ঢাকা ০৪:৫৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাদাম বিক্রেতা থেকে কোটিপতি কালীগঞ্জের নাসির

বিশেষ প্রতিনিধি

 

একসময় ছিলেন বাদাম বিক্রেতা। বাবার সম্পত্তি ছিল মাত্র ৪ শতক। গ্রামের বাজারে বাদাম বিক্রিসহ অন্যান্য জিনিস বিক্রি করতেন নাসির চৌধুরি। মাত্র ৮ম শ্রেণি পাশ করা এই নাসির এখন কোটিপতি। স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করে দিনের পর দিন জমি রেজিস্ট্রির নামে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এসব অতিরিক্ত টাকা আদায় করেছেন তিনি। এখন তিনি অঢেল সম্পদের মালিক। দুর্নীতির মাধ্যমে এসব সম্পদের খোঁজ পায় দুদক। করেন মামলাও। কিন্তু সেই মামলা অদৃশ্য কারণে চাপা পড়ে আছে। এ নিয়ে জনমনে উঠেছে প্রশ্ন।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার পুকুরিয়া গ্রামের দিনমজুর জমসের আলীর ছেলে নাসির চৌধুরি। বাবার ছিল মাত্র ৪ শতক জমি। এছাড়া মাঠে কোন চাষযোগ্য জমি ছিল না। বাবা জমশের আলী দিনমজুরের কাজ করতেন। আর নাসির গ্রামের বাজারে বাদাম বিক্রি করতেন। এরপর ৮ম শ্রেণি পাশ করা ভূয়া সনদ সংগ্রহ করেন নাসির। সেই ভূয়া সনদ দিয়ে নাম লেখান দলিল লেখক হিসেবে। এরপরই আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে থাকে নাসিরের।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৩০ বছর আগে কালীগঞ্জ সাব রেজিস্ট্রি অফিসে টি-বয় হিসেবে দিন হাজিরার চাকরি নেন। এরপর তৎকালীন সাব-রেজিস্ট্রার আলতাফ হোসেনের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠায় দলিল লেখকের লাইসেন্স পেয়ে যান নাসির। এরপর দ্রুতই ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটতে থাকে নাসিরের। নাম লেখান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নান ও দলীয় নেতাকর্মীদের ম্যানেজ করে দলিল লেখক সমিতির নিয়ন্ত্রণ নেয় নাসির। এরপর ওই সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়। টানা ৪র্থ বার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। ঝিনাইদহ-৪ আসনে সংসদ সদস্যের পরিবর্তন হয়। এমপি নির্বাচিত হন আনোয়ারুল আজীম আনার। তাকেও ম্যানেজ করে সমিতির কোন নির্বাচন না দিয়ে সাধারণ সম্পাদক পদ দখল করে রাখেন তিনি। আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন নাসির। এলাকায় গড়ে তোলেন নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। নিজের ইচ্ছামত সরকারি ফি ছাড়াও নেওয়া শুরু করেন অতিরিক্ত টাকা। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে ক্যাডার বাহিনী দিয়ে লাঞ্চিত ও মারধর করনেতন নাসির। গত প্রায় ২৫ বছর ধরে রেজিস্ট্রি অফিসে রাজত্ব করছেন এই নাসির। প্রশাসনের নাকের ডগায় এ অনিয়ম চললেও অতিরিক্ত টাকা দেওয়া থেকে প্রতিকার হয়নি সাধারণ মানুষের। তার হুকুম ছাড়া সাব-রেজিস্ট্রার কোন দলিলে স্বাক্ষর করেন না। এসব ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেক দলিল লেখক। কিন্তু কেউ ভয়ে মুখ খুলতে পারেন না। প্রতিবাদ করলেই নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ। এমপি আনারের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলার পর টানা দুইবার উপজেলার শিমলা-রোকনপুর ইউনিয়ন পরিষদের নৌকা প্রতিক নিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

অদৃশ্য কারণে চাপা পড়ে আছে দুদকের মামলা-

অবৈধপথে অর্থ উপার্জন করে একের পর এক আলিশান বাড়ি, দামি গাড়ি, শহরে ও মাঠে জমি এছাড়াও বিভিন্ন ব্যাংকে নামে বেনামে তিনি গড়ে তোলেন সম্পদ ও টাকার পাহাড়। একজন দলিল লেখক হয়ে বেপরোয়া চাঁদাবাজি, দুনীতি ও জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে অনুসন্ধানে নামে দুদক। দলিল লেখক নাসির চৌধুরির জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অর্জনের প্রমাণ পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরপর ২০২০ সালের ২৩ নভেম্বর দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় যশোরের সহকারী পরিচালক মোহা: মোশাররফ হোসেন বাদী হয়ে ঝিনাইদহ জেলা জজ আদালতে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা দায়ের করেন। দুদকের অনুসন্ধানে অভিযুক্ত নাসির ও তার উপর নির্ভরশীল ব্যক্তিবর্গের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে এফ.ডি.আর হিসেবে ৫ কোটি ৭০ লাখ ৭৩ হাজার ৪৪ টাকা জমা রাখার প্রমাণ পায়। এছাড়াও নাসিরের নামে ৫৯.২৭ বিঘা জমির সন্ধান পায় দুদক। এ মামলার পর দলিল লেখক নাসির চৌধুরি, তার দুই স্ত্রী এবং এক স্বজনের ১১টি ব্যাংক হিসাব জব্দ করার নির্দেশ দেয় আদালত। ২০২১ সালের ১১ জানুয়ারি ঝিনাইদহ সিনিয়র স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল জজ আদালতের বিচারক মো. আবু আহছান হাবিব এ আদেশ দেন।

