বিদেশী আগ্রা পোল্ট্রি নীতি ও মুরগির মাংস না খাওয়ার কারণে পোল্ট্রিশিল্প ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে।)
নিজস্য প্রতিবেদক ( শিপলু জামান ) ঃ আমাদের দেশে পোল্ট্রি শিল্প আশির দশকে শুরু হলেও মুলত ২০০০ সালের পর থেকে এর বিস্তার লাভ করে। দেশের ১৮ কোটি মানুষের প্রোটিনের চাহিদা মেটানোর জন্য মুরগী উৎপাদনের কোন বিকল্প নেই। তাছাড়া বেকার সমস্যা দূরীকরণেরও এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা অনস্বীকার্য হয়ে পড়েছে। বর্তমানে এই শিল্প প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে প্রায় দেড় কোটি লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে।
এই শিল্প ধ্বংস হওয়ার কারণ গুলির মধ্যে রয়েছে চাহিদার তুলনায় অধিক উৎপাদন, উৎপাদিত মুরগীর ভোক্তা না থাকা, বিদেশে রপ্তানী না করা, শুধুমাত্র রান্না মাংস হিসেবে ব্যবহার করা। উৎপাদিত মুরগীর সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্য না থাকা, তাছাড়া সঠিক পরিসংখ্যানের মাধ্যমে চাহিদা অনুযায়ী মুরগী বাচ্চা উৎপাদন না করা।
আমরা জানি, এদেশের মানুষ দারিদ্রতার কারণে মুরগীর মাংস খেতে পারে না। কিন্তু বিষয়টি সম্পূর্ণ উল্টো। মুরগীর মাংস খায় না বিধায়, এদেশের মানুষ গরীব থেকে উত্তোরণ হতে পারছে না। প্রতিটি মানুষের শারীরিক গঠনের জন্য চাহিদামত মুরগীর মাংস খেলে প্রোটিনের অভাব পূরণের মাধ্যমে ইলেকট্রো কেমিক্যাল তৈরী হবে। ইলেকট্রো কেমিক্যাল তৈরী হলে নিউরো ট্রান্সমিটার সঠিক ভাবে কাজ করবে। এতে মানুষের বুদ্ধির বিকাশ ঘটবে এবং কাজের স্পৃহা বাড়বে। প্রোটিনের অভাবে সঠিক ভাবে মস্তিস্ক কাজ না করায় মানুষ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। একারণেই এদেশের মানুষ গরীব থেকে উত্তোরন হতে পারছে না। উন্নত দেশে সঠিক পরিমাণে মুরগী মাংস খাওয়ার কারণেই, বুদ্ধিতে মানুষ অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া পোল্ট্রি মুরগী মাংস শুধু প্রোটিনের চাহিদাই পূরণ করে না। এটি পরিপূরক ও সুষম খাদ্য হিসাবেও কাজ করে। উন্নত বিশ্বে যেমন কানাডা, জাপান, আমেরিকা বৎসরে একজন মানুষ গড়ে মাংস খায় প্রায় ৪২ থেকে ৪৪ কেজি। মালয়েশিয়া মাথা প্রতি বছরে মুরগীর মাংস খাচ্ছে ৪০ কেজি। সেখানে আমাদের দেশে প্রতিজন মুরগীর মাংস যায় মাত্র ৪ থেকে ৫ কেজি।
বর্তমানে বাংলাদেশের ব্রয়লার এবং লেয়ার বাচ্চা উৎপাদনকারী হ্যাচারীর সংখ্যা প্রায় ৭০ থেকে ৮০ টি। আমাদের দেশে শুধু ব্রয়লার বাচ্চা উৎপাদন হচ্ছে প্রতিদিন প্রায় ২০ লক্ষ পিস। যা দিয়ে মাংস উৎপাদন হচ্ছে প্রায় তিন হাজার টন কিন্তু প্রতিদিন চাহিদা আছে মাত্র দুই হাজার টন। বর্তমান প্রতিদিন উৎপাদন বেশি প্রতি প্রায় এক হাজার টন। একারণেই উৎপাদনকারী দীর্ঘদিন ধরে ব্রয়লার মুরগীর দাম পাচ্ছে না।
