ভিসির যৌন-নিপীড়নের প্রতিবাদে উত্তাল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
খুলনাঃ
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির নির্মাণ দুর্নীতি, বিধিবহির্ভুতভাবে অযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ, স্বজনপ্রীতিসহ আরও নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদে ক্যাম্পাস কিছুদিন ধরে খুব উত্তাল। এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে ভিসির যৌন-নিপীড়নের খবর। তার প্রতিবাদে চরম উত্তপ্ত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর ধর্ষণকাণ্ডে সারাদেশ যখন ফেটে পড়েছে। জনতা প্রশ্ন করছেন পথে, কর্মব্যস্ত জীবনের নানা বাঁকে মেয়েদের নিরাপত্তা দেবে কে? ঠিক সেইসময় আরও গুরুতর প্রশ্ন তুলেছেন বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শামীমা আক্তার।
এদিকে শামীমা আক্তারের বিষয়টি প্রকাশ্যে আশার পর খুবি’র ছাত্রছাত্রীরা আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে মানববন্ধন করেছে।
শামীমা ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে তিনি তুলে ধরেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরির জন্য তিনি যখন ভাইভা দিয়েছিলেন, তখন নিয়োগ বোর্ডে ভিসি তাঁকে যেভাবে যৌন-হয়রানি করেছিলেন তার বিবরণ। তিনি লিখেছেন: ‘বাস্তব অভিজ্ঞতা আমাদের নির্মম। স্বল্পসময়ের নিয়োগবোর্ডেও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মহোদয় নারীর হাফপ্যান্ট পরিধানসংক্রান্ত নানাবিধ আপত্তিকর প্রশ্ন তুলে আমাকে বিব্রত করেছিলেন। সম্প্রতি তাঁকে নিয়ে দুর্নীতিসহ নানাবিধ অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু একজন নিপীড়ক হিসেবে তাঁকে কেউ প্রশ্নবিদ্ধ করেননি। জানি না ঐ মুহূর্তে নিয়োগবোর্ডে উপস্থিত পরীক্ষকবৃন্দ কী ভেবেছিলেন। সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে মানসিক ধর্ষণ যদি বৈধ হয়, তবে ব্যস্ত পথে শিক্ষার্থী ধর্ষণ তো আরো বৈধতা পাবে।’ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন-নিপীড়ন রোধে প্রচলিত যে আইন তাতে স্পষ্ট বলা আছে, ‘যৌন হয়রানি বা নিপীড়নমূলক উক্তি’, ‘যৌন আবেদন মূলক মন্তব্য বা ভঙ্গি’, ‘অশালীন ভঙ্গি, অশালীন ভাষা বা মন্তব্যের মাধ্যমে উত্যক্ত করা’ সরাসরি যৌন হয়রানি। একটি টিভিতে নিপীড়নের শিকার এই শিক্ষক বলেছেন, বিষয়গত প্রশ্ন না করে বোর্ডে ভিসি অপ্রাসঙ্গিক বিষয়কেই বারবার টেনে আনছিলেন। বোর্ডে ভিসি তার উপর ভীষণ মাত্রায় আক্রমনাত্মক ছিলেন, তার বলার ভঙ্গি, তার মন্তব্য এবং তার প্রতি ভিসির তীব্র কটাক্ষ সব মিলিয়ে তিনি ভীষণভাবে নিপীড়িত হয়েছেন। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন-নিপীড়ন রোধে প্রচলিত যে আইন তার ভাষ্য অনুসারে এটি স্পষ্ট যৌন হয়রানি। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বোর্ডের মতো জায়গাতে স্বয়ং ভিসির দ্বারা একজন নারী এই যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। তাহলে নারীর নিরাপত্তা কোথায়?
এ বিষয়ে জানতে চাইলে, সেই বোর্ডের একজন সদস্য, কলা ও মানবিক স্কুলের ডিন শেখ মো. রজিকুল ইসলাম বলেন: আমাদের এই শিক্ষার্থীকে বোর্ডে যেভাবে হেনস্তা করা হয়েছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমি বোর্ডে এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করি এবং তর্ক-বিতর্কের একটা পর্যায়ে বোর্ড বাতিল হয়ে যায়।
উল্লেখ্য, শামীমা আক্তারের রেজাল্ট তার সময়ের সর্বোচ্চ। তিনি মাস্টার্সে থিসিস গ্রুপের শিক্ষার্থী ছিলেন। মেধা এবং অধ্যাবসায়ের জন্য অভিনন্দিত না করে ভিসি নিয়োগ বোর্ডে তাঁকে নিপীড়ন করেন। এ বিষয়ে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষার্থী জানান, কিছুদিন আগে ক্যাম্পাসের লাইব্রেরিতে এক নারীকে ধর্ষণ করার পর পাপ্পু কুমার মণ্ডল নামের এক ধর্ষক হাতে নাতে ধরা পড়লেও এই প্রশাসন সেই ধর্ষককে পুলিশে না দিয়ে ছেড়ে দেয়। তাদের ভাষ্য, এক যৌন নিপীড়কই কেবল কোনো ধর্ষককে পালাতে সাহায্য করতে পারেন। স্বয়ং ভিসি ধর্ষকের সমর্থক হলে, তার কাছে এই ক্যাম্পাসের কোনও ছাত্রীই নিরাপদ নয়।
লাগামহীন দুর্নীতির পর ভিসির এই যৌন হয়রানির চিত্র উঠে আসার পর শিক্ষার্থী, শিক্ষাবিদেরা ভীষণ উদ্বিগ্ন। তাঁরা বলছেন, এখন দেখার বিষয়, যে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং একজন নারী দেখা যাক সেই রাষ্ট্র এই যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়?
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান সাংবাদ মাধ্যমকে বলেন, প্রথমত যে নিয়োগ বোর্ডের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে তা প্রায় দেড় বছর আগেকার ঘটনা। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন. বোর্ড অনুষ্ঠিত হওয়ার এতোদিন পর এ প্রশ্ন উঠছে কেনো?
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডের ফরমেশন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধিতেই (ধারা-৫) উল্লেখ রয়েছে যেখানে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দুইজন বাইরের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ শিক্ষক এবং সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন ও বিভাগীয় প্রধান সদস্য। উপাচার্যের সভাপতিত্বে এই ৫সদস্য বিশিষ্ট বোর্ডের সামনেই প্রার্থী উপস্থিত হন। উক্ত নিয়োগপ্রার্থীর নিয়োগ বোর্ডেও পাঁচজন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। তাঁকে যা কিছু প্রশ্ন করা হয়েছে তা উক্ত বোর্ডের সামনেই করা হয়েছে।
উপাচার্য হিসেবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিধিবিধান প্রতিপালন ও ভাবমূর্তি রক্ষার নিরন্তর প্রচেষ্টা করেন। এছাড়া একজন শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতার মহান আদর্শ অবশ্যই লালন করেন। যেখানে কাউকে কষ্ট দেওয়ার ইচ্ছে কোনোকালেই তার ছিলো না বা এখনও নেই। অভিযোগকারী যে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন তা যথাযথ নয় এবং এটি উদ্দেশ্যমূলক। ইতোমধ্যে দেশে বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে। তখনও তিনি এ নিয়ে কোনো কথা বলেননি। অত্র বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করতে যখন একটি স্বার্থন্বেষী মহল তৎপর ঠিক তখনই তাদের কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এমনটি করেছেন বলে তাঁর বিশ্বাস।