বিমান থেকে ১৪ কেজি সোনা উদ্ধারের মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন, রাষ্ট্রপক্ষের নারাজি আবেদন
সবুজদেশ ডেক্সঃ চার বছর আগে বাংলাদেশ বিমানের একটি উড়োজাহাজের কার্গো হোলের (মালামাল রাখার জায়গা) ভেতর ১৪ কেজি সোনা কে বা কারা রেখেছিলেন, তা বের করতে পারেনি পুলিশ। যদিও পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সবাই বলছেন, উড়োজাহাজের কার্গো হোলে কোনো যাত্রী বা সাধারণ মানুষের পক্ষে সোনা রাখা সম্ভব না। তাই তদন্তের গাফিলতির অভিযোগ তুলে সরকারি কৌঁসুলি এই ঘটনার পুনঃ তদন্তভার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) দেওয়ার অনুরোধ করেছেন। সোনা উদ্ধারকারী শুল্ক কর্মকর্তারা দুজনের নামে মামলা করলেও একজনকে পুলিশ কোনো দিনই গ্রেপ্তার করতে পারেনি। অন্যজনকে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করেছে পুলিশ।
এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে বিমানের মেকানিকসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত ৩১ জানুয়ারি পুলিশ এ মামলায় আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগ। রাষ্ট্রপক্ষের সরকারি কৌঁসুলি গত রোববার আদালতকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন, এটি একটি চাঞ্চল্যকর সোনা চোরাচালান মামলা। পুলিশ সঠিকভাবে তদন্ত না করেই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি তাপস কুমার পাল গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, সঠিকভাবে তদন্ত হলে উড়োজাহাজের ভেতর কে বা কারা সোনা রেখেছিল, সোনার প্রকৃত মালিক কে ছিলেন, তা বের করা সম্ভব হতো। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার জন্য মামলার তদন্তভার পিবিআইকে দেওয়ার জন্য আদালতের কাছে আবেদন করেছেন।
২০১৫ সালের ১৪ জানুয়ারি হজরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমানের একটি উড়োজাহাজের (দুবাই-চট্টগ্রাম-ঢাকা) কার্গো হোল থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ১৩ কেজি ৯৮৪ গ্রাম সোনা উদ্ধার করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। উদ্ধার করা সোনার তখনকার বাজারমূল্য ছিল আনুমানিক ৬ কোটি ৯৯ লাখ ২০ হাজার টাকা। এ ঘটনার পরদিন ১৫ জানুয়ারি সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আবুল হোসেন বাদী হয়ে দুজনের নাম উল্লেখ করে বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন। ওই দুজন হলেন বাংলাদেশ বিমানের মেকানিক এমরানুল ইসলাম ও ওসমান গনি। মামলায় বলা হয়, উড়োজাহাজের টয়লেটের নিচ বরাবর কার্গো হোলের উড়োজাহাজের বডিসংলগ্ন প্লাস্টিকের প্যানেল খুলে ওই সোনা জব্দ করা হয়। আসামি এমরানুল ও ওসমান সংঘবদ্ধ চক্রের অন্য সদস্যদের সহায়তায় সোনা বাইরে পাচার করতেন। বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতি নিবন্ধন খাতা পর্যালোচনায় দেখা যায়, সে সময় বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন এমরানুল। তাঁকে তখন বিমানের প্রধান প্রকৌশলীর কক্ষে হাজির হতে বলা হয়। এরপর তাঁকে মোবাইল ফোনে ডাকা হয়। কিন্তু সেদিন তিনি হাজির হননি। অপর আসামি ওসমান গনির বিরুদ্ধে এর আগে সোনা চোরাচালান মামলা হয়।
সাধারণ যাত্রীর পক্ষে সম্ভব নয়