উন্নত দেশের মানুষ আমাদের দেশের তুলনায় মুরগীর মাংস খায় ৮ থেকে ৯ গুন বেশী। ডিম খায় ৭ থেকে ৮ গুণ বেশী। দেশে মুরগীর মাংস এবং ডিমের চাহিদা এত কম থাকা স্বত্ত্বেও দেশে ভ্রান্তনীতির কারণে ইতোমধ্যে বিদেশী কোম্পানী ও দেশে প্রবেশ করে পোল্ট্রি ধ্বংস করার জন্য জোরে-সোরে ব্রয়লার বাচ্চা, ডিম ও কমার্শিয়াল মুরগী উৎপাদন শুরু করেছে। এর মধ্যে উল্লেখ্য যোগ্য হচ্ছে থাইল্যান্ড কোং সিপি বাংলাদেশ, চায়নার নিউহোপ, ইন্দোনেশিয়ার জাফপা এবং ভারতের সগুনা ও ভেনকিজ। বিদেশী এই সমস্ত কোম্পানি গুলো সপ্তাহে বাচ্চা উৎপাদন করছে প্রায় চল্লিশ লক্ষ পিচ।
বাংলাদেশে প্যারেন্টস্ ফার্মের প্যারেন্ট উৎপাদন ক্ষমতা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। এ কারণে গত প্রায় বিশ বৎসর প্রতি প্যারেন্ট ষ্টক ১ দিনের বাচ্চা উৎপাদন খরচ সর্বোচ্চ ১৬০ থেকে ১৮০ টাকা হলেও হ্যাচারীদের নিকট প্রতিটি বাচ্চা বিক্রী করছে ২৮০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত। এতে প্রতিটি বাচ্চায় লাভ করে থাকে ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা। অথচ ব্রয়লার বাচ্চা উৎপাদন খরচ ৩২ টাকা থেকে ৩৩ টাকা হলেও বিদেশী আগ্রাসন এবং অধিক উৎপাদনের কারণে গত প্রায় দেড় বৎসরের বেশী ধরে (১ জুলাই ২০১৭ থেকে এই পর্যন্ত) ব্রয়লার বাচ্চা বিক্রয় হচ্ছে মাত্র ১৫ টাকা থেকে ২০ টাকা। এই বিরাট লোকসানের কারণে কিছু হ্যাচারী ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে, বাকী গুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে। তাছাড়া বাচ্চা উৎপাদনকারী হ্যাচারী গুলো কৃষি ভিত্তিক হলেও ব্যাংক ঋণের লভ্যাংশ ও বিদ্যুৎ বিল বাণিজ্যিক হারে নেওয়া হচ্ছে।
এদেশে বেকারত্ব দূরীকরণের ক্ষেত্রে গার্মেন্টস শিল্প থেকে পোল্ট্রি শিল্পও কম গুরুত্ব বহন করে না। কারণ পোল্ট্রি শিল্প ধ্বংস হলে কোটি মানুষ যেমন বেকার হবে, তেমনই ভাবে প্রোটিনের চাহিদা পূরণের জন্য গরুর মত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে বিদেশ থেকে পোল্ট্রি মুরগী ও ডিম আমদানী করতে হবে।
এই শিল্প সরকারের সঠিক নজরদারীর মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে পোল্ট্রিনীতি বাস্তবায়ন করতে হবে। বর্তমানে ১ কেজি খাসীর মাংসের দাম ৭০০ টাকা, ১ কেজি গরু মাংসের দাম ৪৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা দরে বিক্রী হলেও ১কেজি পোল্ট্রি মুরগীর খরচ মূল্য মাত্র ১০০ টাকা থেকে ১১০ টাকা। গত প্রায় ২০ বৎসর আগে মুরগী মাংস বিক্রি হতো ৭০ টাকা থেকে ৮০ টাকায়। গত ২০ বৎসর আগে মুরগীর খাবার, ভ্যাকসিন, ঔষধ সরঞ্জামাদির দাম ৫ থেকে ১০ গুন বেড়েছে। এছাড়া জনশক্তির মূল্য বেড়েছে ৫ গুণ। কিন্তু দুঃখের বিষয় গত ২০ বৎসরে মুরগীর চাহিদা না বাড়ায় দামের তেমন কোন পরিবর্তনই হয়নি।