আদালতের নির্দেশানুযায়ী, অবৈধভাবে টাকা উপার্জনের অভিযোগে করা মামলার প্রধান আসামি কালীগঞ্জ উপজেলার সিমলা-রোকনপুর ইউপির চেয়ারম্যান, একই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কালীগঞ্জ উপজেলা সাবরেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক নাসির উদ্দিন চৌধুরীর চারটি ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে সোনালী ব্যাংক কালীগঞ্জ শাখার একটি হিসাব, সাউথ-বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক কালীগঞ্জ শাখার একটি হিসাব, রূপালী ব্যাংক কালীগঞ্জ শাখার একটি হিসাব ও ব্রাক ব্যাংক যশোর শাখার একটি হিসাব রয়েছে।

এ ছাড়া তার এক স্ত্রী খোদেজা বেগমের ব্রাক ব্যাংকের দুটি হিসাব, দ্বিতীয় স্ত্রী মাহফুজা বেগমের সোনালী ব্যাংক যশোরের চুরামনকাঠি শাখার দুটি হিসাব জব্দ করা হয়। তালিকায় চেয়ারম্যানের এক স্বজন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কুলফডাঙ্গা গ্রামের মো. রেজাউল করিম জোয়ার্দ্দারের ছেলে মিকাইল হোসেন জোয়ার্দ্দারের ব্রাক ব্যাংক লিমিটেড যশোর শাখার তিনটি হিসাব রয়েছে। সব মিলিয়ে ওই চার ব্যক্তির ১১টি হিসাব জব্দ করা হয়। এরপর প্রায় ৪ বছর হয়ে গেলেও এ মামলার আর কোন অগ্রগতি নেই। অদৃশ্য কারণে চাপা পড়ে আছে সেই মামলা। হয়নি কোন চার্জশীট।

নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড়-

দুদকের প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, নাসির চৌধুরীর প্রথম স্ত্রী খোদেজা বেগমের নামে যশোরের আল আরাফা ব্যাংকে ৫০ লাখ টাকার ফিক্সড ডিপোজিট। যার ব্যাংক একাউন্ট নং ০৩০১৬২০০০১০২৫। ২০১৮ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ২৮শে জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংক স্টেটমেন্টে এই টাকার তথ্য পাওয়া গেছে। নাসির চৌধুরীর ২য় স্ত্রী মাহফুজা খাতুনের নামেও রাখা আছে ৫০ লাখ টাকা। ২০১৭ সালের ১৪ই মে যশোরের আল আরাফা ব্যাংকে ০৩০১৬২০০০১২৪৮নং হিসাব খোলা হয়। নাসির চৌধুরীর ব্র্যাক ব্যাংক যশোর শাখায় ৮টি হিসাব নাম্বারে লাখ লাখ টাকার তথ্য পেয়েছে অনুসন্ধানী দল। ব্র্যাক ব্যাংকের ২৪০১৩০২১১২৫৯৯০০২ নং হিসাবে ২০১৯ সালের ২৭শে মার্চ পর্যন্ত জমা ছিল ২০ লাখ টাকা। একই ব্যাংকের ২৪০১৩০২১১২৫৯৯০০৩ নং হিসাবে জমা ছিল ২১ লাখ ৫০ হাজার, ২৪০১৩০২১১২৫৯৯০০১ নং একাউন্টে ৩০ লাখ ৫০ হাজার, ২৪০১৩০২১১২৫৯৯০০৮ একাউন্টে ৭ লাখ ৫৯ হাজার ৯২০ টাকা, ২৪০১৩০২১১২৫৯৯০০৪ একাউন্টে ২ লাখ ১৬ হাজার ৬৩৪ টাকা, ২৪০১৩০২১১২৫৯৯০০৭ নং একাউন্টে ৬ লাখ ৬৩ হাজার ৬৫১ টাকা, ২৪০১৩০২১১২৫৯৯০০১ নং একাউন্টে ৫ লাখ ৮৫ হাজার ১৪২ টাকা ও ২৪০১৩০২১১২৫৯৯০০৬ নং একাউন্টে ৫০ হাজার টাকা। এছাড়া এবি ব্যাংকে মাহফুজা ও তার শ্যালক জিয়া কবীরের নামেও কোটি কোটি টাকা থাকতে পারে এমন গুজব রয়েছে এলাকায় মানুষের মুখে মুখে। তার কালীগঞ্জ শহরের আড়পাড়ায় ৩টি আলীশান বাড়ি, নদীপাড়ায় একটি ও কুল্ল্যাপাড়ায় একটি বাগান বাড়ি রয়েছে। এছাড়া শহরের নিশ্চিন্তপুর এলাকায় বেনামে দেড় কোটি টাকা দিয়ে ক্রয় করেছেন তিনতলা একটি ভবন। নাসিরের সম্পর্কে বিএন রাবেয়া বেগমের নামে এই ভবন ক্রয় করেন তিনি। এই ভবন দখলে নিতে যান নাসির ও তার ক্যাডার বাহিনী।

