বিনয় মানুষের মর্যাদার প্রতীক
ফারুক নোমানীঃ
বিনয় মানুষের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিনয় ও নম্রতা মানুষকে উচ্চাসনে সমাসীন করে। সমাজের বুকে কাউকে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করতে বিনয়ের প্রভাব অনেক বেশি। তাই যে যত বেশি বিনয়ী সমাজের চোখে সে ততটা সম্মানিত ও মর্যাদাবান। বিনয়ী মানুষ সমাজের কাছে যেমন সম্মানিত, আল্লাহর কাছেও তিনি একইভাবে পছন্দনীয়। ফলে বিনয়ী মানুষ দু’জগতেই সফল ও সম্মানিত হন। কুরআনুল কারিমে দয়াময় আল্লাহ তাঁর প্রিয়ভাজন বান্দাদের বিবরণ দিতে গিয়ে প্রথমেই আলোচনা করেছেন বিনয়ীদের কথা। তিনি বলেছেন- ‘আর রহমানের বান্দা তারাই যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে।’ (সুরা ফুরকান : ৬৩)
অর্থাৎ তারা পৃথিবীতে নম্রতা ও বিনয় সহকারে চলাফেরা করে। কুরআনের এ আয়াতে বর্ণিত ‘হাওনুন’ শব্দের অর্থ স্থিরতা, গাম্ভীর্য, বিনয়। তাই আল্লাহর প্রিয়ভাজনরা গর্বভরে চলেন না। অহংকারীর ন্যায় পা ফেলেন না। অহংকারের সাথে বুক ফুলিয়ে হাঁটেন না। গর্বিত স্বৈরাচারী ও বিপর্যয়কারীর মতো নিজের চলার মাধ্যমে নিজের শক্তি প্রকাশ করার চেষ্টা তাঁরা করেন না। বরং তাঁদের চালচলন হয় একজন ভদ্র, মার্জিত ও সৎস্বভাব সম্পন্ন ব্যক্তির মতো। তবে ‘নম্রভাবে চলাফেরা’ দ্বারা আবার খুব ধীরে চলাটাও উদ্দেশ্য নয়। কেননা, বিনা প্রয়োজনে ধীরে চলা সুন্নাত বিরোধী। হাদীস থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব ধীরে চলতেন না; বরং কিছুটা দ্রুত গতিতে চলতেন।
বিনয় ও নম্রতার বিপরীত শব্দ হল ঔদ্ধত্য, কঠোরতা, অহংকার ইত্যাদি। এগুলো মানব চরিত্রের সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্বভাব। এ পৃথিবীতে মারামারি, কাটাকাটি, খুন-রাহাজানিসহ যত অশান্তির সৃষ্টি হয় তার মূলে রয়েছে ঔদ্ধত্য বা অহংকার। অহংকারীর না আছে মানুষের কাছে কোন সম্মান আর না আছে আল্লাহর কাছে কোন মর্যাদা। দু’পারেই তার জন্য অপেক্ষা করছে লাঞ্চনা ও অপমান। অহংকারী ও উদ্ধত ব্যক্তিকে যেমন মানুষ পছন্দ করে না, ঠিক তেমনই আল্লাহও তাকে অপছন্দ করেন। তিনি বলেছেন- ‘নিশ্চয় তিনি অহংকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা নাহাল: ২৩)
অহংকার মানুষকে ভয়াবহ পরিণতির মুখোমুখি করে। এ পাপের শাস্তি অনেক ভয়ঙ্কর। অহংকার সর্ম্পকে আল্লাহ বলেন-‘ পৃথিবীতে যারা অন্যায়ভাবে গর্ব করে বেড়ায়, তাদেরকে আমার নিদর্শনাবলী হতে ফিরিয়ে দেব।’ (সুরা আরাফ : ১৪৬)
তিনি আরো বলেন- ‘এভাবে আল্লাহ সিলগালা করে দেন প্রত্যেক অহংকারী, স্বৈরাচারী ব্যক্তির হৃদয়ে।’ (সুরা গাফির : ৩৫)