মুরগী উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে বেশী খাবারের উপকরণ হিসাবে ব্যবহার হয় ভূট্টা, সয়াবিন কেক, লাইম ষ্টোন, গমভূষি, সয়াবিন তেল, ডিসিপি, রাইচ পালিশ, লবন, এনজাইম টকসিন বাইন্ডার, এমাইনো এসিড এবং বিভিন্ন ফাইটেস। চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন দামী ঔষধ ব্যবহার করতে হয়। যেমনঃ এনরোফ্লক্সাসিন, সিপ্্েরাফ্লক্সাসিন, এমক্সাসিলিন, নিউমাইসিন, অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, টাইলোসিন ইত্যাদি। ভ্যাকসিন হিসাবে রানীক্ষেতের জন্য রানীক্ষেত ভ্যাকসিন, গামবুরার জন্য গামবুরা ভ্যাকসিন, কোরাইজার জন্য কোরাইজা ভ্যাকসিন কলেরার জন্য কলেরা ভ্যাকসিন, বার্ড ফ্লু রোগের বার্ডফ্লু ভ্যাকসিন ইত্যাদি।
এই সমস্ত খাদ্য উপাদান, মেডিসিন এবং ভ্যাকসিনের মূল্য গত ২০ বৎসরে ৫ থেকে ৭ গুণ বেশী বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ গত ২০ বৎসরে উৎপাদিত বাচ্চার মূল্য তেমন বৃদ্ধি পায়নি। সরকারের নজর না দেওয়ায় হাজারও সমস্যায় জর্জরিত এই পোল্ট্রি শিল্প এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। যে কোন মূল্যে বাধা গুলো নিরসন না করা গেলে বিদেশি আগ্রাসনের চাহিদার তুলনায় অনেক বাচ্চা উৎপাদনের কারণে ছোট হ্যাচারীগুলো চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। গত প্রায় দেড় বৎসর (১জুলাই ২০১৭ থেকে) যাবৎ বাচ্চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো অধিক লোকসানের কারণে ব্যাংক ঋণের পরিমান বৃদ্ধি পেয়ে, ঋণের চাপে বন্ধ হয়ে গেছে। অতিসত্তর পরিকল্পিতভাবে সরকারের দৃষ্টি না আসলে ছোট ছোট বাচ্চা উৎপাদনকারী হ্যাচারী ও খামার গুলো লোকসানের কারণে একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে। এতে করে হ্যাচারী লগ্নীকারী বিভিন্ন ব্যাংক গুলো শত শত কোটি টাকা অনাদায়ে লোকসানে পড়বে এবং কোটি কোটি লোক বেকার হয়ে পড়বে।
এই কঠিন সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় (প্রাণী সম্পদ) কে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে অনিয়ন্ত্রিত পোল্ট্রি শিল্পতে শৃংখলার মধ্যে আনতে হবে। বিদেশী যে সমস্ত বড় বড় মুরগীর ফার্ম আমাদের দেশে জেকে বসেছে, সে গুলোকে বন্ধ করে দিতে হবে। দেশের বড় বড় বাচ্চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গুলোকে অবশ্যই শৃংখলার মধ্যে বাচ্চা উৎপাদন করিয়ে রাখতে হবে। চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন রাখতে হবে। অথবা উৎপাদনের সাথে সাথে মিল রেখে মুরগীর মাংস বিদেশে রপ্তানী করতে হবে। হ্যাচারীর উৎপাদিত ব্রয়লার বাচ্চার মূল্য কমপক্ষে ৪০ টাকা থেকে ৫০ টাকা করতে হবে। দেশের মানুষের মুরগীর মাংস খাওয়ার উপকারীতা সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টির লক্ষ্যে পাঠ্যপুস্তক, সংবাদপত্র, ইলেকট্রনিক্ মিডিয়ায় জোর প্রচার করতে হবে। শুধু রান্না করে খাওয়া নয়, উন্নত দেশের মত বিভিন্ন খাবারের সাথে মুরগীর মাংস সংযুক্ত করে দেশে-বিদেশে রপ্তানী করতে হবে।