উড়োজাহাজের কার্গো হোল থেকে সোনা উদ্ধারের সময় উপস্থিত ছিলেন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আবুল হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগে থেকে খবর ছিল, এ বিমানের ভেতর সোনা আছে। এ জন্য শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা টয়লেট, খাবার ও বেভারেজ রাখার স্থান তন্ন তন্ন করে খোঁজ করেন। দুই ঘণ্টা ধরে তল্লাশি চালানোর পরও সোনা উদ্ধার না হওয়ায় উড়োজাহাজের কার্গো হোল তল্লাশি করার সিদ্ধান্ত হয়। সেখানেই সোনাগুলো পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ বিমানের ইন্সপেকশন অফিসার আমির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কোনো সাধারণ যাত্রীর পক্ষে কার্গো হোলের ভেতর সোনা রাখা সম্ভব না। তাঁদের সহযোগিতা নিয়ে শুল্ক ও গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা সেদিন সোনা জব্দ করেন।
আদালতকে পুলিশ প্রতিবেদন দিয়ে জানায়, সাক্ষীদের সঙ্গে কথা বলে এবং তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, উড়োজাহাজের বডির মধ্যে সোনার বার গোপনভাবে রাখা সাধারণ যাত্রীদের পক্ষে সম্ভব না। এ কাজ বিমানের প্রকৌশল শাখার যেসব টেকনিশিয়ান থাকেন, তাঁদের পক্ষে সম্ভব।
মামলাটি তদন্ত করেছেন কাউন্টার টেররিজমের ট্রান্সন্যাশনাল বিভাগের পরিদর্শক সরওয়ার হোসেন। আদালতে দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এজাহারে দুজনের নাম থাকলেও কেবল এমরানুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর বিমানবন্দরের সিভিল অ্যাভিয়েশনের বেশ কয়েকজন সোনা চোরাচালান কর্মকর্তার নাম জানা যায়। প্রথমে গ্রেপ্তার করা হয় এয়ারক্রাফট মেকানিক আবুল সালেহ ও আক্তারুজ্জামানকে। এরপর আব্বাস আলী ও নুর নবীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশ কর্মকর্তা সরওয়ার হোসেন আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে বলেন, প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী কিংবা প্রযুক্তিগত প্রমাণ ছাড়া কেবল ধারণা দিয়ে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ সম্ভব নয়। কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করার পরও তাঁদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যে কারণে বিমান থেকে উদ্ধার করা সোনার মালিক কে বা কারা, কাদের মাধ্যমে তা পাচার হতো, তা উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি।
মামলার বাদী সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সেই ১৪ কেজি সোনার মালিক কে, তা যে বের করা যায়নি, সে খবর তিনি জানেন না। তবে এজাহারে তিনি দুজনের নাম দিয়েই মামলা করেছিলেন। প্রধান আসামি এমরানুলকে গ্রেপ্তারে সহায়তা করেন শুল্ক ও গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার মো. মাহফুজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এ মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে কি না, নথিপত্র না দেখে তা বলা অসম্ভব। তবে সাধারণ কোনো মামলায় সাক্ষ্য-প্রমাণ না পাওয়া গেলে সে ক্ষেত্রে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।
তবে মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা বিমানবন্দর থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) গোলাম কিবরিয়া হাসান কেস ডায়েরিতে উল্লেখ করেন, অজ্ঞাত ব্যক্তির আনা সোনা উড়োজাহাজের টয়লেটের কমোডের চেম্বার খুলে চেম্বারের ভেতরে একটি গর্ত দিয়ে কার্গো হোল-সংশ্লিষ্ট প্যানেলের ভেতর ফেলে দেওয়া হয়। বাদীর গোপন সংবাদ থাকায় বিমানের যাবতীয় নিবন্ধন খাতা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আসামি এমরানুল ইসলাম ও ওসমান গনি অজ্ঞাত আসামিদের যোগসাজশে সোনার বার পাচার করেছেন বলে বাদীর অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হচ্ছে। পুলিশ কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া হাসান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় ১৪ কেজি সোনা উদ্ধারের মামলাটি কয়েক দিন তিনি তদন্ত করেছিলেন। যে তথ্য পেয়েছিলেন, তা তিনি কেস ডায়েরিতে উল্লেখ করেন।