বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশিরা
তিন যুগ ধরে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করছেন বাংলাদেশিরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিশ্বের ৪৩টি দেশে ৬৩টি মিশনে কাজ করেন ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮৫৬ জন। বিরোধপূর্ণ এসব স্থানে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১৬৮ জন বীর, আহত হয়েছেন ২৬৬ জন। বর্তমানে বিশ্বের ১৩ দেশের ৫৬টি মিশনের বিরোধপূর্ণ স্থানে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের ৫ হাজার ৮৫৬ সদস্য নিয়োজিত রয়েছেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অবদানের দিক থেকে ১২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান তৃতীয়। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে রুয়ান্ডা ও প্রথম নেপাল। এ তালিকায় ভারতের অবস্থান চতুর্থ।
সর্বশেষ গত ২৬ নভেম্বর লেবাননে নিয়োজিত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন ইউনাইটেড নেশন্স ইন্টারিম ফোর্স ইন লেবাননে (ইউনিফিল) অংশ নিতে দেশ ছেড়ে গেছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ৭৫ সদস্যের একটি দল। ধারাবাহিকভাবে সশস্ত্রবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা শান্তিরক্ষা মিশনে যোগ দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।
জাতিসংঘ মিশনে পূর্ব তিমুরে প্রটেকশন অফিসার ও দারপুর মিশনে প্ল্যানিং অফিসার হিসেবে চার বছর কাজ করেছেন পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. জালাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। ডেভেলপমেন্ট, অপারেশনাল ও অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভসহ পুলিশের প্ল্যানিংয়ের অ্যাকটিভিটিজ ছাড়াও বিভিন্ন স্ট্র্যাটেজিক ডকুমেন্ট ও পলিসি ডকুমেন্টস তৈরিতেও কাজ করেছেন তিনি।
কোন প্রেক্ষাপটে একটি দেশে শান্তিরক্ষী পাঠানো হয়—জানতে চাইলে জালাল উদ্দিন বলেন, যখন একটা দেশে মানবিক বিপর্যয় ঘটে তখন জাতিসংঘের অ্যাসেসমেন্ট টিম তারা এসে পরিদর্শন করে এবং তারা যদি মনে করে যে, সেখানে ল অ্যান্ড অর্ডার নেই, অন্যান্য ডিজাস্টার আছে, সাপোর্ট দেওয়া দরকার, তখন তারা মিশনের সিদ্ধান্ত নেয়। পরে একই সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘের সিকিউরিটি কাউন্সিল।
শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের অবদান : ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৫ সদস্যের একটি পর্যবেক্ষক দল ইরাক-ইরান শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে যোগদানের মাধ্যমে জাতিসংঘের পতাকাতলে যাত্রা শুরু। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ পুলিশ নামিবিয়ায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে যোগ দেয়। এরপর ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনী মোজাম্বিক ও বাংলাদেশ বিমানবাহিনী বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। হাইতি থেকে পূর্ব তিমুর, লেবানন থেকে কঙ্গো পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের পদচিহ্ন রয়েছে। বসনিয়ার তীব্র শীত, সাহারা মরুভূমির দুঃসহনীয় গরম ও পূর্ব এশিয়ার ক্লান্তিকর আর্দ্রতার সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা। ধর্ম, গোত্র, বর্ণ, রাজনৈতিক মতাদর্শ ও আঞ্চলিক বৈষম্যকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী সদস্যরা নিজেদের উৎসর্গ করেছে বিশ্ব মানবতার সেবায়। পেশাগত দক্ষতা, নিরপেক্ষতা, সততা ও মানবিকতার কারণে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী সদস্যরা বিশ্বের সব মানুষের কাছে আজ অনন্য দৃষ্টান্তস্বরূপ।
জাতিসংঘের গত সেপ্টেম্বরের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের ৫৬ মিশনে বাংলাদেশের ৫ হাজার ৮৫৬ সদস্য নিয়োজিত আছে। ১২০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। শুরু থেকে এ পর্যন্ত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সর্বমোট ১৬৮ জন শান্তিরক্ষী শহীদ হয়েছেন। এ বছর ৩ জন আহত শান্তিরক্ষীকে সম্মাননা প্রদান করা হচ্ছে।
১৯৮৮ সাল থেকে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষীদের ১৬৮ জন বীর প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর ১৩১, নৌবাহিনীর ৪, বিমানবাহিনীর ৯ এবং পুলিশের ২৪ জন রয়েছেন। এ সময়ের মধ্যে আহত হয়েছেন ২৬৬ জন। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর ২৩৯, নৌবাহিনীর ৯, বিমানবাহিনীর ৬ এবং পুলিশের ১২ জন আহত হয়েছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের পুলিশ সুপার (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স) ইনামুল হক সাগর জানিয়েছেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশের পদযাত্রা সূচিত হয় ১৯৮৯ সালে; নামিবিয়া মিশনের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশ পুলিশের ২১ হাজার ৪৫৩ জন শান্তিরক্ষী বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে মিশন সম্পন্ন করেছেন। এর মধ্যে নারী শান্তিরক্ষী রয়েছেন ১ হাজার ৮১০ জন।
পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, ২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশ পুলিশের নারী পুলিশ কর্মকর্তারা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছেন। বর্তমানে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, মালি, সাইপ্রাস, সেন্ট্রাল আফ্রিকা, সাউথ সুদান ও লিবিয়ায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশের ১২০ নারী সদস্যসহ ৩৬৪ জন শান্তিরক্ষী নিয়োজিত রয়েছেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালনকালে ২৪ জন পুলিশ সদস্য সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেছেন, আহত হয়েছেন ১২ জন।
সবুজদেশ/এসইউ