ফারুক নোমানীঃ

আমাদের এই সমাজে কিছু মানুষ আছেন যাঁরা প্রচারবিমুখ। নীরবেই তাঁরা তাদের মহান দায়িত্ব পালন করেন একনিষ্ঠতার সাথে। দুঃখ যাতনায়ও তাঁরা হাল ছাড়েন না কখনো। শত কষ্টের পরও পরাজয় বরণ করেন না তাঁরা। দুঃখ কষ্টের কথা বলেন না তাঁরা কাউকে। জানান না কোন অভিযোগ ও অভিমান। সমাজের মানুষগুলোকে প্রকৃত মানুষ বানানোই যাঁদের প্রধান কাজ। যারা প্রভাব সৃষ্টি করেন সরাসরি মানুষের হৃদয়ের ওপরে। অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া লোকটিকেও যারা ফিরিয়ে আনেন আলোর পৃথিবীতে। সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলা অব্যহত থাকার পেছনে যাঁদের অবদান সবচে’ বেশি। সামাজিক অপরাধ বন্ধের জন্যেও যাঁদের রয়েছে নিরলস প্রচেষ্টা। যাঁরা ‘সম্মানী’র নামে সামান্য অর্থ পেয়েও স্বাচ্ছন্দে সমাজ উন্নয়নের কাজ করে যান অবিরতভাবেই। সমাজের প্রধান জীব এই মানুষের জন্যই যাঁরা এত পরিশ্রম করেন, অথচ এই মানুষরূপী কিছু অমানুষের হাতেও তাঁরা হন লাঞ্ছিত, শুধু সত্য ও সুন্দরের কথা বলার কারণে। মাদকের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা তৈরির ‘অপরাধে’ আবার কখনো হয়রানির শিকারও হন তাঁরা। মসজিদের ভেতরেই তাদেরকে রক্তাত্ব করার ইতিহাসও কম নয় এই সোনার বাংলাদেশে। তারপরও তাঁরা থেমে থাকেন না। এলাকার ত্রাস মাদককারবারির হেদায়েতের জন্য যেমন রাতের অন্ধকারে নির্জন নিস্তব্ধতায় মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন, আবার জনসাধারণকেও মাদকের ভয়াবহ ক্ষতি থেকে বেঁচে থাকার জন্য সতর্ক করেন। ঠিক যেমন যুগে যুগে নবীগণ যে কাজ করেছেন, সেই কাজই নবীদের আগমনধারার সমাপ্তির পর এখন তাঁরাই করছেন। অন্ধকার থেকে মানুষকে আলোয় ফিরিয়ে আনাই তাঁদের জীবনের মূল লক্ষ্য।

পাঠক, নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন কাদের কথা বলছি! বলছি, আমাদের সমাজের মসজিদের সম্মানিত ইমামগণের কথা। যাঁরা সমাজকে সুস্থ ও সুন্দর রাখতে মানুষের হৃদয়ের চিকিৎসা করেন। রাষ্ট্র কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে যে বিজ্ঞাপন, প্রচারপত্র, বিলবোর্ড তৈরি করে সামাজিক অপরাধ যতটুকু কমাতে না পারে, তারচে’ অনেক বেশি কমে সম্মানিত ইমামদের জুমআর বয়ান বক্তৃতার মাধ্যমে। ইমামগণ গণমানুষের সাথে সম্পর্ক রাখেন। একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে তাঁদের সম্পর্ক। তাই একজন খেটে খাওয়া মানুষ যেমন মসজিদে এসে ইমামের সামনে আদবের সাথে বসে, ঠিক একইভাবে রাষ্ট্রের ঊর্ধতন ব্যক্তিবর্গ, এমনকি রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত ইমামের সামনে হাঁটু গেড়ে ছাত্রের মত বসে তাঁর কথা শোনেন। তিনি তাদেরকে শোনান- ন্যায়বিচারের কথা, সততা ও আদর্শের কথা। সত্য ও সুন্দরের কথা। আবার তিনি জাতিকে সতর্ক করেন জুলুম অত্যাচার, আত্মসাত, দুর্নীতি, সুদ, ঘুষ, খুন, ধর্ষণ, যৌতুকসহ অন্যান্য সামাজিক অপরাধ থেকে। তিনি কথা বলেন হৃদয়ের গভীর থেকে, বড় মমতা দিয়ে, তাই তাঁর কথাগুলো মানুষের হৃদয়ে গিয়ে পৌঁছে। মানুষ চিন্তা করতে শেখে। তার ভেতর বিবেচনা শক্তি সৃষ্টি হয়। এক সময় সে পাপের পথ ছেড়ে আলোর পথ ধরে।