এলাকাবাসী জানায়, দলিল লেখক নাসির এলাকায় প্রায় ২০০ বিঘা জমির মালিক। কালীগঞ্জের বাবরা, পুকুরিয়া, তিল্লা, ডাকাতিয়া, এ্যাড়েখাল, মনোহরপুর, সিমলাসহ বিভিন্ন মাঠে এই জমি রয়েছে। গ্রামে কোন জমি বিক্রি হলে তার কারণে অন্য কেউ তার থেকে বেশি উচ্চ মূল্যে জমি কিনতে পারে না। তার কাছে জমি বিক্রি না করলে সেই ব্যাক্তিকে বিভিন্ন রকম ঝামেলাই ফেলে ও তার বাড়িতে সন্ত্রাসীদের দিয়ে হামলা করে থাকেন। তার গ্রামের কোন মেয়ে বাপের বাড়ির ফারাজী জমি বিক্রি করতে চাইলে জমির বাজার দামের অর্ধেক দাম দিয়ে সেই জমি কিনে তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে জোরপূর্বক দখল করে নেন নাসির। পিতার কাছ থেকে পাওয়া মাত্র ৪ শতক জমি থেকে নাসির চৌধুরী দুর্নীতি, চাঁদাবাজি করে কয়েক বছরে তিনি এখন কোটি কোটি টাকার জমির মালিক হয়েছেন।

পুকুরিয়া গ্রামের আজগর আলী সবুজদেশ নিউজকে বলেন, এলাকার বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে নাসির জোরপূর্বক জমি কিনেছে। অন্য কেউ জমি কিনতে চাইলে তাকে হুমকি দেওয়া হয়েছে। নাসির ছাড়া কেউ জমি কিনতে পারবে না। জমির দাম ৬ লাখ টাকা বিঘা হলে নাসির কিনেছে ২ লক্ষ টাকায়। এভাবে প্রায় ২০০ বিঘা জমির মালিক হয়েছে এই নাসির। আশে-পাশের মাঠে যা আছে সবই নাসিরের জমি।

এলাকায় গড়ে তোলেন ক্যাডার বাহিনী-

টাকা দিয়ে এলাকায় ক্যাডার বাহিনী পুষতেন নাসির। প্রতিদিন তার সাথে থাকলে পেতেন টাকা। সেই লোভে এলাকার বখাটে ছেলেদের দিয়ে গড়ে তোলেন ক্যাডার বাহিনী। তার মতের বিরুদ্ধে গেলই নেমে আসতো নির্যাতনের খড়গ। এমনকি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরও মারধর করা হয়েছে। বাড়িতে বোমার বিস্ফোরণ ঘটনো হয়েছে। নীরিহ মানুষকেও নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে অগণিত। বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা ছিল নিত্যদিনের কাজ। অস্ত্র দেখিয়ে ও বোমা মেরে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতো এই নাসির। পুকুরিয়া গ্রামের প্রায় অধিকাংশ মানুষকে তার ক্যাডার বাহিনী দিয়ে মারধর করেছে। এই ক্যাডার বাহিনীতে ছিল রাজু, সোহরাব, তফি, রবি, মোহন, ফয়সাল, মাসুমসহ প্রায় ২০ জনের একটি বাহিনী ছিল। তারা সবসময় নাসিরের সাথে মোটরসাইকেলে ঘোরাঘুরি করতো। এরাই এখন আবার বিএনপির রাজনীতিতে আসার চেষ্টা করছে। এছাড়াও বিচার-শালিসের মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে জোরপূর্বক টাকা নিতেন নাসির।