অর্থাৎ অহংকারীদের হৃদয়ে আল্লাহ সিলগালা করে দেন, ফলে তারা সত্য-মিথ্যা ও ভালো-মন্দের পার্থক্য করতে পারে না। তাদের অন্তরে ঈমানের আলোও প্রবেশ করে না।
এই ঘৃণিত পাপের পাপীকে আল্লাহ দুনিয়াতেও যেমন ব্যর্থ করবেন, আবার পরকালেও লাঞ্চিত করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। পার্থিব জগতে অহংকারীদের ব্যর্থতা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন- ‘আর প্রত্যেক উদ্ধত স্বৈরাচারী ব্যর্থ মনোরথ হল।’ (সুরা ইবরাহীম : ১৫)
আর পরকালীন শাস্তি সম্পর্কে তিনি বলেছেন- ‘তোমাদের প্রতিপালক বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। যারা অহংকারে আমার ইবাদাত থেকে বিমুখ থাকে, ওরা অচিরেই লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ (সুরা গাফির ৬০)
অন্যত্র বলা হয়েছে-‘বলা হবে, তোমরা জাহান্নামের দরজাসমূহে প্রবেশ কর তাতে স্থায়ীভাবে অবস্থিতির জন্য। অতএব অহংকারীদের আবাসস্থল কত নিকৃষ্ট!’ (সুরা যুমার: ৭২)
কত ভয়াবহ বিবরণ বর্ণিত হয়েছে পবিত্র কুরআনে অহংকারীদের ব্যাপারে! দুনিয়া ও আখিরাতে ওরা হবে চরম লজ্জিত, অপমানিত। আল্লাহর কাছে ওরা যেমন ঘৃণিত ঠিক দুনিয়ার মানুষের কাছেও চরম ধিক্কৃত।
অহংকার সম্পর্কে নবীজী সা. মানুষকে সতর্ক করেছেন। তাদেরকে জানিয়েছেন অহংকারের ভয়াবহ পরিণতির কথা। আবু সাঈদ ও আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত,নবীজী সা. বলেন- ‘ইজ্জত সম্মান তাঁর (আল্লাহর) ভূষণ এবং অহংকার তাঁর চাদর। যে ব্যক্তি এই ব্যাপারে আমার (অর্থাৎ আল্লাহর) সঙ্গে ঝগড়ায় অবতীর্ণ হবে আমি তাকে অবশ্যই শাস্তি দিব।’ (সহীহ মুসলিম ৬৪৪১)
অহংকারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। তাদেরকে আল্লাহ অধোমুখী করে চরম লাঞ্ছনার সাথে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। এ মর্মেই আবুদল্লাহ ইবন মাসউদ রা. বলেন, নবীজী সা. বলেছেন- ‘যার অন্তরে দানা পরিমাণ অহংকার রয়েছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (সহীহ মুসলিম ৯১, আবু দাউদ ৪০৯১, তিরমিযী ১৯৯৯)
আবুদল্লাহ ইবন আমর ইবন আস রা. বলেন, নবীজী সা. বলেছেন- ‘যার হৃদয়ে দানা পরিমাণ অহংকার রয়েছে, আল্লাহ তাকে অধোমুখী করে জাহান্নামে দিবেন।’ (আহমাদ ৭০১৫)
অহংকারের এই মহাপাপ যেই করুক না কেন তার পরিণতিই বড় ভয়াবহ। ধনবানরা বিত্তবৈভবে এ পাপে জড়িয়ে পড়ে, কিন্তু অনেক দরিদ্র লোকও আছে যারা অহংকারে লিপ্ত। নবীজী সা. দরিদ্র অহংকারীর শাস্তির কথাও বলেছেন। আবু হুরায়রা রা. বলেন, নবীজী সা. বলেছেন- ‘কিয়মত দিবসে আল্লাহ তিন শ্রেণীর মানুষের সাথে কথা বলবেন না, তাদেরকে পবিত্রও করবেন না এবং তাদের দিকেও তাকাবেন না। মূলত তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। (তারা হল) বৃদ্ধ ব্যভিচারী, মিথ্যাবাদী শাসক, দরিদ্র অহংকারী।’ (সহীহ মুসলিম ১০৭, আহমাদ ১০২২৭)
