ভালোবাসার কথা বলতে এসেছি
কবি নির্মলেন্দু গুণের এই কবিতাটা আমার খুবই প্রিয়।
সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,
রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেই সব গোলাপের একটি গোলাপ
গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
…
আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি,
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিলাম।
এই কবিতার শিরোনাম ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’। কবিতাটা আমার খুবই প্রিয়, অনেকগুলো কারণে। এই কবিতায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি একজন বাঙালির নিখাদ ভালোবাসার কথা আছে। এই ভালোবাসা কেবল নির্মলেন্দু গুণের নয়, আমাদের প্রত্যেকের। বঙ্গবন্ধু তো আমাদের ভালোবাসার নাম। তাঁকে কবি রফিক আজাদ বলেছেন ‘বাংলার সবচেয়ে রূপবান পুরুষ।’ একটা মানুষ দেখতেও কতটা সুন্দর হতে পারেন! আজ পর্যন্ত কি কেউ বঙ্গবন্ধুর কোনো ফটো দেখেছেন, যাতে তাঁকে অপরূপ দেখাচ্ছে না! তাঁর স্যুট পরা ছবি, তাঁর শেরওয়ানি পরা ছবি, তাঁর পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা ছবি, তাঁর খালি গা লুঙ্গি পরা ছবি—কোনোটাতেই তাঁকে একটুও খারাপ দেখায় না।
বঙ্গবন্ধুকে নিউজউইক অভিধা দিয়েছিল ‘পোয়েট অব পলিটিকস’ বলে। কবি নির্মলেন্দু গুণও ‘স্বাধীনতা এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তুলনা করেছেন, সাতই মার্চের ভাষণকে তুলনা করেছেন কবিতার সঙ্গে, আর উত্তাল জনসমুদ্রকে বলেছেন ‘ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা’। বঙ্গবন্ধুকে এক বিদেশি সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার সবচেয়ে বড় গুণ কী? তিনি বলেছিলেন, এ দেশের মানুষকে আমি খুব ভালোবাসি। তখন প্রশ্ন করা হলো, আপনার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কী? তিনি বলেছিলেন, এ দেশের মানুষকে আমি একটু বেশিই ভালোবাসি।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এই ভালোবাসারই সম্পর্ক।
আমরা জানি, নির্মলেন্দু গুণের কবিতাটা সমকাল পত্রিকায় ১৯৭৭ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। তখন সামরিক শাসনের কাল। বঙ্গবন্ধুর নাম নেওয়া এই দেশে নিষিদ্ধ। ওই সময় কবি নির্মলেন্দু গুণ বাংলা একাডেমির একুশের কবিতা পাঠের আসরে হঠাৎ করেই এ কবিতাটি পাঠ করেন। আমি সেই সকালটাকে কল্পনা করতে পারি। বলছিলাম, এটা আমার খুব প্রিয় কবিতা। এর একটা কারণ, ওই লাইনটা, আজ আমি কারো রক্ত চাইতে আসিনি। হিংসার ঊর্ধ্বে আমাদের উঠতে পারতে হবে। আমাদের ‘রক্ত চাই রক্ত চাই’, ‘ফাঁসি চাই ফাঁসি চাই’ বলা বন্ধ করতে পারতে হবে। যেদিন পারব, সেদিন আমাদের পৃথিবীটা সুন্দর হবে।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণে পরিপূর্ণ নির্দেশনা আছে, তিনি প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে বলেছেন, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলেছেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম বলেছেন, কিন্তু একবারও আক্রমণ করার কথা বলেননি; বরং বলেছেন, এই বাংলার হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-নন বেঙ্গলি, সবার রক্ষার দায়িত্ব আমাদের, আমাদের যেন বদনাম না হয়।
বঙ্গবন্ধু মানুষকে ভালোবাসতেন। বঙ্গবন্ধুকে মানুষ ভালোবাসত। তিনি তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন: আমার মনে আছে খুবই গরিব এক বৃদ্ধ মহিলা কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে শুনেছে এই পথে আমি যাব, আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বলল, ‘বাবা, আমার এই কুঁড়েঘরে তোমার একটু বসতে হবে।’ আমি তার হাত ধরেই তার বাড়ি যাই। অনেক লোক আমার সাথে, আমাকে মাটিতে একটি পাটি বিছিয়ে বসতে দিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান ও চার আনা পয়সা এনে আমার সামনে ধরে বলল, ‘খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছুই নাই।’ আমার চোখে পানি এল। আমি দুধ একটু মুখে নিয়ে, সেই পয়সার সাথে আরও কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বললাম, তোমার দোয়া আমার জন্য যথেষ্ট, তোমার দোয়ার মূল্য টাকা দিয়ে শোধ করা যায় না। টাকা সে নিল না। আমার মাথায়-মুখে হাত দিয়ে বলল, ‘গরিরের দোয়া তোমার জন্য আছে, বাবা।’ নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল, যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি সেই দিন আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মানুষকে ধোঁকা আমি দিতে পারব না (পৃষ্ঠা-২৫৬)
