ধর্ষণ, নিপীড়নসহ গির্জার যাজকদের হাতে নানাভাবে হাজারো শিশু যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছে। ছেলে-মেয়ে কোনো শিশুই বাদ যায়নি এ নিপীড়ন থেকে। জুস পান করিয়ে অচেতন করে এক ছেলেশিশুকে যৌন নিপীড়ন করা হয়েছিল। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একটি মেয়েশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। আট বছর ধরে এক শিশু নিগ্রহের শিকার হয়ে যাচ্ছিল। এক পরিবারের পাঁচ বোনকে যৌন নিপীড়নের ঘটনাও ঘটেছে।
যাজকের হাতে শিশু নিপীড়নের এ ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের গ্র্যান্ড জুরির প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে জানানো হয়, পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের তিন শতাধিক যাজক সাত দশক ধরে এক হাজারের বেশি শিশুকে নির্যাতন করেছেন। দিনের পর দিন এসব ঘটনা ধামাচাপা দিয়েছে ক্যাথলিক চার্চ। গতকাল মঙ্গলবার গ্র্যান্ড জুরির এক প্রতিবেদনে এ ভয়াবহতার চিত্র উঠে এসেছে। ক্যাথলিক চার্চের ঘটনাগুলো গোপন করার প্রবণতা নিয়ে নিন্দা জানিয়েছেন গ্র্যান্ড জুরি।
এএফপির প্রতিবেদনে জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্রে গির্জায় যৌন হয়রানির ঘটনা নিয়ে করা প্রতিবেদনগুলোর মধ্যে এটাকেই সবচেয়ে ব্যাপক পরিসরের বলে ধরা হচ্ছে। এর আগে ২০০২ সালে ম্যাসাচুসেটসের যাজকদের শিশু নির্যাতনের প্রথম তথ্য প্রকাশ করে দ্য বোস্টন গ্লোব।
ক্যাথলিক গির্জায় যৌন হয়রানির ঘটনাগুলো তুলে আনার জন্য দ্য বোস্টন গ্লোব ২০০৩ সালে পুলিৎজার পুরস্কার পায়। ওই কাহিনি নিয়ে পরে হলিউডে ‘স্পটলাইট’ নামের চলচ্চিত্র তৈরি হয়। চলচ্চিত্রটি অস্কার জেতে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, নতুন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দুজন যাজকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে একজন দোষ স্বীকার করেছেন। যেসব যাজকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের বেশির ভাগই মারা গেছেন। কিছু নির্যাতনের ঘটনা এত পুরোনো যে তা বিচার করা যাচ্ছে না।
গির্জাগুলোর পাঁচ লাখ পৃষ্ঠার সংরক্ষিত তথ্য ঘেঁটে গ্র্যান্ড জুরি দুই বছর ধরে এই ঘটনা তদন্ত করেন। এসব তথ্য ঘেঁটে পাওয়া যায়, তিন শতাধিক যাজকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছিল। এতে ভুক্তভোগী এক হাজারের বেশি শিশুকে চিহ্নিত করা যায়। তবে প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়েও বেশি হবে বলে অনুমান করছে গ্র্যান্ড জুরি। ধারণা করা হচ্ছে, অনেক শিশুর রেকর্ড হারিয়ে গেছে বা অনেকে ভয়েই অভিযোগ করেনি।
গ্র্যান্ড জুরি বলেছেন, ভুক্তভোগী শিশুদের অনেকে সারা জীবন শারীরিক ও মানসিক আঘাতের জের রয়ে গেছে। কেউ কেউ মাদক ও অ্যালকোহলে আসক্ত হয়েছে। কেউবা আত্মহত্যা করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাত বছরের একটি মেয়েকে হাসপাতালে এক যাজক ধর্ষণ করেছিলেন। শিশুটি টনসিল অস্ত্রোপচারের জন্য হাসপাতালে ভর্তি ছিল। আরেকটি ছেলেশিশু জুস পান করার পর অচেতন হয়ে পড়ে। পরদিন সকালে জ্ঞান ফিরে দেখতে পায়, তার মলদ্বার দিয়ে রক্তপাত হচ্ছে। তার সঙ্গে কে কী করেছিল, সেসব কিছুই সে মনে করতে পারেনি।
একজন যাজক নয় বছরের একটি ছেলেকে ‘ওরাল সেক্সে’ বাধ্য করেছিলেন। পরে আবার ছেলেটির মুখ ‘পবিত্র পানি’ দিয়ে ধুয়ে তাকে ‘পাপমুক্ত’ করা হয়। আরেকজন যাজক ১৮ মাস থেকে ১২ বছর বয়সী পাঁচ বোনকে যৌন হয়রানি করেছিলেন। ১৯৯২ সালে পরিবারটির ভুক্তভোগী এক শিশু তার বাবা-মাকে ঘটনাটি জানালে তা পুলিশ পর্যন্ত গড়ায়। পুলিশ যাজকের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে যৌন উদ্দীপক জিনিসপত্র খুঁজে পায়।
পেনসিলভানিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল জোস শাপিরো বলেন, ওই যাজকের বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ পাওয়া গেলেও গির্জা কর্তৃপক্ষ বছরের পর বছর ধরে তা উপেক্ষা করে গেছে। বিচারের অপেক্ষায় থাকা অবস্থাতেই ওই যাজকের মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, এই ঘটনাগুলোর প্যাটার্ন এমন, যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে, তা অস্বীকার করা হয়েছে এবং ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। প্রায় প্রতিটি নির্যাতনের ক্ষেত্রে দিনের পর দিন ঘটনাগুলো ধামাচাপা দেওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে। শিশু নির্যাতনের ঘটনাগুলো এতই পুরোনো যে তা বিচার করাই মুশকিল। তিনি জানান, এর মধ্যে মাত্র দুজন যাজককে অভিযুক্ত করা গেছে। সাত বছরের একটি ছেলেশিশুকে নির্যাতনের অভিযোগের ব্যাপারে একজন যাজক এ মাসের শুরুতে তাঁর দোষ স্বীকার করেছেন।
আরেক যাজকের বিরুদ্ধে দুটি ছেলেশিশুকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে একটি ছেলেকে আট বছর বয়স থেকে আট বছর ধরে যৌন হয়রানি করে যাচ্ছিলেন ওই যাজক।
শিশুদের ওপর যৌন হয়রানি বন্ধে আইনে সংশোধন আনার ওপর জোর দিয়েছেন গ্র্যান্ড জুরি। সিভিল আইনে মামলা করার জন্য ভুক্তভোগীদের আরও সময় দেওয়ার ওপরও জোর দিয়েছেন গ্র্যান্ড জুরি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক কিছু সংস্কার থাকা সত্ত্বেও গির্জার নেতাদের অনেকে জনসাধারণের প্রতি দায়বদ্ধতা এড়িয়ে চলেন।
পেনসিলভানিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল জোস শাপিরো এ ব্যাপারে বলেন, ‘যাজকেরা ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে ধর্ষণ করছেন অথচ ঈশ্বরের মানুষেরা ঘটনাগুলোর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা তো নেননি, বরং সেগুলো গোপনও করেছেন।’
ওয়াচডগ প্রতিষ্ঠান বিশপ অ্যাকাউন্টিবিলিটি অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রে ৫ হাজার ৭০০ থেকে ১০ হাজার ক্যাথলিক যাজকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র কয়েক শ যাজকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ২০০০ সালের পর থেকে ঘটনাগুলো জনসমক্ষে আসা শুরু করলে চার্চগুলো ক্ষতিপূরণের জন্য ৩০০ কোটি ডলারেরও বেশি ব্যয় করে। ক্ষতিপূরণের জন্য পাঁচ হাজার ৬৭৯ জন ভুক্তভোগীকে তালিকাভুক্ত করা হয়। তবে ধারণা করা হয়, ভুক্তভোগীর সংখ্যা এক লাখ।