পাঠক, মানুষের অহংকার করার কীইবা আছে! কেনইবা সে এপাপে জড়িয়ে পড়ে!! ধনসম্পদের অহংকার? তা তো তার প্রতি দয়াময় আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। সম্পদ তো আল্লাহই তাকে দিয়েছেন বড় দয়া করে। অঢেল সম্পত্তির মালিক তাকে যিনি বানিয়েছেন, তিনিই তো আরেকজনকে বানিয়েছেন রাস্তার ফকির। ক্ষুধার্ত ভিক্ষুক। মানুষ সৌন্দর্যের বড়াই করে? এ রূপ সৌন্দর্য তো আল্লাহরই দেয়া। কাউকে তিনি করেছেন দেখতে কালো, কুৎসিত, আবার কাউকে দিয়েছেন সকল রূপ সৌন্দর্যের বাহার। এখানেও মানুষের কোন কৃতিত্ব নেই। নেই কোন ক্ষমতা। অনেকে করে জ্ঞানের বড়াই। কিন্তু সে কি দেখে না যে, রাস্তার পাশে কত লোক ঘুরে বেড়ায়, দেখতে ঠিক তার মত। অথবা তার থেকেও সুন্দর, কিন্তু মানুষ তাকে পাগল বলে ডাকে। আল্লাহ কি পারতেন না এই অহংকারী জ্ঞানীকে রাস্তার পাগল বানিয়ে পাগলকে জ্ঞানী বানাতে? অবশ্যই পারতেন। কিন্তু তিনি এমনটা না করে বড় করুণা করেছেন তার প্রতি।
প্রশ্ন হতে পারে, আল্লাহর এই সৃষ্টিজগতে কেন এমন পার্থক্য করা হলো? সবাইকেই কি আল্লাহ সমান করে সৃষ্টি করতে পারতেন না? হ্যা, অবশ্যই আল্লাহ তা পারতেন। কিন্তু তিনি এই বিভাজন করেছেন মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য। তিনি দেখতে চান, কে তাঁর অনুগ্রহ পেয়ে তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে ও বিনয় অবলম্বন করে। আর কে অকৃতজ্ঞ ও অহংকারী হয়ে ওঠে। এ বিষয়ে সতর্ক করে তিনি বলেছেন- ‘তোমরা যদি (আমার অনুগ্রহের) কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর, তাহলে অবশ্যই আমি তা বাড়িয়ে দিব। আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, তাহলে জেনে রাখ যে, নিশ্চয়ই আমার শাস্তি বড় কঠিন।’ (সুরা ইবরাহীম ৭)
সুতরাং আমাদের যা কিছু প্রাপ্তি তা দয়াময় আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়েছে। এখানে মানুষের অহংকার করার কোন অবকাশ নেই।
আবু বকর রা. বলেন- ‘কোন মুসলিমের জন্য কিছুতেই এটা উচিৎ নয় যে, অন্য মুসলিমকে হেয় প্রতিপন্ন করবে। কেননা কোন মুসলিমকে হেয় করা আল্লাহর কাছে অনেক বড় অপরাধ।’
ওয়াহাব ইবন মুনাব্বিহ বলেন- ‘আদম সন্তানের জন্য বড়ই আর্শ্চযের ব্যাপার হলো যে, সে অহংকার করে অথচ সে বের হয়েছে পেশাবের রাস্তা থেকে।’ (ফাতহুল মান্নান ফী সিফাতি ইবাদির রহমান পৃ. ৩৩৫)
অপর দিকে বিনয় সম্পর্কে দেখুন, কত সুসংবাদ বর্ণিত হয়েছে বিনয়ীদের জন্য। তারা এপার ওপার দু’পারেই পাবেন শ্রদ্ধা ও সম্মানের জীবন।