একটি কথা ও তার অসারতা:
‘যার নেই কোন গতি, সে করে ইমামতি’ কথাটি সমাজে বহুল প্রচলিত হলেও এটি একটি অসার কথা। অবান্তর দাবি। যা বড়ই অবাস্তব। অনেক ইমাম আছেন যাঁরা সম্ভ্রান্ত ও ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। কোন গতি না পেয়েই তাঁরা ইমামতির পদ বেছে নিয়েছেন এমন নয়। স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে তাঁরা এই সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। মসজিদের ইমামতি গ্রহণ করেছেন তাঁরা জাতি ও সমাজের কল্যাণে। তাছাড়া নিজের পরকালীন সমৃদ্ধির জন্যেও ইমামতি অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। একজন ব্যক্তি যখন ইমামতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন এই গুরুদায়িত্বের কারণে অনেক ভালো কাজ তার রীতিমত অভ্যাসে পরিণত হয়। প্রথমত পাঁচ ওয়াক্ত নামায তিনি তো জামাতে পড়তে পারছেনই। এ দায়িত্ব না থাকলে অনেক সময় তা নানা কারণে ছুটে যাবার সম্ভাবনা ছিল। দ্বিতীয়ত ইমাম সাহেব মসজিদে আসেন নামাযের বেশ আগেই, বের হনও প্রায় সবার পরে। তাই অন্যদের তুলনায় অধিক নফল নামায ও যিকির আযকার করার সুযোগ তুলনামূলক সম্মানিত ইমামের অনেক বেশি। তৃতীয়ত ইমামকে সমাজের মানুষ সর্বোচ্চ সম্মানের চোখে দেখে। তাই তিনি এই পদের কারণেও থাকেন অনেক অপরাধ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। মানুষের সাথে তার আচরণ হয় মধুর। তার ব্যবহার হয় অত্যন্ত মার্জিত। লেনদেনে তিনি থাকেন স্বচ্ছ। মোটকথা ইমামতির কারণে একজন ইমাম পরকালীন পাথেয় সংগ্রহে থাকেন অন্যদের তুলনায় অনেক অগ্রগামী। সে বিষয়টি বিবেচনা করেই অনেকে আসেন ইমামতির এই মহান সেবায়। জতির এই মহত খেদমতে। নিরুপায় হয়ে নয়।

ইমামতি কোন তুচ্ছ সেবা নয়:
ইমাম ও ইমামতিকে তুচ্ছ চোখে দেখার লোকের অভাব নেই এই সমাজে। অনেকে মসজিদের ইমামের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করাকে নিজের জন্য বড়ত্বের কারণ মনে করে। বাড়ির বউয়ের সাথে ঝগড়া করে এসে সে রাগও ঝাড়ে অনেকে ইমাম মুয়াজ্জিনের ওপর। পরিবারে যে লোকটির কোন গুরুত্ব নেই, চরম অবহেলা ও অবজ্ঞায় যার দিন পর হয়, এমন লোকও মাস্তানি করে ইমামের সাথে। এই নিরীহ মানুষগুলো উদ্ধত অহংকারীর এই অমার্জিত আচরণ সহ্যের জন্যই যেন সৃষ্টি হয়েছেন! মসজিদের সম্মানিত ইমামকে নরম পেয়ে সমাজের অসাধু অনেকে জমের আচরণ করতেও দ্বিধা করে না।

