ঢাকা ০৮:৩৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫, ২১ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মোবাইল দেখিয়ে শিশুকে খাওয়ানোর বিপদ জানেন কি

 

প্রত্যেক বাবা-মা চান তার শিশুকে সঠিক শিক্ষা দিয়ে বড় করতে। কিন্তু ছোট ছোট কোন অভ্যাসগুলো যে তাদের অজান্তেই শিশুকে বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পার, তা অনেকেই জানেন না।

যেমন, টিভি বা মোবাইলের সামনে বসিয়ে শিশুকে খাবার খাওয়ানো। এতে শিশু স্ক্রিনের দিকে ব্যস্ত থাকে বলে সহজেই খাবারটা খেয়ে ফেলে। বাবা-মা হয়তো ভাবেন যে- ঠিকঠাক খেয়ে তো নিলো! শরীরে পুষ্টির চাহিদা পূরণ হচ্ছে বলে আভিভাবক খুশি হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এই ছোট্ট একটি অভ্যাস শিশুর ভবিষ্যৎ জীবনে কী কী প্রভাব ফেলতে পারে, তা ভেবে দেখেছেন কি?

বর্তমান যুগে শিশুরা বেড়ে উঠছে এক প্রযুক্তিনির্ভর বাস্তবতায়। যেখানে টেলিভিশন, স্মার্টফোন, কম্পিউটার কিংবা ভিডিও গেম – সবই যেন তাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই স্ক্রিনগুলোর ব্যবহার কিছুটা পর্যন্ত শিক্ষামূলক বা বিনোদনের উৎস হিসেবে কাজে এলেও, সীমা ছাড়িয়ে গেলে তা পরিণত হয় এক ভয়াবহ বিপদে। বিশেষ করে কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে, শিশুদের দৈনন্দিন রুটিনে স্ক্রিন টাইমের মাত্রা এতটাই বেড়ে গেছে যে, সেটি নিয়ন্ত্রণ না করলে শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক বিকাশে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। তাহলে ঠিক কতোটা স্ক্রিন টাইম দেবেন আপনার শিশুকে?

বিজ্ঞান যা বলছে-
১. দুইয়ের আগে স্ক্রিন নয়
শিশুরা যখন ছোট থাকে, তখন তাদের শেখার প্রধান মাধ্যম থাকে দেখা, শোনা এবং স্পর্শ করা। বাস্তব জগতের অভিজ্ঞতা থেকে তারা ভাষা, আচরণ এবং মূল্যবোধ আয়ত্ত করে। কিন্তু যখন এই শেখার মাধ্যম কেবলই স্ক্রিনে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, তখন শিশু তার চারপাশের পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জন্মের পর দুই বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের একেবারেই স্ক্রিন না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। এ বয়সে একটি শিশুর মস্তিষ্ক যে গতিতে বিকশিত হয়, সেখানে স্ক্রিনের ঝলকানি বা অতিরিক্ত ভিজ্যুয়াল সিগনাল তাদের মনোযোগ ও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়।

২. সর্বোচ্চ একঘণ্টা
আমেরিকান একাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স সুপারিশ করেছে যে, দুই থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুরা যেন দিনে সর্বোচ্চ এক ঘণ্টার বেশি স্ক্রিন না দেখে। যেমন- টিভি, মোবাইল, ট্যাব বা কম্পিউটারের পর্দা। তবে এই এক ঘণ্টা স্ক্রিন টাইমও এমনভাবে হওয়া উচিত, যাতে শিশুর ঘুমের সময় বা খেলাধুলা করার মতো শারীরিক কাজের ক্ষতি না হয়।

