মন্ত্রণালয় বলেছে, সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও পরিবহনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব শুধু সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নয়। এটি একটি সম্মিলিত কর্মপ্রয়াস। এটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠন, চালক, পথচারীসহ সমাজের সব স্তরের মানুষের দায়িত্ব।
সড়ক পরিবহন খাতে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ও সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে বক্তব্যে বলা হয়, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) দুটি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের পদ ছিল। বর্তমান সরকার তা ১৩টি করেছে। এখন পাঁচজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্মরত আছেন। সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে বিআরটিএতে আরও আটজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে পদায়ন করা হয়েছে। রাজধানী ঢাকা থেকে ২০ বছরের পুরোনো বাস তুলে নেওয়ার লক্ষ্যে এগুলোর রুট পারমিট বা নবায়ন বন্ধ করা হয়েছে।
বক্তব্যে বলা হয়, বিআরটিএর পক্ষ থেকে পেশাজীবী চালকদের প্রতিবছর স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ দেওয়া ও সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিশেষ প্রচারাভিযান চালানো হয়ে থাকে। এটি মন্ত্রীর সদিচ্ছা ও আন্তরিক কর্মপ্রচেষ্টার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মহাসড়কে চলাচলরত পুরোনো বাস ও ট্রাকের বয়সসীমা নির্ধারণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে বলা হয়, কোনো অবস্থাতেই নিয়মবহির্ভূত মোটরযান নিবন্ধন এবং ত্রুটিপূর্ণ মোটরযানের ফিটনেট নবায়ন না করার বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং তদারকি জোরদার করা হয়েছে। সড়ক নিরাপত্তার স্বার্থে ২২টি জাতীয় মহাসড়ক তিন চাকার অটোরিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
মন্ত্রণালয় দাবি করে, ২০১৭ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার ১৮৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৩। ২০১৪ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০৯। এই তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় কমেছে।
মন্ত্রণালয় বলেছে, সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুসারে গত জানুয়ারিতে জাতীয় মহাসড়ক ৭৮ দশমিক ৫২ শতাংশ, আঞ্চলিক মহাসড়ক ৭৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ ও জেলা মহাসড়ক ৭১ দশমিক ০১ শতাংশ ভালো অবস্থায় ছিল। ২০০৯ থেকে গত জুন পর্যন্ত সওজের অনুকূলে উন্নয়ন খাতে ৪৬ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এ সময়ে ৪ হাজার ৩৩১ কিলোমিটার মহাসড়ক মজবুতকরণ এবং ৫ হাজার ১৭১ কিলোমিটার মহাসড়ক প্রশস্ত করা হয়েছে। এ সময়ে অনুন্নয়ন খাতের আওতায় ১১ হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এ অর্থে ৪ হাজার ৮৬৮ কিলোমিটার মহাসড়ক কার্পেটিং ও সিলকোট, ১ হাজার ৮৯২ কিলোমিটার ডিবিএসটি এবং ৮ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার ওভারলে করা হয়েছে। এ সময়ে ৯১৪টি সেতু ও ৩৯৭৭টি কালভার্ট নির্মাণ বা পুনর্নির্মাণ এবং ৯টি উড়ালসড়ক বা ওভারপাস ও ৭টি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০০৯ থেকে গত জুন পর্যন্ত ৪১৬ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক চার লেন বা এর বেশি চওড়া করা হয়েছে। বর্তমানে ৯৫ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের কাজ চলছে।