পাঠক, মানুষের চোখে ইমামতি একটি সাধারণ পেশা হলেও তা প্রকৃত পক্ষে দেশ ও দশের জন্য অনেক বড় মানের একটি সেবা। মানুষের কল্যাণে কাজ করাই এ সেবার মূল বৈশিষ্ট্য। আবার আল্লাহর কাছেও তা অনেক বড় মর্যাদা ও সম্মানের। পৃথিবীতে যত নবী এসেছেন তাঁরা সকলেই ইমামতির এই দায়িত্ব পালন করেছেন। নবীগণ যেমন মানুষকে সত্য ও আলোর পথে ডাকতেন, আবার নামাযের সময় হলে তাঁরাই ইমামতি করে নামায পড়াতেন। তাই খোলাসা করে বললে বলতে হবে- ইমামতি হলো নবী ওয়ালা একটি কাজ বা নবীদের অন্যতম একটি কাজ। ইসলামের সোনালী যুগের আদর্শ শাসকদের ইতিহাসও তাই বলে। যিনি রাষ্ট্রপ্রধান তিনিই নামাযের ইমাম। খায়রুল কুরুন বা সর্বোত্তম যুগে তো তাই হয়েছে। আবু বকর, ওমর, ওসমান, আলী (রাযিআল্লাহু আনহুম) তো যেমন রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন, তেমনি ছিলেন নামাযেরও ইমাম। ইমাম শব্দের প্রকৃত অর্থ তাঁরাই প্রকাশ করে গিয়েছেন। আরবীতে ইমাম অর্থ নেতা, যিনি সমাজে নেতৃত্ব দিতেন, তিনিই করতেন সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত নামাযের ইমামতি।

ইমামতির এযুগ ও সেযুগ:
ইমামতির এই মহান সেবা তার পূর্ণ গাম্ভীর্য ও সৌন্দর্য হারিয়েছে মুসলিমদের শাসনক্ষমতা হারাবার পরই। ইসলামী খিলাফত আমলে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের জনগণের মানবিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য যোগ্যতা অনুপাতে রাষ্ট্রই মসজিদের ইমাম নিয়োগ করত। তাঁদের সম্মানজনক সম্মানী ভাতা বরাদ্দ থাকত রাজস্ব থেকেই। ভারতবর্ষের মুসলিম শাসনও এর বিপরীত ছিল না। সুলতানী ও মোঘল আমলে মসজিদের জন্য জায়গা ওয়াকফ করে দেয়া হত রাষ্ট্র থেকে। সেই জায়গার উপার্জিত অর্থ ব্যয় হত ইমাম, মুয়াজ্জিনের সম্মানী ও মসজিদের উন্নয়নমূলক কাজে। কালের আবর্তে পৃথিবী হারিয়েছে ইসলামী খিলাফতের স্বর্ণযুগ। ভারতবর্ষের উন্নয়নের রূপকার সুলতানী ও মোঘল শাসনও এখন ইতিহাসের পুরনো পাতায় শুধু স্মৃতি হয়ে আছে। ইংরেজ দখলদারদের হাতে উপমহাদেশের ক্ষমতা যাবার পর তারা সব থেকে নির্মম নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছে মুসলিমদের ওপর। তাদের ধর্মীয় বিদ্যাপীঠ ও উপাসনালয় মসজিদগুলো মিশিয়ে দেয়া হয় মাটির সাথে। কিছু মসজিদকে পরণিত করা হয় তাদের ঘোড়ার আস্তাবলে। মসজিদের ওয়াকফকৃত জায়গাগুলো কেড়ে নেয়া হয়। ইমাম, আলেম ও ধর্মগুরুদের প্রতি করা হয় অমানবিক অত্যাচার। গুলি করে, জবাই করে, আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় অসংখ্য মসজিদের মুক্তিকামী ইমামকে। সে এক বেদনার ইতিহাস। লোমহর্ষক বিবরণ। তারপর থেকে এই উপমহাদেশের মুসলিমরা যেমন অর্থনীতিতে তেমনি রাজনীতিতে অনেক পিছিয়ে পড়লেন। যেখান থেকে একেবারে উঠে আসা এখনোই সম্ভব হয়নি তাদের। আর সঙ্গত কারণেই ইমামদের পূর্বের অবস্থা আর ফিরে আসেনি এখনো।