৩. স্কুলপড়ুয়া শিশুদের আচরণ পাল্টে যেতে পারে
গবেষণায় দেখা গেছে শুধু ছোট শিশুরাই নয়, বড়দের ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম নানা ধরনের জটিলতা তৈরি করে। বিশেষ করে স্কুলপড়ুয়া শিশুরা যারা দিনে দুই ঘণ্টার বেশি সময় টিভি দেখে, ভিডিও গেম খেলে বা স্মার্টফোন ব্যবহার করে, তাদের মধ্যে মনোযোগের ঘাটতি, আবেগ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা এবং আচরণগত পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ঘুমের সময় কমে গেলে শিশুরা হয়ে ওঠে ক্লান্ত ও খিটখিটে মেজাজের। আবার শিশুর ঘরে যদি নিজস্ব টিভি বা স্মার্টফোন থাকে, তবে স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে এবং গবেষণায় দেখা গেছে এই শিশুরা পরীক্ষায় তুলনামূলক খারাপ ফলাফল করে।

৪. শারীরিক স্বাস্থ্যেও পড়ে নেতিবাচক প্রভাব
প্রমিসেস মেডিকেল লিমিটেডের কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট ও সাইকোথেরাপিস্ট নুজহাত ই রহমান বলেন, ‘আজকাল শিশুরা মোবাইল, ট্যাব ও টিভির সামনে অনেক সময় কাটায়, যা তাদের ঘুম, বিশ্রাম ও খাদ্যাভ্যাসে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এতে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, মনোযোগ কমে যায় এবং ভাষার বিকাশে বাধা আসে। ঘুমের অভাবে শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া তারা সামাজিক যোগাযোগে আগ্রহ হারায়, চোখের ওপর চাপ পড়ে।’

৫. শিশুর স্থূলতার কারণ হতে পারে এটি
শুধু শিক্ষার বা ঘুমের ক্ষতি নয়, স্ক্রিনে অতিরিক্ত সময় কাটানোর সঙ্গে স্থূলতার সম্পর্কও বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণিত। যখন শিশু স্ক্রিনে সময় কাটায়, তখন তার শরীর থাকে নিস্ক্রিয় এবং মন থাকে বিভোর। এতে একদিকে শরীরচর্চার সময় কমে যায়, অন্যদিকে টিভির বিজ্ঞাপনে প্রচারিত জাঙ্ক ফুডের প্রতি আগ্রহ বাড়ে। অনেকে আবার খাওয়ার সময় স্ক্রিনে মনোযোগ দিয়ে ফেলায় কতটুকু খেল তা বুঝতেই পারে না, ফলে অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। দীর্ঘমেয়াদে এই অভ্যাস শিশুর স্বাস্থ্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।

তবে শুধু স্থূলতা নয়, ছোট থেকে খাবার দেখে, চিনে ও স্বাদ নিয়ে খাবার খাওয়া শিশুর বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে খাবার গিলে নিলে শিশু খাবার চিনতে শেখে না। কোন খাবারের স্বাদ কেমন, তাও বুঝতে পারেনা। এর ফলে ভবিষ্যতে তার ভালো খাদ্যাভ্যাস গড়ে উঠা কঠিন হয়ে যায়। এই একটি স্বভাব শিশুর শারীরিক বিকাশ, খাদ্যাভ্যাস, স্বাস্থ্য, বাস্তব জ্ঞান – সবকিছুকে প্রভাবিত করে।

৬. শুধু সময় নয়, খেয়াল করুন স্ক্রিনে কী হচ্ছে
যে বিষয়টি অধিকাংশ অভিভাবক বুঝে উঠতে পারেন না, তা হলো স্ক্রিনের মাধ্যমে শিশুরা কী দেখছে। এই বিষয়টি স্ক্রিনে সময় ব্যয়ের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শিশুরা যখন সহিংসতা, অপসংস্কৃতি বা অবাস্তব রোমাঞ্চকর কনটেন্টের সঙ্গে পরিচিত হয়ে যায়, তখন তারা বাস্তব জীবনে এর প্রতিফলন ঘটাতে চেষ্টা করে। এতে শিশুদের চিন্তাধারা ও মূল্যবোধে বিকৃতি ঘটে, তারা সমস্যার সমাধানেও সহিংসতা বা অগ্রহণযোগ্য আচরণকে স্বাভাবিক ভাবতে শেখে।