পুকুরিয়া গ্রামের আকাশ ইসলাম সবুজদেশ নিউজকে বলেন, তারা বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত। সাবেক চেয়ারম্যান নাসির ও তার ক্যাডার বাহিনীর হাতে গ্রামের অনেক নীরিহ মানুষ নির্যাতিত হয়েছে। তার মতের বাইরে গেলে মামলা-হামলা করা হতো। আমাকে ও তার চাচা বসিরকেও মারধর করা হয়েছে। এমনকি তার দলের লোকও ছাড় পাইনি। গ্রামের প্রায় প্রত্যেকটি পরিবারের লোক নাসিরের হাতে নির্যাতিত হয়েছে।

নজরুল ইসলাম নামে নাসিরের আরেক প্রতিবেশী সবুজদেশ নিউজকে বলেন, নাসির একই সাথে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। উনি চেয়ারম্যান হওয়ার পরে আওয়ামী লীগের লোকজনও রেহাই পাইনি। কোন কারণ ছাড়াই তাকেও মারধর করেছে নাসিরের লোকজন। যখন যা মন চাইতো তাই করতো নাসির ও তার লোকজন।

সুজন নামে এক যুবক সবুজদেশ নিউজকে বলেন, মোবারকগঞ্জ চিনিকলে একটা চাকরি দিয়েছল এমপি আনার সাহেব। এমপি আনার মারা যাওয়ার পর চেয়ারম্যান নাসির তার কাছ থেকে জোর করে ১৭ শতক জমি লিখে নিয়েছে। এখন চাকরির নিশ্চয়তাও নেই।

প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ম্যানেজ করে চলে জুলুম-

২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগে দু’গ্রুপে বিভক্ত হয়। এ সময় তখনকার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল মান্নান ও সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল আজীম আনার দুটি গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করতেন। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আব্দুল মান্নান দলীয় মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এই সময় নাসির ওই সংসদ সদস্যের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে সাব রেজিস্ট্রি অফিসের দায়িত্ব পান এবং জোরপূর্বক দলিল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদ দখল করেন। এরপর ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তখনকার সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল আজীম আনার। নাসিরও রাতারাতি পাল্টি দিয়ে ওই সংসদ সদস্যের কাছে ভীড়ে যান। হয়ে ওঠেন আস্থাভাজন। সরকারি ফির অতিরিক্ত ‘নাসির ট্যাক্স’ নামে একটি অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার রেওয়াজ চালু করেন। কেউ প্রতিবাদ করলেই এমপির দলীয় লোকজন ও নাসিরের ক্যাডার বাহিনী দিয়ে হুমকি দিয়ে বিষয়টি চাপিয়ে দেওয়া শুরু হয়। কেউ ভয়ে মুখ খুলতে পারে না। এ নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে সাংবাদিকদের আটকিয়ে রাখে নাসিরের ক্যাডার বাহিনী। এ কাজে নেতৃত্ব দেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আনিচুর রহমান মিঠু মালিথা ও তার ভাই সুন্দর আলী। তারা সেসময় নাসিরের ক্যাডার বাহিনী হিসেবে কাজ করতো। এভাবেই চলতে থাকে দলিল লেখক নাসিরের রাজত্ব। সাবেক সংসদ সদস্য আনারকে প্রায় ২৫ লাখ টাকা দিয়ো প্রাইভেটকারও উপহার দিয়েছেন এই নাসির। দুদকের মামলা থেকে বাঁচতে এমপি আনারকে নিয়ে যশোরে দুদকের সমন্বিত কার্যালয়ে যাওয়ার তথ্য চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রায় ২০০ জনকে টাকা দিতেন নাসির। এছাড়াও সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে মাসিক চুক্তিতে টাকা দিতেন তিনি। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আত্মগোপনে চলে যায় এক সময়ের প্রভাবশালী নাসির।

স্থানীয় সংবাদকর্মী ওসমান গনি জুয়েল সবুজদেশ নিউজকে বলেন, একদম উপজেলা পরিষদ চত্ত্বরের ভিতরে তিনি দিনের পর দিন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিতেন। কিন্তু প্রশাসন কোন পদক্ষেপও নেয়নি। এটার সাথে প্রশাসনও জড়িত ছিল। এই নাসিরের হাত থেকে সংবাদকর্মীরাও রেহাই পাইনি। এই নাসির সাংবাদিকদের অফিস ভাংচুরের ঘটনাও ঘটিয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে দলিল লেখক নাসিরকে মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিলেও সেটি রিসিভ হয়নি। পরে ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও তিনি কোন সাড়া দেননি।

ঝিনাইদহ দুদকের সমন্বিত কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক বজলুর রশিদ সবুজদেশ নিউজকে বলেন, কিছুদিন আগে মামলার কাগজপত্র পেয়েছি। মামলাটি তদন্তনাধীন রয়েছে। ২/১ মাসের মধ্যেই মামলার চার্জশীট দেওয়া হবে।

সবুজদেশ/এসএএস

About Author Information
আপডেট সময় : ১২:৪৬:৫৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪
২৯৮ Time View