এখনকার মসজিদগুলো কমিটি পরিচালিত। তারাই ইমাম রাখেন, আবার তারাই বাদ দেন। অধিকাংশ মসজিদের পরিচালনা পর্ষদে থাকেন এলাকার প্রভাবশালীরা। ধর্মীয় জ্ঞান বা সামাজিক বোধ না থাকলেও তারা প্রভাবের বলে হন মসজিদ কমিটির সভাপতি/ সেক্রেটারি। এদের অনেকেই জানেন না মানুষের সাথে কথা বলার সৌজন্যতাটুকুও। তাই মসজিদের ইমামকেও বাড়ির কর্মচারির মত ধমক দেয়াকে কোন অপরাধই মনে করেন না এরা। কিছুলোক কমিটিতে আসে টাকার গরমে। হোক না তা কালো টাকা। এই টাকার কুমিরদের অধিকাংশই জানে না, কেমন ইমাম রাখা প্রয়োজন। তারা মনে করে দেখতে ও কণ্ঠ শুনতে ভালো এমন কারো রাখলেই তো হল, এখানে আবার জ্ঞানবিদ্যার কী প্রয়োজন আছে! গ্রামের মসজিদের ইমামরা থাকেন বড়ই সমস্যায়। গ্রামের মসজিদে চোখ ঝলসানো সৌন্দর্য থাকলেও অধিকাংশ মসজিদে এমন ইমাম নেই যার পেছনে নামায সহীহ হয়, বা যিনি এলাকার মানুষের ধর্মীয় প্রয়োজন পূর্ণ করতে পারেন। মসজিদের অপ্রয়োজনীয় অনেক সৌন্দর্য বর্ধনের সময় তেমন একটা টাকার অজুহাত আসে না। আসে একটা যোগ্য ইমাম রাখার কথা শুনলে। তাই অল্প পয়সায় ইমামতির গুরুদায়িত্ব দেয়া হয় কোন অপরিপক্ক লোকের কাঁধে। যা বড়ই দুঃখজনক। এভাবে শহর ও গ্রামের অধিকাংশ মসজিদ চলে অযোগ্য কমিটির তত্ত্বাবধানে। তাই সেখানে যোগ্য ইমামের যেমন অভাব, আবার যোগ্য ইমাম থাকলেও অযোগ্য কমিটির কারণে তিনি সামাজিক ও মানুষের আধ্যাত্মিক অনেক কাজ থেকেই হন বঞ্চিত। দিতে পারেন না জাতিতে কাঙ্খিত সেবা।

সম্মানী বাড়ে শম্বুক গতিতে:
একজন নিরক্ষর রিক্সাচালক অন্যের রিক্সা ভাড়া নিয়ে চালালেও ভাড়া পরিশোধ করে তার মাসিক আয় থাকে অন্তত ১৩-১৫ হাজার টাকা। ভাড়ায় চালিত ইজিবাইকের চালকও মালিকভাড়া দিয়ে অনায়াসেই কামাতে পারেন মাসে অন্তত ১৫ হাজার টাকা। মাঠে যে কৃষক অন্যের জমিতে শ্রম দেয়, সকাল থেকে একটা পর্যন্ত কাজ করেই সে পায় তিন থেকে সাড়ে তিনশ’ টাকা। তথা মাসে তার কামাই ৯ হাজার থেকে সাড়ে ১০ হাজার। এমনিভাবে রাজমিস্ত্রির হেলপার তারও এমন আয়। অথচ তাদের ডিউটি কতটুকু সময়? তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতাই বা কী! কিন্তু একজন ইমামের দায়িত্ব শুরু হয় সুবহে সাদিক বা প্রভাতবেলা থেকেই। চলে রাত পর্যন্ত। আবার সকালে ফজরে ওঠার জন্য তাকে রাতে ঘুমাতে হয় সতর্কতার সাথে। এভাবে দিনরাতে পাঁচবার নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন কত কঠিন তা ভুক্তভোগীরাই জানেন। যেখানেই তিনি থাকেন আর যাই করেন না কেন মন থাকে কখন নামাযের সময় হবে সেদিকে। মানসিক একটি চাপ তিনি অনুভব করেন সব সময়ই। তাই এ হিসেবে বলা যায়, ইমামের দায়িত্ব শুধু পাঁচবার হলেও তিনি এজন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন পুরা চব্বিশটি ঘণ্টা। অথচ তার এ জন্য সম্মানী দেয়া হয় কত? মফস্বল শহরে ২ হাজার থেকে ৭ হাজার পর্যন্ত। তবে বড় লজ্জার কথা হল ৭ হাজার টাকা সম্মানী দেয়া এমন ইমাম একশ’ জনের মধ্যে হাতে গুনে পাঁচজন পাওয়াও কঠিন হয়ে যাবে। আবার কিছু মসজিদে তো তিন হাজার টাকা সম্মানি, তবে বাকী থাকে চার মাস! মসজিদ কমিটি যা শুনে সবচে’ বেশি কষ্ট পান তা হল ইমামের বেতন বৃদ্ধির আবেদন। সম্মানী বাড়ানোর আবেদন শুনে অনেকে তো কলিজা ছেঁচা কষ্ট অনুভব করেন। অথচ ইমামের বেতন তিনি নিজের পকেট থেকে দিচ্ছেন না, দিচ্ছেন আমজনতার অনুদান থেকেই। তবুও কিছু অসাধু মানুষের এ কষ্ট কিছুতেই কমে না। বছরের পর বছর পার হয়ে গেলেও বাড়ে না ইমামের সম্মানী। আবার বাড়লেও তা বাড়ে ঠিক শামুকের গতিতে। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের গায়ে কিন্তু আগুন লেগেই থাকে সবসময়।