কীভাবে সামলাবেন প্রযুক্তির সঙ্গে শিশুর সম্পর্ক?
এতোসব ঝুঁকি থাকলেও স্ক্রিনকে একেবারে বন্ধ করে দেওয়া বাস্তবসম্মত সমাধান নয়। কেননা বড় হয়ে প্রযুক্তির বিভিন্ন ব্যবহারের মধ্য দিয়েই বাস্তবজীবনে টিকে থাকতে হবে। তাই এগুলো শিখতে শিখতে বেড়ে উঠতে হবে। তাই দরকার বয়সভিত্তিক গাইডলাইন অনুসরণ করে এ বিষয়ে সচেতনতা ও ভারসাম্য তৈরি করা।

সাইকোলজিস্ট নুজহাত ই রহমান বলেন, ‘শিশুদের স্ক্রিন টাইম কমাতে পরিবারের সচেতনতা জরুরি। বাবা-মায়ের সঙ্গে গুণগত সময় কাটানো, শিশু-কেন্দ্রিক খেলা ও বাস্তব সামাজিক পরিবেশে অংশগ্রহণ তাদের বিকাশে সহায়তা করে। সেই সঙ্গে স্ক্রিনে দেখানো কনটেন্ট যেন শিক্ষামূলক, নৈতিক ও বয়স উপযোগী হয়, যা বিনোদন ছাড়াও শেখার সুযোগ দেয়।’

অভিভাবকদের উচিৎ শিশুদের স্ক্রিন টাইম মনিটর করা, কী দেখছে তা জানা এবং সম্ভব হলে একসঙ্গে বসে দেখা। এতে কনটেন্টের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয় এবং শিশুর মনে যে বিভ্রান্তি বা প্রশ্ন তৈরি হয়, তার সমাধানও দ্রুত সম্ভব হয়। এছাড়াও, ঘরে টিভি বা মোবাইল ফোনের ব্যবহার যেন নির্দিষ্ট সময় ও জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে; এই নীতি পরিবারে প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। খাওয়ার সময়, পড়ার সময় কিংবা ঘুমানোর আগে স্ক্রিন পুরোপুরি বন্ধ রাখা উচিৎ। অভিভাবক যখন নির্টিষ্ট সময় পর টিভি বন্ধ করে উঠে যাবেন, তখন শিশুও সেটি অনুকরণ করতে শিখবে।

স্ক্রিন ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ এনে শিশুকে বাস্তব জগতের সঙ্গে যুক্ত রাখা এখন সময়ের দাবি। মাঠে খেলা, বই পড়া, গল্প শোনা, ছবি আঁকা এসবই শিশুর সৃজনশীলতা ও আবেগ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রযুক্তিকে বাদ না দিয়ে, বরং সঠিকভাবে ব্যবহার করে আমরা আমাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ আরও সুন্দর, স্বাস্থ্যকর এবং ভারসাম্যপূর্ণ করে তুলতে পারি।

শিশুদের স্ক্রিন টাইম কমানো সহজ নয়, কিন্তু অসম্ভবও নয়। কেননা শিশুদের স্ক্রিন নয়, শারীরিক ও মানসিক বিকাশে মানুষের প্রয়োজন। প্রতিদিন একটু একটু করে পরিবর্তন আনলেই সম্ভব শিশুর সুস্থ মানসিক ও শারীরিক বিকাশ নিশ্চিত করা। প্রযুক্তির যুগে বেড়ে ওঠা শিশুরা যদি ভারসাম্য শিখে নেয়, তবে তারাই একদিন হবে ভবিষ্যতের সবচেয়ে প্রগতিশীল ও মানবিক নাগরিক।

তবে মনে রাখবেন, শিশু কথা শুনো যতটা শেখে, তার চেয়ে অনেক বেশি শেখে আপনাকে দেখে। আপনি যদি নিজের স্ক্রিন টাইম সীমিত করেন ও শিশুর সামনে তা তুলে ধরেন, তাহলে আপনার শিশু সেটিকেই স্বাভাবিক মনে করবে।

তথ্যসূত্র: মায়ো ক্লিনিক হেল্থ সিস্টেম, কন্টিনেন্টাল হসপিটালস, আমেরিকান একাডেমি অব চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ

Tag :