বাদাম বিক্রেতা থেকে কোটিপতি কালীগঞ্জের নাসির

আপডেট সময় : ১২:৪৬:৫৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪

 

একসময় ছিলেন বাদাম বিক্রেতা। বাবার সম্পত্তি ছিল মাত্র ৪ শতক। গ্রামের বাজারে বাদাম বিক্রিসহ অন্যান্য জিনিস বিক্রি করতেন নাসির চৌধুরি। মাত্র ৮ম শ্রেণি পাশ করা এই নাসির এখন কোটিপতি। স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করে দিনের পর দিন জমি রেজিস্ট্রির নামে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এসব অতিরিক্ত টাকা আদায় করেছেন তিনি। এখন তিনি অঢেল সম্পদের মালিক। দুর্নীতির মাধ্যমে এসব সম্পদের খোঁজ পায় দুদক। করেন মামলাও। কিন্তু সেই মামলা অদৃশ্য কারণে চাপা পড়ে আছে। এ নিয়ে জনমনে উঠেছে প্রশ্ন।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার পুকুরিয়া গ্রামের দিনমজুর জমসের আলীর ছেলে নাসির চৌধুরি। বাবার ছিল মাত্র ৪ শতক জমি। এছাড়া মাঠে কোন চাষযোগ্য জমি ছিল না। বাবা জমশের আলী দিনমজুরের কাজ করতেন। আর নাসির গ্রামের বাজারে বাদাম বিক্রি করতেন। এরপর ৮ম শ্রেণি পাশ করা ভূয়া সনদ সংগ্রহ করেন নাসির। সেই ভূয়া সনদ দিয়ে নাম লেখান দলিল লেখক হিসেবে। এরপরই আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে থাকে নাসিরের।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৩০ বছর আগে কালীগঞ্জ সাব রেজিস্ট্রি অফিসে টি-বয় হিসেবে দিন হাজিরার চাকরি নেন। এরপর তৎকালীন সাব-রেজিস্ট্রার আলতাফ হোসেনের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠায় দলিল লেখকের লাইসেন্স পেয়ে যান নাসির। এরপর দ্রুতই ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটতে থাকে নাসিরের। নাম লেখান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নান ও দলীয় নেতাকর্মীদের ম্যানেজ করে দলিল লেখক সমিতির নিয়ন্ত্রণ নেয় নাসির। এরপর ওই সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়। টানা ৪র্থ বার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। ঝিনাইদহ-৪ আসনে সংসদ সদস্যের পরিবর্তন হয়। এমপি নির্বাচিত হন আনোয়ারুল আজীম আনার। তাকেও ম্যানেজ করে সমিতির কোন নির্বাচন না দিয়ে সাধারণ সম্পাদক পদ দখল করে রাখেন তিনি। আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন নাসির। এলাকায় গড়ে তোলেন নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। নিজের ইচ্ছামত সরকারি ফি ছাড়াও নেওয়া শুরু করেন অতিরিক্ত টাকা। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে ক্যাডার বাহিনী দিয়ে লাঞ্চিত ও মারধর করনেতন নাসির। গত প্রায় ২৫ বছর ধরে রেজিস্ট্রি অফিসে রাজত্ব করছেন এই নাসির। প্রশাসনের নাকের ডগায় এ অনিয়ম চললেও অতিরিক্ত টাকা দেওয়া থেকে প্রতিকার হয়নি সাধারণ মানুষের। তার হুকুম ছাড়া সাব-রেজিস্ট্রার কোন দলিলে স্বাক্ষর করেন না। এসব ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেক দলিল লেখক। কিন্তু কেউ ভয়ে মুখ খুলতে পারেন না। প্রতিবাদ করলেই নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ। এমপি আনারের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলার পর টানা দুইবার উপজেলার শিমলা-রোকনপুর ইউনিয়ন পরিষদের নৌকা প্রতিক নিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

অদৃশ্য কারণে চাপা পড়ে আছে দুদকের মামলা-

অবৈধপথে অর্থ উপার্জন করে একের পর এক আলিশান বাড়ি, দামি গাড়ি, শহরে ও মাঠে জমি এছাড়াও বিভিন্ন ব্যাংকে নামে বেনামে তিনি গড়ে তোলেন সম্পদ ও টাকার পাহাড়। একজন দলিল লেখক হয়ে বেপরোয়া চাঁদাবাজি, দুনীতি ও জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে অনুসন্ধানে নামে দুদক। দলিল লেখক নাসির চৌধুরির জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অর্জনের প্রমাণ পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরপর ২০২০ সালের ২৩ নভেম্বর দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় যশোরের সহকারী পরিচালক মোহা: মোশাররফ হোসেন বাদী হয়ে ঝিনাইদহ জেলা জজ আদালতে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা দায়ের করেন। দুদকের অনুসন্ধানে অভিযুক্ত নাসির ও তার উপর নির্ভরশীল ব্যক্তিবর্গের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে এফ.ডি.আর হিসেবে ৫ কোটি ৭০ লাখ ৭৩ হাজার ৪৪ টাকা জমা রাখার প্রমাণ পায়। এছাড়াও নাসিরের নামে ৫৯.২৭ বিঘা জমির সন্ধান পায় দুদক। এ মামলার পর দলিল লেখক নাসির চৌধুরি, তার দুই স্ত্রী এবং এক স্বজনের ১১টি ব্যাংক হিসাব জব্দ করার নির্দেশ দেয় আদালত। ২০২১ সালের ১১ জানুয়ারি ঝিনাইদহ সিনিয়র স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল জজ আদালতের বিচারক মো. আবু আহছান হাবিব এ আদেশ দেন।

আদালতের নির্দেশানুযায়ী, অবৈধভাবে টাকা উপার্জনের অভিযোগে করা মামলার প্রধান আসামি কালীগঞ্জ উপজেলার সিমলা-রোকনপুর ইউপির চেয়ারম্যান, একই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কালীগঞ্জ উপজেলা সাবরেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক নাসির উদ্দিন চৌধুরীর চারটি ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে সোনালী ব্যাংক কালীগঞ্জ শাখার একটি হিসাব, সাউথ-বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক কালীগঞ্জ শাখার একটি হিসাব, রূপালী ব্যাংক কালীগঞ্জ শাখার একটি হিসাব ও ব্রাক ব্যাংক যশোর শাখার একটি হিসাব রয়েছে।

এ ছাড়া তার এক স্ত্রী খোদেজা বেগমের ব্রাক ব্যাংকের দুটি হিসাব, দ্বিতীয় স্ত্রী মাহফুজা বেগমের সোনালী ব্যাংক যশোরের চুরামনকাঠি শাখার দুটি হিসাব জব্দ করা হয়। তালিকায় চেয়ারম্যানের এক স্বজন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কুলফডাঙ্গা গ্রামের মো. রেজাউল করিম জোয়ার্দ্দারের ছেলে মিকাইল হোসেন জোয়ার্দ্দারের ব্রাক ব্যাংক লিমিটেড যশোর শাখার তিনটি হিসাব রয়েছে। সব মিলিয়ে ওই চার ব্যক্তির ১১টি হিসাব জব্দ করা হয়। এরপর প্রায় ৪ বছর হয়ে গেলেও এ মামলার আর কোন অগ্রগতি নেই। অদৃশ্য কারণে চাপা পড়ে আছে সেই মামলা। হয়নি কোন চার্জশীট।

নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড়-

দুদকের প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, নাসির চৌধুরীর প্রথম স্ত্রী খোদেজা বেগমের নামে যশোরের আল আরাফা ব্যাংকে ৫০ লাখ টাকার ফিক্সড ডিপোজিট। যার ব্যাংক একাউন্ট নং ০৩০১৬২০০০১০২৫। ২০১৮ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ২৮শে জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংক স্টেটমেন্টে এই টাকার তথ্য পাওয়া গেছে। নাসির চৌধুরীর ২য় স্ত্রী মাহফুজা খাতুনের নামেও রাখা আছে ৫০ লাখ টাকা। ২০১৭ সালের ১৪ই মে যশোরের আল আরাফা ব্যাংকে ০৩০১৬২০০০১২৪৮নং হিসাব খোলা হয়। নাসির চৌধুরীর ব্র্যাক ব্যাংক যশোর শাখায় ৮টি হিসাব নাম্বারে লাখ লাখ টাকার তথ্য পেয়েছে অনুসন্ধানী দল। ব্র্যাক ব্যাংকের ২৪০১৩০২১১২৫৯৯০০২ নং হিসাবে ২০১৯ সালের ২৭শে মার্চ পর্যন্ত জমা ছিল ২০ লাখ টাকা। একই ব্যাংকের ২৪০১৩০২১১২৫৯৯০০৩ নং হিসাবে জমা ছিল ২১ লাখ ৫০ হাজার, ২৪০১৩০২১১২৫৯৯০০১ নং একাউন্টে ৩০ লাখ ৫০ হাজার, ২৪০১৩০২১১২৫৯৯০০৮ একাউন্টে ৭ লাখ ৫৯ হাজার ৯২০ টাকা, ২৪০১৩০২১১২৫৯৯০০৪ একাউন্টে ২ লাখ ১৬ হাজার ৬৩৪ টাকা, ২৪০১৩০২১১২৫৯৯০০৭ নং একাউন্টে ৬ লাখ ৬৩ হাজার ৬৫১ টাকা, ২৪০১৩০২১১২৫৯৯০০১ নং একাউন্টে ৫ লাখ ৮৫ হাজার ১৪২ টাকা ও ২৪০১৩০২১১২৫৯৯০০৬ নং একাউন্টে ৫০ হাজার টাকা। এছাড়া এবি ব্যাংকে মাহফুজা ও তার শ্যালক জিয়া কবীরের নামেও কোটি কোটি টাকা থাকতে পারে এমন গুজব রয়েছে এলাকায় মানুষের মুখে মুখে। তার কালীগঞ্জ শহরের আড়পাড়ায় ৩টি আলীশান বাড়ি, নদীপাড়ায় একটি ও কুল্ল্যাপাড়ায় একটি বাগান বাড়ি রয়েছে। এছাড়া শহরের নিশ্চিন্তপুর এলাকায় বেনামে দেড় কোটি টাকা দিয়ে ক্রয় করেছেন তিনতলা একটি ভবন। নাসিরের সম্পর্কে বিএন রাবেয়া বেগমের নামে এই ভবন ক্রয় করেন তিনি। এই ভবন দখলে নিতে যান নাসির ও তার ক্যাডার বাহিনী।

এলাকাবাসী জানায়, দলিল লেখক নাসির এলাকায় প্রায় ২০০ বিঘা জমির মালিক। কালীগঞ্জের বাবরা, পুকুরিয়া, তিল্লা, ডাকাতিয়া, এ্যাড়েখাল, মনোহরপুর, সিমলাসহ বিভিন্ন মাঠে এই জমি রয়েছে। গ্রামে কোন জমি বিক্রি হলে তার কারণে অন্য কেউ তার থেকে বেশি উচ্চ মূল্যে জমি কিনতে পারে না। তার কাছে জমি বিক্রি না করলে সেই ব্যাক্তিকে বিভিন্ন রকম ঝামেলাই ফেলে ও তার বাড়িতে সন্ত্রাসীদের দিয়ে হামলা করে থাকেন। তার গ্রামের কোন মেয়ে বাপের বাড়ির ফারাজী জমি বিক্রি করতে চাইলে জমির বাজার দামের অর্ধেক দাম দিয়ে সেই জমি কিনে তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে জোরপূর্বক দখল করে নেন নাসির। পিতার কাছ থেকে পাওয়া মাত্র ৪ শতক জমি থেকে নাসির চৌধুরী দুর্নীতি, চাঁদাবাজি করে কয়েক বছরে তিনি এখন কোটি কোটি টাকার জমির মালিক হয়েছেন।

পুকুরিয়া গ্রামের আজগর আলী সবুজদেশ নিউজকে বলেন, এলাকার বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে নাসির জোরপূর্বক জমি কিনেছে। অন্য কেউ জমি কিনতে চাইলে তাকে হুমকি দেওয়া হয়েছে। নাসির ছাড়া কেউ জমি কিনতে পারবে না। জমির দাম ৬ লাখ টাকা বিঘা হলে নাসির কিনেছে ২ লক্ষ টাকায়। এভাবে প্রায় ২০০ বিঘা জমির মালিক হয়েছে এই নাসির। আশে-পাশের মাঠে যা আছে সবই নাসিরের জমি।

এলাকায় গড়ে তোলেন ক্যাডার বাহিনী-

টাকা দিয়ে এলাকায় ক্যাডার বাহিনী পুষতেন নাসির। প্রতিদিন তার সাথে থাকলে পেতেন টাকা। সেই লোভে এলাকার বখাটে ছেলেদের দিয়ে গড়ে তোলেন ক্যাডার বাহিনী। তার মতের বিরুদ্ধে গেলই নেমে আসতো নির্যাতনের খড়গ। এমনকি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরও মারধর করা হয়েছে। বাড়িতে বোমার বিস্ফোরণ ঘটনো হয়েছে। নীরিহ মানুষকেও নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে অগণিত। বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা ছিল নিত্যদিনের কাজ। অস্ত্র দেখিয়ে ও বোমা মেরে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতো এই নাসির। পুকুরিয়া গ্রামের প্রায় অধিকাংশ মানুষকে তার ক্যাডার বাহিনী দিয়ে মারধর করেছে। এই ক্যাডার বাহিনীতে ছিল রাজু, সোহরাব, তফি, রবি, মোহন, ফয়সাল, মাসুমসহ প্রায় ২০ জনের একটি বাহিনী ছিল। তারা সবসময় নাসিরের সাথে মোটরসাইকেলে ঘোরাঘুরি করতো। এরাই এখন আবার বিএনপির রাজনীতিতে আসার চেষ্টা করছে। এছাড়াও বিচার-শালিসের মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে জোরপূর্বক টাকা নিতেন নাসির।

পুকুরিয়া গ্রামের আকাশ ইসলাম সবুজদেশ নিউজকে বলেন, তারা বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত। সাবেক চেয়ারম্যান নাসির ও তার ক্যাডার বাহিনীর হাতে গ্রামের অনেক নীরিহ মানুষ নির্যাতিত হয়েছে। তার মতের বাইরে গেলে মামলা-হামলা করা হতো। আমাকে ও তার চাচা বসিরকেও মারধর করা হয়েছে। এমনকি তার দলের লোকও ছাড় পাইনি। গ্রামের প্রায় প্রত্যেকটি পরিবারের লোক নাসিরের হাতে নির্যাতিত হয়েছে।

নজরুল ইসলাম নামে নাসিরের আরেক প্রতিবেশী সবুজদেশ নিউজকে বলেন, নাসির একই সাথে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। উনি চেয়ারম্যান হওয়ার পরে আওয়ামী লীগের লোকজনও রেহাই পাইনি। কোন কারণ ছাড়াই তাকেও মারধর করেছে নাসিরের লোকজন। যখন যা মন চাইতো তাই করতো নাসির ও তার লোকজন।

সুজন নামে এক যুবক সবুজদেশ নিউজকে বলেন, মোবারকগঞ্জ চিনিকলে একটা চাকরি দিয়েছল এমপি আনার সাহেব। এমপি আনার মারা যাওয়ার পর চেয়ারম্যান নাসির তার কাছ থেকে জোর করে ১৭ শতক জমি লিখে নিয়েছে। এখন চাকরির নিশ্চয়তাও নেই।

প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ম্যানেজ করে চলে জুলুম-

২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগে দু’গ্রুপে বিভক্ত হয়। এ সময় তখনকার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল মান্নান ও সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল আজীম আনার দুটি গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করতেন। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আব্দুল মান্নান দলীয় মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এই সময় নাসির ওই সংসদ সদস্যের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে সাব রেজিস্ট্রি অফিসের দায়িত্ব পান এবং জোরপূর্বক দলিল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদ দখল করেন। এরপর ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তখনকার সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল আজীম আনার। নাসিরও রাতারাতি পাল্টি দিয়ে ওই সংসদ সদস্যের কাছে ভীড়ে যান। হয়ে ওঠেন আস্থাভাজন। সরকারি ফির অতিরিক্ত ‘নাসির ট্যাক্স’ নামে একটি অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার রেওয়াজ চালু করেন। কেউ প্রতিবাদ করলেই এমপির দলীয় লোকজন ও নাসিরের ক্যাডার বাহিনী দিয়ে হুমকি দিয়ে বিষয়টি চাপিয়ে দেওয়া শুরু হয়। কেউ ভয়ে মুখ খুলতে পারে না। এ নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে সাংবাদিকদের আটকিয়ে রাখে নাসিরের ক্যাডার বাহিনী। এ কাজে নেতৃত্ব দেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আনিচুর রহমান মিঠু মালিথা ও তার ভাই সুন্দর আলী। তারা সেসময় নাসিরের ক্যাডার বাহিনী হিসেবে কাজ করতো। এভাবেই চলতে থাকে দলিল লেখক নাসিরের রাজত্ব। সাবেক সংসদ সদস্য আনারকে প্রায় ২৫ লাখ টাকা দিয়ো প্রাইভেটকারও উপহার দিয়েছেন এই নাসির। দুদকের মামলা থেকে বাঁচতে এমপি আনারকে নিয়ে যশোরে দুদকের সমন্বিত কার্যালয়ে যাওয়ার তথ্য চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রায় ২০০ জনকে টাকা দিতেন নাসির। এছাড়াও সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে মাসিক চুক্তিতে টাকা দিতেন তিনি। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আত্মগোপনে চলে যায় এক সময়ের প্রভাবশালী নাসির।

স্থানীয় সংবাদকর্মী ওসমান গনি জুয়েল সবুজদেশ নিউজকে বলেন, একদম উপজেলা পরিষদ চত্ত্বরের ভিতরে তিনি দিনের পর দিন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিতেন। কিন্তু প্রশাসন কোন পদক্ষেপও নেয়নি। এটার সাথে প্রশাসনও জড়িত ছিল। এই নাসিরের হাত থেকে সংবাদকর্মীরাও রেহাই পাইনি। এই নাসির সাংবাদিকদের অফিস ভাংচুরের ঘটনাও ঘটিয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে দলিল লেখক নাসিরকে মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিলেও সেটি রিসিভ হয়নি। পরে ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও তিনি কোন সাড়া দেননি।

ঝিনাইদহ দুদকের সমন্বিত কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক বজলুর রশিদ সবুজদেশ নিউজকে বলেন, কিছুদিন আগে মামলার কাগজপত্র পেয়েছি। মামলাটি তদন্তনাধীন রয়েছে। ২/১ মাসের মধ্যেই মামলার চার্জশীট দেওয়া হবে।

সবুজদেশ/এসএএস