ইমামের ছুটি:
ঝড় বৃষ্টি তুফানে সব কিছু বন্ধ থাকতে পারে, কিন্তু ইমামের দায়িত্ব পালন কোনরকম বন্ধ নেই। হরতাল অবরোধ আন্দোলনে বন্ধ থাকতে পারে দোকানপাট, কলকারখানা, অফিস আদালত, ছুটি থাকতে পারে সকল শ্রেণী পেশার মানুষের। কিন্তু যার কোন ছুটি নেই তিনি হলেন মাননীয় ইমাম। সরকারী কর্মচারী, কর্মকর্তাদের আছে বছরে অফুরন্ত ছুটি। সরকারী ছুটির ফিরিস্তি বড় লম্বা। অন্তত এদেশের সরকারী বর্ষপঞ্জিতে ছুটির তালিকা লালে লাল হয়ে থাকে। যা পৃথিবীর অন্য কোন দেশে আছে কিনা সন্দেহ। বেসরকারীদেরও আছে ছুটির নিজস্ব নীতিমালা। তারাও অন্তত সপ্তাহে একটি দিন ছুটি পান। এতে পরিবার ও আত্মীয়স্বজনকে প্রতি সপ্তাহে অন্তত কিছুটা সময় দিতে পারেন। কিন্তু একজন ইমামের ছুটি? লোকে বলে, ইমামের আবার ছুটি কিসের! ভাবখানা এমন যেন ইমাম আকাশ থেকে নেমে আসা কোন ফিরিশতা। তার নেই কোন ঘর সংসার। নেই কোন স্ত্রী সন্তান। এমনকি বছরের দুই ঈদেও ইমামদের জন্য নিয়মতান্ত্রিক কোন ছুটি বরাদ্দ নেই। ঈদে একটু ছুটির আবেদন করলেও অনেক ‘দরদী’ কমিটি বলে, আপনি গেলে মসজিদ চালাবে কে? উত্তরটি সুন্দর না! আন্তরিকতায় কোন ভেজাল আছে? ঈদের আনন্দে সবাই যখন মজে থাকে অনেক ইমামের ভেতরের কষ্টগুলো গলে গলে বুকে তুফান তোলে। তা দেখার চোখ নেই অধিকাংশ মসজিদ পরিচালনা পরিষদের। শারীরিক অসুস্থতা, পরিবারের কারো কোন সমস্যায় যদি ইমাম এক ওয়াক্ত অনুপস্থিত থাকেন, তখন ঝড় ওঠে মসজিদের মুসল্লিদের মধ্যে। পাবলিক ধরে নিয়েছে ইমাম হলে তার কোন সুখদুঃখ, বিপদ আপদ, রোগ শোক, বালা মসিবত আসতে পারবে না। অনেক নববিবাহিত তরুণ ইমামের শ্বশুরবাড়ি বেড়ানোটা ইমামতির কল্যাণে স্বপ্নই থেকে যায়!

বিদায় নিতে হয় খালি হাতে:
এদেশে মসজিদের ইমাম নিয়োগ ও অব্যাহতি দেয় মূলত মসজিদের পরিচালনা কমিটি। সাধ্য থাকলেও শুধু আন্তরিকতার অভাবে বাড়ে না অধিকাংশ মসজিদের ইমামের বেতন। আবার নির্মম হলেও সত্য যে, ইমামতির এই সেবার নেই কোন নিশ্চয়তা। কমিটি পরিবর্তনে যেতে পারে ইমামের খেদমত। আবার কোন ভালো কাজে কমিটির অসন্তুষ্টিও হতে পারে ইমামের এই সেবা হারাবার কারণ। যখন তখন, যে কোন সময় চলে যেতে পরে এই খেদমত। কোন কারণ দর্শনো ও নোটিশ ছাড়াই। কচুর পাতায় পানির যেমন নিশ্চয়তা নেই, ঠিক একই কথা ইমামতির ক্ষেত্রেও বলা চলে।

