বিশেষ প্রতিনিধি, ঝিনাইদহঃ

মা তুমি হুইল চেয়ারে বসে সামনের দিকে নজর রাখো। একদম নড়াচড়া করোনা। চাকায় হাত দিয়ে ঘোরানোর চেষ্টাও করো না। কেননা অচল দেহে আবার পড়ে গেলে আমার সব শেষ।

চেয়ারে বসে তুমি ঠিকমত হ্যান্ডেল ধরে রাখো। আর মানুষের কাছে হাত এগিয়ে দাও। আমি চেয়ারের পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমার তেমন কষ্ট হচ্ছেনা মা। বরং পড়ে গেলেই তোমার ক্ষতি হবে। তখন আমাকে কে দেখবে?

প্রতিবন্ধী মায়ের হুইল চেয়ারের পেছনে ধাক্কা দিয়ে পথচলার সময় কথাগুলো বলছিল ১০ বছরের শিশু সন্তান রাব্বি। আর জীবনের একমাত্র অবলম্বন শিশু সন্তানের এমন কথায় মা আম্বিয়া বেগমের চোখ বেয়ে বেয়ে পানি ঝরছে। হৃদয় বিদারক এমন ঘটনা ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের ছিন্নমূল এক প্রতিবন্ধী মাকে ঘিরে শিশু সন্তানের।

প্রতিবন্ধী আম্বিয়া বেগম বলেন, বাবা আব্দুর রশিদ সর্দার সাতক্ষীরার বলাডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা। ১২ বছর আগে যশোরের মনিরামপুর উপজেলার বাকাশপুর গ্রামের আক্তার হোসেনের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। একমাত্র সন্তান রাব্বির বয়স যখন মাত্র ৩ মাস মাদকাসক্ত স্বামী নির্মমভাবে আমাদের ফেলে চলে যায়। এরপর গতি হয় আমার এক খালার বাড়িতে। সেখানে কাজ করে কোনো রকমে মা ছেলের দিন কাটতো। পরে সেখানে থেকেই ছেলে রাব্বিকে খুলনার শিরোমনির গিলেতলার মোহাম্মদিয়া হাফেজিয়া মাদরাসায় ভর্তি করি।

আম্বিয়া বলেন, আমি কাজ করতাম আর চলতাম। কিন্ত বছর দেড়েক আগে আমি টাইফয়েডে আক্রান্ত হই। অভাবের কারণে ঠিকমত চিকিৎসাসেবা না নিতে পারায় অবশেষে পঙ্গুত্ব হয়েছে আমার জীবনসঙ্গী। পায়ের নিচের অংশ সরু হয়ে গেছে। এখন ভর দিয়ে দাঁড়াতেও পারি না। ফলে চলাচলের জন্য হুইল চেয়ার হয়েছে সম্বল। আমি জানি মানুষের কাছে হাত পাতাটা অসম্মানের। কিন্ত আমার উপায় নেই। আপন বলতে কেউ না থাকায় প্রতিবন্ধী জীবনে বাধ্য হয়ে মানুষের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। এখন একমাত্র শিশুপুত্র রাব্বিকে নিয়ে কালীগঞ্জের মোবারকগঞ্জ রেলস্টেশন পাড়ায় একটি ঝুঁপড়ি বাসায় ভাড়ায় বসবাস করছি।

তিনি আরো বলেন, সাহায্যের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে হুইল চেয়ারে করে যেতে হয়। এ কাজে তার শারীরিক অক্ষমতার জন্য শিশুপুত্র রাব্বির সাহায্য নেন। সে হুইল চেয়ারের পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে নিয়ে চলে। এভাবে সারাদিন ঘুরে মানুষের করুনার টাকা দিয়ে সন্ধ্যায় মা ছেলের খাবার কিনে বাসায় ফিরি। আবার সকাল হলেই মা ছেলে বের হই মানুষের দ্বারে দ্বারে। এভাবে বেঁচে আছি দুটি প্রাণ।

আম্বিয়া বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, শরীরের কর্মক্ষমতা হারিয়ে এখন আমি বড্ড অসহায়। শিশু বাচ্চা হুইল চেয়ার ঠেলে প্রতিদিন বিকেলে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তখন কলিজার টুকরা সন্তানের মুখের দিকে তাকালে খারাপ লাগে। কেননা এখন বাপ্পির খেলার বয়স। তারপরও মায়ের কষ্ট দিতে চায় না সে।

তিনি আরো বলেন, সব সময় চিন্তা করি বাপ্পি বড় হয়ে রোজগার করবে। হাত পাততে হবে না মানুষের কাছে।

কাশিপুর গ্রামের বাসিন্দা শাহানাজ পারভীন জানান, প্রতিবন্ধী আম্বিয়া বেগম তার ছোট্ট ছেলেটাকে নিয়ে খুব কষ্ট করে। মানুষের কাছে হাত পেতেই তাদের বাঁচতে হয়।

কালীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম আশরাফ জানান, সমাজে প্রতিবন্ধী অনেক অসহায় মানুষ আছে। তবে প্রতিবন্ধী মা আম্বিয়াকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে ছোট্র শিশুটি যেভাবে সারাদিন ধাক্কা দিয়ে নিয়ে বেড়ায় তা দেখলেও কষ্ট লাগে।

তিনি বলেন, আম্বিয়া বেগম এ এলাকার নাগরিক নয়। ফলে এখানে তার কোনো ভাতাদির ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে জটিলতা রয়েছে। তারপরও তার অসহায়ত্ব দেখে মানবিক সাহায্য তিনি প্রতিনিয়তই করে থাকেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here