মানুষের পরস্পরে বিনয় অবলম্বন সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ প্রিয় নবীজী সা. কে নির্দেশনা দিয়েছেন। সাহাবী ইয়ায ইবন হিমার রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা.বলেছেন- ‘আল্লাহ তা’আলা আমার উপর ওহী করেছেন যে, তোমরা পরস্পর বিনয় প্রদর্শন করবে। যাতে কেউ কারো উপর বাড়াবাড়ি ও গৌরব প্রকাশ না করে।’ (সহীহ মুসলিম ৬৯৪৬, আবু দাউদ ৪৮১৫)
বিনয়ের উপকারিতা সম্পর্কে আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত আরেকটি হাদীসে আছে, নবীজী সা. বলেছেন-‘দান করলে সম্পদের ঘাটতি হয় না। যে ব্যক্তি ক্ষমা করে আল্লাহ তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। আর কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিনীত হলে তিনি তার মর্যাদা উঁচুতে তুলে দেন।’ (সহীহ মুসলিম ৬৩৫৬, তিরমিযী ২০৩৫, আহমাদ ৯০০৮)
যদিও বিনয়ের মাধ্যমে নিজের প্রবৃত্তিকে দমন করে রাখা হয়, কিন্তু এর বিনিময়ে আল্লাহ উক্ত ব্যক্তির মর্যাদা অনেক উঁচুতে তুলে দেন। যা সে কখনো কল্পনা করতে পারে না।
আরো দেখুন, হাদীসে নবীজী সা. এর প্রিয়ভাজনদের বিবরণ দেয়া হয়েছে। কারা পরকালে তাঁর নিকটবর্তী থাকবেন তারও বিবরণ এসেছে হাদীসে।
জাবির রা. হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সা.বলেছেন- ‘তোমাদের যে ব্যক্তির চরিত্র ও আচরণ সর্বোত্তম তোমাদের মধ্যে সে-ই আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয় এবং কিয়ামত দিবসেও আমার খুবই নিকটে থাকবে। তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আমার নিকট সবচেয়ে বেশি ঘৃণ্য সে ব্যক্তি কিয়ামত দিবসে আমার নিকট হতে অনেক দূরে থাকবে তারা হলো- বাচাল, ধৃষ্ট-নির্লজ্জ এবং অহংকারে মত্ত ব্যক্তিরা। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! বাচাল ও ধৃষ্ট-দাম্ভিকদের তো আমরা জানি কিন্তু মুতাফাইহিকূন কারা? তিনি বললেন- অহংকারীরা।’ (তিরমিযী ২০১৮)
পাঠক, ধর্মের উদ্ধৃতি না টেনেও খুব সহজে বিবেক দিয়ে বিবেচনা করে বুঝা যায়, বিনয়ের প্রভাব সমাজে কত। আপনি যে পেশারই মানুষ হোন না কেন সফল হতে হলে অবশ্যই আপনাকে বিনয়ী হতে হবে। বিনয়ী মানুষ সহজেই সফলতা খুঁজে পায়। মানুষের বুকের প্রীতি-ভালোবাসা, মর্যাদা ও সম্মান বিনয়ীদের জন্য বরাদ্দ থাকে। তাই সহজ কথায় বলা যায়, বিনয় মানুষের মর্যাদার প্রতীক।
লেখকঃ ইমাম, বায়তুল আমান জামে মসজিদ, মেইন বাসস্ট্যান্ড কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।
মুহাদ্দিস, বলিদাপাড়া মাদরাসা, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।