মোবাইল দেখিয়ে শিশুকে খাওয়ানোর বিপদ জানেন কি

Update Time : ০৪:৩৫:৩১ অপরাহ্ন, শনিবার, ৫ জুলাই ২০২৫

 

প্রত্যেক বাবা-মা চান তার শিশুকে সঠিক শিক্ষা দিয়ে বড় করতে। কিন্তু ছোট ছোট কোন অভ্যাসগুলো যে তাদের অজান্তেই শিশুকে বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পার, তা অনেকেই জানেন না।

যেমন, টিভি বা মোবাইলের সামনে বসিয়ে শিশুকে খাবার খাওয়ানো। এতে শিশু স্ক্রিনের দিকে ব্যস্ত থাকে বলে সহজেই খাবারটা খেয়ে ফেলে। বাবা-মা হয়তো ভাবেন যে- ঠিকঠাক খেয়ে তো নিলো! শরীরে পুষ্টির চাহিদা পূরণ হচ্ছে বলে আভিভাবক খুশি হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এই ছোট্ট একটি অভ্যাস শিশুর ভবিষ্যৎ জীবনে কী কী প্রভাব ফেলতে পারে, তা ভেবে দেখেছেন কি?

বর্তমান যুগে শিশুরা বেড়ে উঠছে এক প্রযুক্তিনির্ভর বাস্তবতায়। যেখানে টেলিভিশন, স্মার্টফোন, কম্পিউটার কিংবা ভিডিও গেম – সবই যেন তাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই স্ক্রিনগুলোর ব্যবহার কিছুটা পর্যন্ত শিক্ষামূলক বা বিনোদনের উৎস হিসেবে কাজে এলেও, সীমা ছাড়িয়ে গেলে তা পরিণত হয় এক ভয়াবহ বিপদে। বিশেষ করে কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে, শিশুদের দৈনন্দিন রুটিনে স্ক্রিন টাইমের মাত্রা এতটাই বেড়ে গেছে যে, সেটি নিয়ন্ত্রণ না করলে শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক বিকাশে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। তাহলে ঠিক কতোটা স্ক্রিন টাইম দেবেন আপনার শিশুকে?

বিজ্ঞান যা বলছে-
১. দুইয়ের আগে স্ক্রিন নয়
শিশুরা যখন ছোট থাকে, তখন তাদের শেখার প্রধান মাধ্যম থাকে দেখা, শোনা এবং স্পর্শ করা। বাস্তব জগতের অভিজ্ঞতা থেকে তারা ভাষা, আচরণ এবং মূল্যবোধ আয়ত্ত করে। কিন্তু যখন এই শেখার মাধ্যম কেবলই স্ক্রিনে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, তখন শিশু তার চারপাশের পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জন্মের পর দুই বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের একেবারেই স্ক্রিন না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। এ বয়সে একটি শিশুর মস্তিষ্ক যে গতিতে বিকশিত হয়, সেখানে স্ক্রিনের ঝলকানি বা অতিরিক্ত ভিজ্যুয়াল সিগনাল তাদের মনোযোগ ও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়।

২. সর্বোচ্চ একঘণ্টা
আমেরিকান একাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স সুপারিশ করেছে যে, দুই থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুরা যেন দিনে সর্বোচ্চ এক ঘণ্টার বেশি স্ক্রিন না দেখে। যেমন- টিভি, মোবাইল, ট্যাব বা কম্পিউটারের পর্দা। তবে এই এক ঘণ্টা স্ক্রিন টাইমও এমনভাবে হওয়া উচিত, যাতে শিশুর ঘুমের সময় বা খেলাধুলা করার মতো শারীরিক কাজের ক্ষতি না হয়।