রফিক আজাদ কবিতায় লিখেছেন: পাখি তাঁর খুব প্রিয় ছিল, মাঠভরা শস্য তিনি ভালোবাসতেন।
এটা কেবল কথার কথা নয়। তিনি পশুপাখি, গাছপালা ভালোবাসতেন। কারাগারের রোজনামচা বইয়ে পাব তাঁর বাগান করার বর্ণনা, কীভাবে তিনি ঘাস তুলে ফেলেছেন, আগাছা পরিষ্কার করেছেন, বাগানের যত্ন নিয়েছেন, ফুল ফোটা দেখে খুশি হয়েছেন। আবার পাখিদের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। সেটা তিনি তাঁর ডায়েরিতে লিখেও রাখতেন। তাঁদের টুঙ্গিপাড়ার বাড়িতে ছোটখাটো চিড়িয়াখানা ছিল। ৩২ নম্বরের বাড়িতেও অনেক পোষা পশুপাখি ছিল। কবুতর তো ছিলই। পোষা কুকুর ছিল। আর তিনি জেলখানা থেকে বিড়াল নিয়ে এসেছিলেন নিজের বাড়িতে।
বঙ্গবন্ধু গানও গাইতেন। এই বর্ণনা আমরা পাই কামরুদ্দীন আহমদের স্মৃতিচারণায়। আমার লেখা উপন্যাসে (প্রথম আলো ঈদসংখ্যা ২০১৮) সেটির একটা কাল্পনিক রূপ দাঁড় করিয়েছি বটে, কিন্তু আসল বর্ণনা আমরা কামরুদ্দীন সাহেবের বর্ণনাতেই পাই। ১৯৬২ সালের দিকে কামরুদ্দীন সাহেবকে বেগম মুজিব দাওয়াত করে ৩২ নম্বরের বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে পান্তাভাত, তিন প্রকারেরর শুঁটকি, ইলিশ মাছ ভাজা, পোড়া ডাল, পেঁয়াজ-মরিচ ভর্তা, কষানো গরুর মাংসের আয়োজন ছিল। কামরুদ্দীন সাহেব বলেছিলেন, এসব খাবারে ডাক্তারের মানা আছে। বেগম মুজিব বলেন, আপনারা এত বিধিনিষেধ মানেন বলেই আপনাদের এত অসুখ-বিসুখ। ডাক্তারের কথা না শুনে এসব খেয়ে দেখবেন, ভালো আছেন। সেই দিন শেখ কামাল, তখন তাঁর বয়স ১২-১৩, সেতার বাজিয়ে শুনিয়েছিলেন অভ্যাগত অতিথিদের, আর শেখ মুজিবুর রহমান তিনটা গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন।
তিনি গান ভালোবাসতেন, কবিতা ভালোবাসতেন, প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন, পশুপ্রাণীকে ভালোবাসতেন। আর ভালোবাসতেন বাংলার মানুষকে। আমরাও তাঁকে ভালোবাসি। তিনি আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। অন্নদাশঙ্কর রায়কে তিনি বলেছিলেন, ১৯৪৭ সালে যখন সুরাবর্দী এবং শরৎ বসু যুক্ত বাংলা চেয়েছিলেন, চেয়ে ব্যর্থ হলেন, তখন থেকেই তাঁর স্বপ্নের মধ্যে ছিল সোনার বাংলা।
তিনি আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের মধ্যে ১৯৬২ সালে আগরতলায় চলে গিয়েছিলেন স্বাধীনতা ঘোষণা করলে নেহরুর সাহায্য পাওয়া যাবে কি না, সে ব্যাপারে ফয়সালা করার জন্য। ১৯৬১ সালে তিনি মণি সিংহকে এক গোপন বৈঠকে বলেছিলেন, স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই। মণি সিংহ বলেছিলেন, এখনো সময় হয় নাই। তিনি সত্তরের নির্বাচনের আগেও বলেছেন, নির্বাচনে তিনি যাচ্ছেন বটে, তবে তাঁর আসল লক্ষ্য স্বাধীনতা; এটা পাকিস্তানি গোয়েন্দারা শুনে ফেলেছিল।
জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, একটা জনগোষ্ঠী জাতি হতে চায়, এই আকাঙ্ক্ষাই তাদের জাতি হিসেবে তৈরি করে। পূর্ব বাংলার মানুষের মধ্যে এই আকাঙ্ক্ষা সঞ্চার করেছিলেন শেখ মুজিব।
ফজলে লোহানী ১৯৭০ সালের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারিতে কয়েক কিস্তিতে বঙ্গবন্ধুর এক সাক্ষাৎকারমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন ইত্তেফাক-এ। তাতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে জেলখানা থেকে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার সময়ের বর্ণনা ফজলে লোহানী দিয়েছেন এভাবে:
ঢাকা সেন্ট্রাল জেল। মিলিটারি গাড়ি। সৈন্যরা নেমে সঙিন উঁচিয়ে দাঁড়াল। ভেতরে নিঃসঙ্গ এক বন্দী। বন্দী ছোট একটা অনুরোধ জানায়। শুধু এক মুহূর্ত সময় দাও। তারপর কারাগারের সামনের এক মুঠি ধুলো তুলে কপালে স্পর্শ করে—এই দেশেতে জন্ম আমার যেন এই দেশেতে মরি।
বঙ্গবন্ধু এই দেশের মাটিতে শুয়ে আছেন। তাঁর জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায়।
আজ আমি কারো রক্ত চাইতে আসিনি, আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে এসেছি।