ব মামলা নিয়ে কাজ করা আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক ভূঁইয়া অভিযোগ করেছেন, সাম্প্রতিক অনেক ঘটনায় নিয়ম মেনে (ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সমন্বয় করে) কাজ করা হয়নি। তিনি বলেন, ‘যা ঘটছে তা আদালতের আদেশের ইচ্ছাকৃত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপব্যাখ্যা।’

আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক ভূঁইয়া সম্প্রতি একটি ছাত্রসংগঠনের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদন করেছিলেন, যেখানে তাঁরা ‘জোরপূর্বক ও অবৈধ পুশ ব্যাক নীতি’ বন্ধ করার জন্য আদালতের হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন। তবে সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের প্রথমে আসাম হাইকোর্টে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

সবুজদেশ/এসইউ