৩. স্কুলপড়ুয়া শিশুদের আচরণ পাল্টে যেতে পারে
গবেষণায় দেখা গেছে শুধু ছোট শিশুরাই নয়, বড়দের ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম নানা ধরনের জটিলতা তৈরি করে। বিশেষ করে স্কুলপড়ুয়া শিশুরা যারা দিনে দুই ঘণ্টার বেশি সময় টিভি দেখে, ভিডিও গেম খেলে বা স্মার্টফোন ব্যবহার করে, তাদের মধ্যে মনোযোগের ঘাটতি, আবেগ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা এবং আচরণগত পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ঘুমের সময় কমে গেলে শিশুরা হয়ে ওঠে ক্লান্ত ও খিটখিটে মেজাজের। আবার শিশুর ঘরে যদি নিজস্ব টিভি বা স্মার্টফোন থাকে, তবে স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে এবং গবেষণায় দেখা গেছে এই শিশুরা পরীক্ষায় তুলনামূলক খারাপ ফলাফল করে।

৪. শারীরিক স্বাস্থ্যেও পড়ে নেতিবাচক প্রভাব
প্রমিসেস মেডিকেল লিমিটেডের কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট ও সাইকোথেরাপিস্ট নুজহাত ই রহমান বলেন, ‘আজকাল শিশুরা মোবাইল, ট্যাব ও টিভির সামনে অনেক সময় কাটায়, যা তাদের ঘুম, বিশ্রাম ও খাদ্যাভ্যাসে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এতে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, মনোযোগ কমে যায় এবং ভাষার বিকাশে বাধা আসে। ঘুমের অভাবে শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া তারা সামাজিক যোগাযোগে আগ্রহ হারায়, চোখের ওপর চাপ পড়ে।’

৫. শিশুর স্থূলতার কারণ হতে পারে এটি
শুধু শিক্ষার বা ঘুমের ক্ষতি নয়, স্ক্রিনে অতিরিক্ত সময় কাটানোর সঙ্গে স্থূলতার সম্পর্কও বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণিত। যখন শিশু স্ক্রিনে সময় কাটায়, তখন তার শরীর থাকে নিস্ক্রিয় এবং মন থাকে বিভোর। এতে একদিকে শরীরচর্চার সময় কমে যায়, অন্যদিকে টিভির বিজ্ঞাপনে প্রচারিত জাঙ্ক ফুডের প্রতি আগ্রহ বাড়ে। অনেকে আবার খাওয়ার সময় স্ক্রিনে মনোযোগ দিয়ে ফেলায় কতটুকু খেল তা বুঝতেই পারে না, ফলে অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। দীর্ঘমেয়াদে এই অভ্যাস শিশুর স্বাস্থ্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।

তবে শুধু স্থূলতা নয়, ছোট থেকে খাবার দেখে, চিনে ও স্বাদ নিয়ে খাবার খাওয়া শিশুর বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে খাবার গিলে নিলে শিশু খাবার চিনতে শেখে না। কোন খাবারের স্বাদ কেমন, তাও বুঝতে পারেনা। এর ফলে ভবিষ্যতে তার ভালো খাদ্যাভ্যাস গড়ে উঠা কঠিন হয়ে যায়। এই একটি স্বভাব শিশুর শারীরিক বিকাশ, খাদ্যাভ্যাস, স্বাস্থ্য, বাস্তব জ্ঞান – সবকিছুকে প্রভাবিত করে।

৬. শুধু সময় নয়, খেয়াল করুন স্ক্রিনে কী হচ্ছে
যে বিষয়টি অধিকাংশ অভিভাবক বুঝে উঠতে পারেন না, তা হলো স্ক্রিনের মাধ্যমে শিশুরা কী দেখছে। এই বিষয়টি স্ক্রিনে সময় ব্যয়ের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শিশুরা যখন সহিংসতা, অপসংস্কৃতি বা অবাস্তব রোমাঞ্চকর কনটেন্টের সঙ্গে পরিচিত হয়ে যায়, তখন তারা বাস্তব জীবনে এর প্রতিফলন ঘটাতে চেষ্টা করে। এতে শিশুদের চিন্তাধারা ও মূল্যবোধে বিকৃতি ঘটে, তারা সমস্যার সমাধানেও সহিংসতা বা অগ্রহণযোগ্য আচরণকে স্বাভাবিক ভাবতে শেখে।

