বহুপাক্ষিক ফোরামে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
সবুজদেশ ডেস্ক:
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে গুরুত্বপূর্ণ সব সভায় অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ। এসব সভায় ওঠে আসে নারীর ক্ষমতায়ন ও রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়গুলো। বিশেষ করে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বিশ্ব নেতাদের অবহিত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সংকট সমাধানে পাঁচটি প্রস্তাবও তুলে ধরেন তিনি।
সামগ্রিক বিবেচনায় এবারের অধিবেশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ অত্যন্ত সফল বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, এবারের অধিবেশনে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ সব সভায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে, যা বহুপাক্ষিক ফোরামে বাংলাদেশের অবস্থান যেমন সুদৃঢ় করেছে, তেমনি বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়কে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রকে আরও বিস্তৃত করবে।
বৃহস্পতিবার (৬ অক্টোবর) বিকেলে গণভবনে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফর পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।
ব্রিটেনের প্রয়াত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে প্রথমে যুক্তরাজ্য সফর করেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ৭৭তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেন।
যুক্তরাজ্য সফর প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ১৮ সেপ্টেম্বর আমি এবং আমার ছোটবোন শেখ রেহানা বাকিংহাম প্যালেসে রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সম্মানে যুক্তরাজ্যের রাজার এক সংবর্ধনায় যোগ দেই। ওয়েস্ট মিনস্টার প্যালেসের হলে শবাধারে সংরক্ষিত প্রয়াত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করি। পরে ল্যাঙ্কাস্টার হাউসে রাখা শোক বইতে বাংলায় লিখি, ‘আমি বাংলাদেশের জনগণ, আমার পরিবার এবং আমার ছোটবোন শেখ রেহানার পক্ষ থেকে গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।’ আর শোক বইয়ে রেহানা লেখেন ‘তিনি আমাদের হৃদয়ের রানি এবং সব সময় থাকবেন।’
১৯ সেপ্টেম্বর ওয়েস্ট মিনস্টার অ্যাবেতে দ্বিতীয় এলিজাবেথের শেষকৃত্যে যোগদানের বিষয়টি উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোসহ বিশ্বের কয়েকশ বিশিষ্ট ব্যক্তি শেষকৃত্যে যোগ দেন।
এর আগে কনফেডারেশন অব ব্রিটিশ ইন্ডাস্ট্রির (সিবিআই) প্রেসিডেন্ট চেলসির লর্ড করণ বিলিমোরিয়া, লেবার পার্টির নেতা কিয়ের স্টারমার, মেরিলেবোনের লর্ড স্বরাজ পালের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
পরে নিউইয়র্কে গিয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের মোট নয়টি উচ্চ পর্যায়ের সভা ও সাইড ইভেন্টে অংশ নেওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯ সেপ্টেম্বর আমি জাতিসংঘ মহাসচিব আয়োজিত ট্রান্সফর্মিং এডুকেশন সামিটে ভার্চুয়ালি অংশ নেই।
২০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ৭৭তম অধিবেশনের সভাপতি সাবা করোসির আমন্ত্রণে বিশ্বের নারী নেতাদের অংশগ্রহণে আয়োজিত এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে যোগ দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, সভায় আমি বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নারী সমাজের অবদানের কথা তুলে ধরি। তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে নারীর সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, নারী নেতৃত্বের সুযোগ সৃষ্টি নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করি। এছাড়া লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয়ে বিশ্ব নেতাদের জানাই।
এরপর ২১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ, বতসোয়ানা, স্লোভাক প্রজাতন্ত্র এবং ইউএন হ্যাবিট্যাটের যৌথ আয়োজনে টেকসই আবাসন বিষয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের সাইড ইভেন্ট ও গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স গ্রুপের (জিসিআরজি) চ্যাম্পিয়ন হিসেবে একটি উচ্চ পর্যায়ের সভায় যোগ দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেদিন সন্ধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমন্ত্রণে অভ্যর্থনা সভায় আমি অংশগ্রহণ করি। এ সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও ফার্স্ট লেডিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানাই।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে পাঁচ প্রস্তাব
২২ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গাবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের সাইড ইভেন্টে যোগ দেওয়ার কথা জানান শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সৌদি আরব, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, গাম্বিয়া এবং বাংলাদেশ যৌথভাবে এই সাইড ইভেন্টের আয়োজন করে।
এসময় রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে পাঁচটি প্রস্তাব তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। এগুলো হলো-
১. রোহিঙ্গা ইস্যুতে রাজনৈতিক সমর্থন ও মানবিক সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখা।
২. আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ এবং মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, জাতীয় আদালত এবং আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে চলমান মামলায় সমর্থন দেওয়া।
৩. জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর অব্যাহত দমন-পীড়ন বন্ধে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা।
৪. আসিয়ানের ৫ দফা মতৈক্যে মিয়ানমারের অঙ্গীকার এবং কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করা।
৫. মিয়ানমারে জাতিসংঘসহ মানবিক সহায়তাকারীদের নির্বিঘ্নে প্রবেশ নিশ্চিত করা।
শেখ হাসিনা বলেন, ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে আসছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গারা যেন সম্মানের সঙ্গে ও নিরাপদে তাদের নিজ দেশে ফিরতে পারে সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য মার্কিন ব্যবসায়ীদের আহ্বান
যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে মার্কিন ব্যবসায়ী নেতাদের আহ্বান জানান।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বৈঠকে আমি তথ্যপ্রযুক্তি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, জাহাজ নির্মাণ, অটোমোবাইলস, ফার্মাসিউটিক্যালস, চিকিৎসা শিল্প, সামুদ্রিক শিল্প, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, বেশ কয়েকটি হাই-টেক পার্কসহ বাংলাদেশের শিল্পাঞ্চল বিনিয়োগের জন্য মার্কিন ব্যবসায়ী নেতাদের আমন্ত্রণ জানাই।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বাংলায় বক্তব্য
২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বিতর্ক পর্বে বাংলায় বক্তব্য দেওয়ার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের ফলে সৃষ্ট খাদ্য ও জ্বালানি সংকট এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তির জন্য অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অধিক পারস্পরিক সংহতি প্রদর্শন করার প্রতি গুরুত্বারোপ করি।
এসব সংকটের কারণে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশসমূহ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে বিশ্ব নেতাদের জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং পাল্টা নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করে আলোচনার মাধ্যমে সংকট ও বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাই। চলমান সংকট নিরসনে জাতির পিতার শান্তি ও উন্নয়নভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতির প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরি।
ফিলিস্তিনিদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত
ফিলিস্তিনিদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বরাবরের মতো এবারও সমর্থন জানায় বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বশান্তি অর্জনের লক্ষ্যে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ, সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ এবং জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা ও শান্তি বিনির্মাণ কার্যক্রমে বাংলাদেশের অঙ্গীকার এবং অংশগ্রহণের বিষয়টি তুলে ধরেছি। মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আমাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করি।
দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী অংশগ্রহণ
এবারের জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন চলাকালে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্লোভেনিয়ার রাষ্ট্রপতি, ইকুয়েডরের রাষ্ট্রপতি, কসোভোর রাষ্ট্রপতি, কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী, জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর, ইউএন হ্যাবিট্যাটের নির্বাহী পরিচালক, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মহাপরিচালক, ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের নির্বাহী চেয়ারম্যান এবং জাতিসংঘের মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠক।