বাবা করেছিল স্বাধীনতা যুদ্ধ, ছেলে নেমেছে করোনা যুদ্ধে
ঝিনাইদহঃ
বাবা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশ স্বাধীনের যুদ্ধে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে দেশ স্বাধীন করে পেয়েছিলেন জাতীয় বীরের মর্যাদা। এখন ছেলে যুদ্ধে নেমেছে অদৃশ্য করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে।
এ গল্প ঝিনাইদহ জেলা শহরের কানঞ্চনপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহাদৎ হোসেন ও তার ছেলে ডা. লিমন পারভেজের।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে মৃত্যুর ঝুঁকি আছে জেনেও পরিবার পরিজন রেখে নেমেছেন করোনা যুদ্ধে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনরাত রোগীর সেবা দিয়ে যাচ্ছেন ডা. লিমন পারভেজ।
আর এদিকে ছেলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের সেবায় কাজ করছেন। এ কাজ করতে গিয়ে শহীদও হতে পারেন আদরের সন্তান। সবকিছু জেনেও সন্তানের জন্য গর্ববোধ করেন। তার মতো ছেলেও যুদ্ধ জয় করে ঘরে ফিরবেন বলে প্রত্যাশা ডা. লিমন পারভেজের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহাদৎ হোসেনের।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহাদৎ হোসেন জানান, একটু সচেতন হলেই করোনা থেকে দূরে থাকা সম্ভব। কিন্তু অনেক রোগী তথ্য গোপন করে চিকিৎসা নিতে আসছেন। কোথা থেকে কখন কী হয়ে যায় এটা নিয়ে আমরা একটু চিন্তিত। তারপরও সন্তানকে বলি তুমি কখনও ভয় পাবে না। সব সময় মন শক্ত রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। তোমার পাশে আমরা আছি।
ছেলেকে সব সময় বলি, লিমন তুমি আমার সন্তান। আমরা যেমন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি ঠিক তেমনি তুমি এক যুদ্ধে নেমেছ। তুমি ডাক্তার হয়েছ মানুষের সেবা করার জন্য, দুস্থ অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। যেকোনো দুর্যোগকালে, জাতীয় সংকটকালে মানুষের পাশে থেকে কাজ করতে হবে তোমাকে। যেভাবে আমি দেশ স্বাধীন করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম। আমার সন্তান হিসেবে তুমি সেভাবেই দেশের জন্য কাজ করে যাবে। আমরা যুদ্ধ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছি। তুমি দেশের সংকটময় এ মুহূর্তে করোনাযুদ্ধ জয় করে ঘরে ফিরবে এমন আশায় বুক বেধে বসে আছি।
ডা. লিমন পারভেজের মা মিসেস নাসিমা হোসেন জানান, বাংলাদেশে যখন করোনা শুরু হয়, সেসময় থেকেই পরিবারের সবার কথা চিন্তা করে লিমন তার ১৫ মাসের সন্তান শেহজাদ পারভেজ ও স্ত্রী ইশরাত আযম তিশাকে যশোরে তার বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। এমনকি ছেলেও আমাদের থেকে আলাদা থাকার চেষ্টা করে। ঝিনাইদহে যখন প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় তারপর থেকে ছেলে আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে না বললেই চলে। আমরা আমাদের বাড়ির দ্বিতীয় তলায় থাকি আর ছেলে অনেকদিন হয়ে গেল নিচতলাই একটি রুমে একা থাকে। হাসপাতাল থেকে বাড়িতে এসে আলাদাভাবেই তার রুমে চলে যায়। এরপর তার জামা কাপড় নিজে নিজেই সব পরিষ্কার করে। কতদিন হয়ে গেল ছেলে আমাদের সঙ্গে খাবারও খায় না। আমি নিজে গিয়ে নিচের রুমে দূর থেকে তাকে খাবার দিয়ে চলে আসি। সন্তান কাছে থেকেও দূরে, এটাযে কতটা কষ্ট বলে বোঝাতে পারব না।
তিনি বলেন, ছেলেকে যুদ্ধে পাঠিয়ে আতঙ্কের মধ্যে থাকি। আবার নিজের মনকে শক্ত করি। দেশের যে অবস্থা কেউ করোনা আক্রান্ত হলে তার পরিবার পর্যন্ত তার পাশে থাকছে না। এমন সময় তাদের একমাত্র ভরসা ডাক্তার। আমি ভাবি তারাও তো কোনো না কোনো মায়ের সন্তান। তাদের পাশে আমার ছেলেকে যদি না পাঠাই তাহলে কিভাবে সুস্থ হয়ে মায়ের বুকে ফিরে যাবে তারা। এ যুদ্ধে লিমনের মনবল শক্ত করার জন্য তাকে বলি নিজের ভাই বা বোন ভেবে তুমি রোগীদের সেবা করবে। কোনোভাবেই যেন তাদের পাশ থেকে পিছিয়ে আসবা না। মায়ের দোয়া তোমার সাথে সব সময় আছে।
ডা. লিমন পারভেজ জানান, তিনি পরিবারের সুরক্ষার কথা ভেবে পরিবার থেকে নিজেকে আলাদা রেখেছেন। কয়েক মাস হয়ে গেল পরিবারের কাছে যান না তিনি।
তিনি বলেন, ১৫ মাসের সন্তান ও স্ত্রীকে পাঠিয়ে দিয়েছি শ্বশুরবাড়িতে। মাঝে মাঝে ভিডিও কলে কথা হয় স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে। ভিডিও কলে আমাকে দেখেই কোলে আসার জন্য দুহাত বাড়িয়ে দেয় আমার সন্তান। কিন্তু কিছুই করার নেই। তাকে একটু কোলে নিতে পারি না। বাবা হয়ে সন্তানকে একটু কোলে নিতে পারছি না। এটা যে কত যন্ত্রণা, কত কষ্টের কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। সবাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন দেশের মানুষের কথা ভেবে এ যুদ্ধে যখন নেমেছি ইনশাআল্লাহ সফল হবই।