ভেজালের ভিড়ে আসল চেনা দায়
সবুজদেশ ডেক্সঃ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মীরা তার বান্ধবীর গায়ে হলুদে দুই হাত ভর্তি মেহেদি আঁকবে। এ জন্য দোকান থেকে মমতাজ ইন্সন্ট্যান্ট একটিভ কালার মেহেদী কিনে আনে। কিন্তু মেহেদি লাগানোর প্রায় ঘণ্টাখানেক পর মেহেদি হাত থেকে ধোয়া শেষেই শুরু হয় বিপত্তি। দুই হাতে প্রচণ্ড জ্বালা-পোড়া শুরু হয়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে হাতের ত্বক ফসকার মতো ফুলে যায়। হাতে বরফ ঘষেও আরাম মেলে না মীরার। উপায় না দেখে কাছের এক ক্লিনিকে ছুটে যায়। চিকিৎসক জানান, মেহেদির ক্ষতিকর রং থেকে হাতের এ অবস্থা। অথচ মেহেদির কোণে লেখা ছিল ‘ত্বকের কোনো ক্ষতি হবে না’! রাজধানীর চাঁদনীচক মার্কেটের প্রসাধনীর দোকান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যান্ড ‘হুডা বিউটি’-এর লিকুইড ম্যাট লিপস্টিক এবং ময়েশ্চারাইজিং ক্রিম কিনেন বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা সুমাইয়া রহমান। প্যাকেটের লেখা ও কৌটা দেখে আসল প্রসাধনী মনে করেই পণ্যগুলো ক্রয় করেন। আর সুমাইয়ার কাছেও আসল প্রসাধনীর কথা বলে আসল হুডা বিউটির দাম রাখেন দোকানি। কিন্তু সেই প্রসাধনী ব্যবহারের আধা ঘণ্টার মধ্যেই ঠোঁট থেকে লিপস্টিকের রং উঠে যায়। আর ময়েশ্চারাইজার ব্যবহারের পরদিনই সুমাইয়ার মুখের ত্বক বড় বড় ব্রণে ভর্তি হয়ে যায়। একই সঙ্গে ত্বকের চামড়ায় কালো ছোপের মতো দাগ পড়ে। ত্বক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনা করে সুমাইয়া জানতে পারেন, ত্বকে নকল প্রসাধনী ব্যবহারের জন্যই এমন হয়েছে।
আশঙ্কাজনক যে, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের পাড়া-মহল্লা ও অলিগলির দোকানে এখন বিক্রি হচ্ছে আসলের মতো দেখতে নকল ও ভেজাল প্রসাধনী। ঢাকায় বিভিন্ন এলাকায় ভ্যানগাড়ি থেকে শুরু করে বড় বড় শপিং মলের দোকানগুলো এখন ভেজাল প্রসাধনী দিয়ে ভর্তি। এমনকি সম্প্রতি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের অভিযানে ঢাকার ধানমন্ডি-২৭ নম্বর পারসোনা বিউটি পারলারে ভেজাল প্রসাধনী সামগ্রীর মজুদ পাওয়া গেছে। এই পারলারে দেশের তৈরি নকল ও ভেজাল পণ্যকে বিদেশি পণ্য বলে গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। পারলার কর্তৃপক্ষ মেয়াদোত্তীর্ণ প্রসাধনী ব্যবহার করছিল যা ত্বকের জন্য ক্ষতিকর ছিল। আবার অনলাইনেও এখন বহু প্রসাধনী সামগ্রীর দোকান থেকে ক্রেতারা আসল ভেবে নকল পণ্য কিনে প্রতারিত হচ্ছেন। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই) এক কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ভেজাল প্রসাধনী তৈরিতে জড়িতদের লঘুদণ্ড দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার পর তারা আবার একই কাজে ফিরে যান। এ জন্য এই ব্যবসায়ীদের আটকানো যাচ্ছে না। চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আজিজুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দীর্ঘদিন ভেজাল প্রসাধনী ব্যবহারের ফলে ত্বকের সাধারণ লাবণ্য নষ্ট হয়ে যায়। প্রাথমিকভাবে এর ব্যবহারে ব্যবহারকারীর কন্ট্রাক ডারমাটাইসিস হয়। এতে তার চামড়া লাল হয়ে যায়। যা পরবর্তীতে অ্যালার্জিক রিয়েকশন তৈরি করে। ভেজাল প্রসাধনীর ব্যবহারে স্ক্রিন ক্যান্সার হওয়ারও আশঙ্কাও আছে। এর পাশাপাশি ত্বকে দানা, হাঁপানি, মাথাব্যথা ও চোখ জ্বালা-পোড়াসহ অন্যান্য রোগের উপদ্রব হয়। বাংলাদেশ কসমেটিক্স অ্যান্ড টয়লেট্রিজের ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য, দেশের বাজারে চার হাজার কোটি টাকার কসমেটিক পণ্য বিক্রি হয়। আর খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের কসমেটিক্সগুলোর প্রায় সবই দেশের বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়, যার দামও খুব বেশি। এ সুযোগে প্রসাধনী ব্যবসায়ীরা নকল প্রসাধনী তৈরি করেন। আবার বাজারে এখন হরহামেশাই ‘এক সপ্তাহের মধ্যে রং ফর্সাকারী’ ক্রিম পাওয়া যাচ্ছে। এ ধরনের সন্দেহজনক প্রসাধনী ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা ব্যবহারকারীকে সতর্ক হতে বলেছেন। তবে নামিদামি কোম্পানির প্রসাধনী কিনলে ঝুঁকি কম থাকে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে নগদ টাকায় কিনতে হয় বলে কিছু সুপারশপ ভিন্ন মাধ্যম থেকে বাকিতে এসব পণ্য ক্রয় করে। এ সুযোগে সুপারশপেও নকল পণ্য ঢুকে যায়। আবার মিটফোর্ডের কিছু কেমিক্যাল দোকান থেকেও ভেজাল প্রসাধনী তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ করে তা দিয়ে ভেজাল কারখানায় নকল পণ্য তৈরি করানো হচ্ছে। বাজারে বর্তমানে সানসিল্ক, ডাভ ও সেনসোডাইনসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নকল প্রসাধনী সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে। সম্প্রতি র্যাব-১০ এর অভিযানে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় এ ধরনের ভেজাল প্রসাধনী সামগ্রীর পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে ১৪ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। একই সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের ১ কোটি টাকার নকল পণ্য ধ্বংস করা হয়। জানা যায়, দেশি-বিদেশি স্বনামধন্য বিভিন্ন কোম্পানির ২৪ প্রকার প্রসাধনী কোনো প্রকার মান নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই নকল করে সেখানে উৎপাদন করা হতো। এ ছাড়া সম্প্রতি চকবাজারেও র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত বিপুল পরিমাণ নকল ও ভেজাল প্রসাধনী সামগ্রী উদ্ধার করে। সেই অভিযানে চকবাজারের হাজী মনির হোসেন মার্কেটে তুষার ট্রেডার্স নামের দোকান মালিকের ছয়টি গোডাউনে বিপুল নকল প্রসাধনী উদ্ধার করে। যা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নামে নকল করে তৈরি করা হতো। এ ছাড়া চকবাজারে নামবিহীন আরেকটি গোডাউনে বিএসটিআই অনুমোদনবিহীন ৩৮ কার্টন ট্রেসেমি শ্যাম্পু উদ্ধার করা হয়।
(সংগ্রহকৃত)