কীভাবে সামলাবেন প্রযুক্তির সঙ্গে শিশুর সম্পর্ক?
এতোসব ঝুঁকি থাকলেও স্ক্রিনকে একেবারে বন্ধ করে দেওয়া বাস্তবসম্মত সমাধান নয়। কেননা বড় হয়ে প্রযুক্তির বিভিন্ন ব্যবহারের মধ্য দিয়েই বাস্তবজীবনে টিকে থাকতে হবে। তাই এগুলো শিখতে শিখতে বেড়ে উঠতে হবে। তাই দরকার বয়সভিত্তিক গাইডলাইন অনুসরণ করে এ বিষয়ে সচেতনতা ও ভারসাম্য তৈরি করা।

সাইকোলজিস্ট নুজহাত ই রহমান বলেন, ‘শিশুদের স্ক্রিন টাইম কমাতে পরিবারের সচেতনতা জরুরি। বাবা-মায়ের সঙ্গে গুণগত সময় কাটানো, শিশু-কেন্দ্রিক খেলা ও বাস্তব সামাজিক পরিবেশে অংশগ্রহণ তাদের বিকাশে সহায়তা করে। সেই সঙ্গে স্ক্রিনে দেখানো কনটেন্ট যেন শিক্ষামূলক, নৈতিক ও বয়স উপযোগী হয়, যা বিনোদন ছাড়াও শেখার সুযোগ দেয়।’

অভিভাবকদের উচিৎ শিশুদের স্ক্রিন টাইম মনিটর করা, কী দেখছে তা জানা এবং সম্ভব হলে একসঙ্গে বসে দেখা। এতে কনটেন্টের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয় এবং শিশুর মনে যে বিভ্রান্তি বা প্রশ্ন তৈরি হয়, তার সমাধানও দ্রুত সম্ভব হয়। এছাড়াও, ঘরে টিভি বা মোবাইল ফোনের ব্যবহার যেন নির্দিষ্ট সময় ও জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে; এই নীতি পরিবারে প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। খাওয়ার সময়, পড়ার সময় কিংবা ঘুমানোর আগে স্ক্রিন পুরোপুরি বন্ধ রাখা উচিৎ। অভিভাবক যখন নির্টিষ্ট সময় পর টিভি বন্ধ করে উঠে যাবেন, তখন শিশুও সেটি অনুকরণ করতে শিখবে।

স্ক্রিন ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ এনে শিশুকে বাস্তব জগতের সঙ্গে যুক্ত রাখা এখন সময়ের দাবি। মাঠে খেলা, বই পড়া, গল্প শোনা, ছবি আঁকা এসবই শিশুর সৃজনশীলতা ও আবেগ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রযুক্তিকে বাদ না দিয়ে, বরং সঠিকভাবে ব্যবহার করে আমরা আমাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ আরও সুন্দর, স্বাস্থ্যকর এবং ভারসাম্যপূর্ণ করে তুলতে পারি।

শিশুদের স্ক্রিন টাইম কমানো সহজ নয়, কিন্তু অসম্ভবও নয়। কেননা শিশুদের স্ক্রিন নয়, শারীরিক ও মানসিক বিকাশে মানুষের প্রয়োজন। প্রতিদিন একটু একটু করে পরিবর্তন আনলেই সম্ভব শিশুর সুস্থ মানসিক ও শারীরিক বিকাশ নিশ্চিত করা। প্রযুক্তির যুগে বেড়ে ওঠা শিশুরা যদি ভারসাম্য শিখে নেয়, তবে তারাই একদিন হবে ভবিষ্যতের সবচেয়ে প্রগতিশীল ও মানবিক নাগরিক।

তবে মনে রাখবেন, শিশু কথা শুনো যতটা শেখে, তার চেয়ে অনেক বেশি শেখে আপনাকে দেখে। আপনি যদি নিজের স্ক্রিন টাইম সীমিত করেন ও শিশুর সামনে তা তুলে ধরেন, তাহলে আপনার শিশু সেটিকেই স্বাভাবিক মনে করবে।

তথ্যসূত্র: মায়ো ক্লিনিক হেল্থ সিস্টেম, কন্টিনেন্টাল হসপিটালস, আমেরিকান একাডেমি অব চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