বুয়েটের অবস্থা যখন এই তখন সারা দেশের কি অবস্থা
রহমান মৃধাঃ
জন্মের কয়েক বছর পরেই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, বাবা এবং বড় ভাইদের ছোঁয়া আর ছায়া ছাড়া ভবঘুরে হয়ে এ গ্রাম থেকে সে গ্রামে শরনার্থী হয়ে দীর্ঘ নয়টি মাস খেয়ে না খেয়ে, ঘুমকে হারাম করে, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস পার করে স্বাধীনতার সাধ পেয়েছিলাম।
একদিকে হারাবার বেদনা, অন্যদিকে স্বাধীনতার আনন্দ, শেষে পুনর্মিলন হয়েছিল আমাদের পরিবারের। হারানোর বেদনা, স্বাধীনতার চেতনা এবং নতুন রঙের ছোঁয়ায় হৃদয় উল্লাসিত হয়েছিল আর জ্বলেছিল আশা ভরসা এবং ভালোবাসার আলো। দেখেছিলাম সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন। মনে পড়ে সেই ছোটবেলার স্কুল জীবনের কথা।
প্রতিদিন পুরো স্কুলের সকল ছাত্রছাত্রী এবং গুরুজনদের সামনে দাঁড়িয়ে লাল সবুজের পতাকা উত্তোলন করতাম আর গাইতাম “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।” শরীরের প্রতিটি লোম দাড়িয়ে যেত সেই সময়ের প্রতিদিনের গানের সুরে। সেই দিনগুলোর অনুভূতি আজও ভুলিনি। কি আশা ছিল আর কি হয়ে গেল। প্রায় চল্লিশ বছর দেশ ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছি পাশ্চাত্যে, লাল সবুজের পাসপোর্ট নিয়ে পুরো বিশ্বের দরবারে গর্বের সঙ্গে বলেছি আমার নাম বাংলাদেশ।
কর্মজীবনে কখনও নিজেকে মানষিকভাবে দরিদ্র মনে হয়নি, যদিও সবাই জানে বাংলাদেশ গরীব দেশ। আজ এত বছর পর যখন জীবনের অভিজ্ঞতাকে সবার সঙ্গে শেয়ার করার জন্য আপ্লুত মনে লিখতে শুরু করেছি ভালোবাসার গল্প, বিশ্ব ভ্রমণের গল্প, দেশ গড়ার স্বপ্ন, ঠিক তেমন একটি সময় পুরো আকাশ ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছে, একের পর এক, বাংলার মানুষের হৃদয়ে।
যে হৃদয়ে প্রাণ আছে বলে বিশ্বাস করতেও ভয় হচ্ছে। এ কেমন অবিচার! রাত পোহালে কি নতুন ট্রাজেডির কথা শুনতে হবে! বহিঃশত্রু তাড়িয়ে গৃহশত্রু বরণ করতে হবে এতো কখনও ভাবিনি।
কি হতে কি হয়ে গেল! মুষ্ঠিমেয় কিছু সংখ্যক কার্লপ্রিটদের ছোবলে লক্ষকোটি জনতার জীবনে অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে এ কখনও ভাবিনি! এ কেমন অবিচার! সবাই হতাশ হয়েছে বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরারের অমানবিক হত্যাকান্ডে, হতাশ আমিও হয়েছি। কিন্তু বেশি হতাশ হয়েছি এই ভেবে যারা তাকে হত্যা করেছে তারাও কিন্তু বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী।
বুয়েটের অনেকেই উন্নত দেশে জাপান, কানাডা, আমেরিকা বা সুইডেনের KTH (Royal Institute of Technology) পড়তে আসে। তারা নিশ্চয়ই জানে এবং দেখে পাশ্চত্যে ছাত্র রাজনীতি মানে কি, ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জাতীয় রাজনীতির পার্থক্য কোথায়? ভাবতেই ভয় লাগছে, আমাদের অসহিষ্ণুতার পর্যায় কোথায় নেমে গেছে যে, একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস এর জন্য মেরেই ফেলা হল একজন শিক্ষার্থীকে। এদেরকে দেশের ভালো ছেলে হিসাবে বিবেচনা করা হয়, এরা দেশ নিয়ে কি স্বপ্ন দেখে! কি করবে এরা এদের জীবনে? যারা একটা ফেসবুক স্ট্যাটাসকে মেনে নিতে পারেনা, সেসব শিক্ষার্থী দেশ পরিচালনা করবে কিভাবে? এরা যখন একটি বালিশ তৈরি করতে ত্রিশ হাজার টাকা কামাতে শুরু করেছে তখনই বোঝা উচিত ছিল কি শিক্ষা হচ্ছে সেখানে, কি স্বপ্ন দেখছে এরা, আর কি এদের ভবিষ্যত? আজ যদি এই হত্যাকারীরা অবাঙ্গালী হতো, অশিক্ষিত মূর্খ্য হতো তাহলে ভাবতাম কুশিক্ষা, কুসংস্কার এবং দারিদ্রতার কারনে এমনটি হয়েছে।
কিন্ত না এরা অসুস্থ্য রাজনৈতিক চক্রান্তে সন্ত্রাসী হয়েছে। এরা মাদক এবং ইয়াবার সঙ্গে আসক্ত হয়ে নিজেরা নিজেদেরকে ধ্বংস করছে। একই সঙ্গে শিক্ষার মেরুদন্ডকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেশকে অধঃপতনে ঠেলে দিচ্ছে। অবাক হচ্ছি, যে সব মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে সমাজে এবং দেশের বেস্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে! বেষ্ট শিক্ষাপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর আ্যসিভমেন্ট যদি এই হয় তাহলে দেশ আজ কোথায় যেতে শুরু করেছে!
জাতির শিক্ষা প্রশিক্ষণে AIDS, ডেঙ্গু রোগের চেয়ে ভয়াবহ ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের আবির্ভাব ঘটেছে যা ভাবতেই দিনের আলো অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। কম্পিউটারে ভাইরাস হলে বলতাম ডিলিট করে দাও। কি বলার থাকতে পারে যখন জাতির উর্ধ্বতন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কুশিক্ষা আর প্রতিহিংসার ভাইরাস আক্রমণ করে?মাননীয় রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী – কিছুই কি করার নেই আপনাদের? আর আক্রোশ নয় আর প্রেসটিজ নয়- আর জয়, পরাজয় নয়। লুজার খোঁজে অজুহাত আর উইনার খোজে সলিউশন। জনগণের বিশ্বস্ত প্রতিনিধিদের ওপর ক্ষমতা হস্তান্তর করার ব্যবস্থা করুণ। জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণই একমাত্র গণতান্ত্রিক সমাধান। আসুন, শুরু করি আমাদের অসমাপ্ত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে। আসুন ধর্ম, বর্ণ, রাজনীতি, প্রতিহিংসা পরায়ণতা ভুলি আর ধ্বংস করি দুর্নীতি, অবিচার, অত্যাচার, জয় করি মানবতার, জয় করি নতুন অঙ্গীকারের।
লেখকঃ সুইডেন প্রবাসী।