প্যারেন্ট বাচ্চা উৎপাদন খরচ যেহেতু ১৪০-১৫০ টাকার মধ্যে সেহেতু প্রতি পিচ প্যারেন্ট বাচ্চা ২০০ টাকার মধ্যে রাখতে হবে। বিদেশ থেকে রোগাক্রান্ত, রোগ সৃষ্টিকারী গরু আমদানী বন্ধ করতে হবে। (গরু- খাসী মাংসে কোলেষ্টরল মাত্রা বেশী থাকায় ইদানিং হার্ট এ্যাটাকের ঝুকি বাড়ছে।) একারণে প্রচারের মাধ্যমে গরু/খাসীর মাংস না খাওয়ার জন্য নিরুৎসাহিত করতে হবে। যে সমস্ত মিডিয়া মুরগীর মাংস না খাওয়ার জন্য অপপ্রচার চালায়, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। মুরগী বাজারজাত করণের সময় রাস্তা-ঘাট চাঁদাবাজীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। বিনা সুদে অথবা কম সুদে ছোট ছোট হ্যাচারীদের ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। মুরগী উৎপাদন কৃষিভিত্তিক বিধায়, বিদ্যুৎ বিল কমায়ে কৃষি ভিত্তিক করতে হবে। বাচ্চা উৎপাদনকারী ফার্মগুলোর আশপাশে বিভিন্ন চাঁদাবাজীদের আড্ডা, গোপন তদন্তের মাধ্যমে আড্ডা বা অসামজিক কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে। মুরগী এবং বাচ্চা উৎপাদনের জন্য খাদ্য উপাদান, মেডিসিন ও ভ্যাকসিনের দাম কমাতে এবং নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। হ্যাচারী (বাচ্চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান) আশ-পাশে কমপক্ষে ১ কিঃ মিঃ এর মধ্যে কেউ হাঁস-মুরগী, পাখি জাতীয় প্রাণী পালন করতে না পারে এর জন্য নিয়মনীতি থাকতে হবে। প্রত্যেক উপজেলায় রোগ নির্ণয়ের জন্য উন্নত মানের ল্যাবরেটরী ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ দিতে হবে। একদিনের উৎপাদিত মুরগীর বাচ্চা দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবহনের জন্য ফেরীঘাটে সিরিয়াল ছাড়া জরুরী ভিত্তিতে পারাপারের ব্যবস্থা করতে হবে।
দেশের বেকার সমস্যা দূরীকরণে পোল্ট্রি শিল্পকে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি করে বিদেশে রপ্তানী করলে এই শিল্প প্রসারের সাথে সাথে অনেকাংশ বেকার সমস্যা দূর করা সহ প্রচুর পরিমানে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। এছাড়া মুরগির বিষ্ঠা জৈব সার হিসাবে ব্যবহার করে ফলন বুদ্ধির ব্যবহার করে ফলন বৃদ্ধির পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে বিদেশ থেকে রাসায়নিক সার আমদানি অনেকাংশ কমানো সম্ভব। কাজেই এ শিল্পকে অবহেলার চোখে না দেখে, এখনই সরকারের এগিয়ে এসে সু-পরিকল্পিত ভাবে পোল্ট্রিনীতি বাস্তবায়ন করে মৃত প্রায় এই শিল্পকে বাঁচিয়ে দেশের উন্নয়নের পথ সুগম করতে হবে।
আলহাজ্ব এম.এ. কাদের
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
ইউনিভার্স্যাল পোল্ট্রি হ্যাচারীজ লিঃ
কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।