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ঢাকা-আরিচা জাতীয় মহাসড়কের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক সোজা করা হয়েছে। জাতীয় মহাসড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ ১৩০টি স্থান চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রণালয় বলেছে, বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং এর কার্যক্রম সুচারুরূপে পরিচালনার সুবিধার্থে ঢাকা মহানগরীতে বিআরটিএর নিজস্ব অফিস ভবন নির্মাণ, জনবল কাঠামো পরিবর্তন ও বিআরটিএর জন্য পৃথক আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া সড়ক নিরাপত্তা কার্যক্রম জোরদার করার জন্য দুর্ঘটনা প্রতিরোধকল্পে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গাফিলতি ও অবহেলা নিয়ন্ত্রণের জন্য সড়ক পরিবর্তন আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনের উল্লেখ করে মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যে বলা হয়, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মন্ত্রণালয়ে থাকেন কম, বিষয়টি অসত্য ও অবমাননার শামিল। জরুরি প্রয়োজনে অফিসের বাইরে থাকলেও তিনি দিনের কাজ দিনেই শেষ করেন। দিন শেষে মন্ত্রীর দপ্তরে কোনো নথি অনিষ্পন্ন রাখার নজির নেই।
প্রতিবেদকের বক্তব্য
প্রকাশিত প্রতিবেদনের সব তথ্য-উপাত্ত যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করে উপস্থাপন করা হয়েছে। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় যে পাঁচ পাতার বক্তব্য দিয়েছে, সেখানেও প্রথম আলোর কোনো তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত নেই। মন্ত্রণালয় বরং উন্নয়ন ও সিদ্ধান্তের তালিকা তুলে ধরেছে। তবে সিদ্ধান্তগুলো কেন বাস্তবায়ন হচ্ছে না, তা উল্লেখ করেনি।
দেশের সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও পরিবহনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব শুধু সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নয়-এটা ঠিক। তবে চালকের লাইসেন্স, যানবাহনের নিবন্ধন ও ফিটনেস সনদ দেওয়ার দায়িত্ব এই মন্ত্রণালয়ের। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও পরিবহন খাতের শৃঙ্খলা রক্ষায় ‘সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল’ ও ‘সড়ক নিরাপত্তা উপদেষ্টা পরিষদ’ নামে দুটি সর্বোচ্চ সরকারি কমিটি আছে। পদাধিকারবলে দুই কমিটিরই প্রধান সড়ক পরিবহনমন্ত্রী। ঢাকা ও এর আশপাশে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়কারী হিসেবে আছে ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। এটিরও প্রধান সড়কমন্ত্রী।
মন্ত্রণালয় বলেছে, ২০ বছরের পুরোনো বাস তুলে দেওয়া এবং এগুলোর চলাচলের অনুমতি/নবায়ন বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত কতগুলো বাস তুলে দেওয়া হয়েছে বা অনুমতি বাতিল হয়েছে, তার কোনো হিসাব দেওয়া হয়নি।
মিরপুরে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ফিটনেস সনদ দেওয়ার যন্ত্র চালুর কথা বলা হয়েছে। তবে এই যন্ত্র দিয়ে দিনে ২০০ যানবাহনের বেশি পরীক্ষা করা যায় না। বিআরটিএ এর আগে সারা দেশে এমন পাঁচটি যন্ত্র বসালেও তা অল্প দিনেই অকেজো হয়ে পড়ে।
মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যে দূরপাল্লার বাস ও ট্রাকের গতিসীমা নির্ধারণ এবং তা তদারকির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পুলিশের প্রতিবেদনই বলছে, সড়ক দুর্ঘটনার ৯০ শতাংশই অতিরিক্ত গতি ও চালকের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে ঘটছে। ফলে তদারকি কতটা কার্যকর, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
পুরোনো বাস ও ট্রাকের বয়সসীমা নির্ধারণের পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। অথচ সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের পর এ বিষয়ে প্রথম একটি বৈঠক করেছে বিআরটিএ। ২২ মহাসড়কে তিন চাকার যান নিষিদ্ধ, যানবাহনের আকৃতি পরিবর্তন রোধে কার্যক্রমের কথা বলা হয়েছে। তবে বাস্তবে এখনো মহাসড়কে তিন চাকার যান চলছে এবং নিয়মিত দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে।
২০১৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার কমেছে বলে দাবি করা হয়েছে। তবে এমন কোনো প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়নি।