তবে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে যখন একজন ইমাম বা মুয়াজ্জিনকে চাকরি থেকে অব্যাহতি বা বহিষ্কার করা হয়। কোনো মসজিদে ২০-৩০ বছর ধরে কেউ ইমামতি করছেন, কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে কয়েক সপ্তাহ নামায পড়াতে পারেননি। তখন তাকে মসজিদ পরিচালনা কমিটি অপসারণ করে। শুধু তাই নয়, যে মানুষটি ২০-৩০ বছর ধরে নামায পড়িয়েছেন তাকে বিদায় নিতে হয় একদম খালি হাতে। অনেকে ইমামতি করতে করতে বার্ধক্যে চলে যান। এ ক্ষেত্রেও তার অর্জন শুধুই শূন্য। বাড়ি ফিরতে হয় খালি হাতে। ছাতি আর লাঠি সম্বল করে।

তবুও কেন আমরা ইমামতি করি:
ইমামদের প্রতি সমাজের যে অবহেলা তা চরম সত্য। এটা অধিকাংশ মসজিদেরই বাস্তবচিত্র। তবে ব্যতিক্রম কিছু তো অবশ্যই আছে। মসজিদ পরিচালনা পরিষদের এই ব্যতিক্রমী সৎ মানুষগুলো একেবারেই হাতে গোনা। আন্তরিকতা নিয়েই যারা মসজিদের দেখভাল করেন তাঁদের সংখ্যা বড়ই নগন্য। তবুও একজন ইমাম সমাজের এই উপেক্ষা অবহেলাকে নিজচোখে প্রত্যক্ষ করেও কেন এ সেবায় নিজেকে নিয়োগ করেন? শারীরিক ও জ্ঞানগত যোগ্যতার ভিত্তিতে তিনি অন্য পেশাও গ্রহণ করতে পারতেন স্বাচ্ছন্দে। অন্যদের মত তিনিও কামাতে পারতেন টাকা পয়সা। কিন্তু এ সুযোগ তিনি ছেড়েছেন শুধু সমাজের মানুষের কল্যাণে। নিজের ভেতরের দাবী থেকেই তিনি মানুষের পরিশুদ্ধির কাজ করেন। মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন সফলতার জন্যই তাঁর এই ত্যাগ ও পরিশ্রম। সমাজে ইমামের ভূমিকা অপরিসীম। পথহারা মানুষকে তিনি নিজের থেকেই পথের সন্ধান দেন। অন্ধকারের পথিককে দেখান আলোর স্বচ্ছধারা। বর্তমান মানুষকে যেমন সামাজিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য মাননীয় ইমাম আপ্রাণ চেষ্টা করেন, একইভাবে চেষ্টা করেন যেন আগামী প্রজন্মও হতে পারে আলোকিত মানুষ। তাই সমাজের ছোট্ট বাচ্চাদেরকে তিনি সকালে বা বিকালে মসজিদে নৈতিক শিক্ষা প্রদান করেন। কুরআন হাদিস শিখিয়ে তাদেরকে সৎ ও যোগ্য নাগরিক হতে অনুপ্রাণিত করেন। সততা ও আদর্শ শিক্ষা দিয়ে তিনি সমাজকে সুন্দর হতে সহায়তা করেন।

খোলাসা কথা, নবীগণ যুগে যুগে মানুষের কল্যাণে যে কাজ করেছেন, তাঁদের পরবর্তীতে এই ইমামগণ সেই দায়িত্বই পালন করছেন। তাঁরা মানুষের জন্য হাসিমুখে বিসর্জন দেন নিজের সুখ আহ্লাদ। আদর্শ, সত্য ও সুন্দরের সমাজ গঠনের জন্য তাঁর ত্যাগ অনস্বীকার্য। তবুও সমাজ নির্মাণের এই নীরব সাধক অবহেলিতই থেকে যান চিরদিন।

লেখক: মুহাদ্দিস বলিদাপাড়া মাদরাসা, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।
ইমাম, মেইন বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদ, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here