রাজমিস্ত্রির জোগাল খালিদ পেয়েছেন ম্যানচেস্টার সিটির টিকিট
এস এম সামছুর রহমান, বাগেরহাটঃ
ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাবে অনুশীলনে যাবেন বাংলাদেশের ৬ ফুটবলার। তাদের মধ্যে একজন বাগেরহাটের মোল্লা খালিদ হোসেন (১৬)। তিনি পেশায় একজন রাজমিস্ত্রির জোগাল (সহযোগী)। অভাব-অনাটনসহ নানা প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে তাকে এই পর্যন্ত আসতে হয়েছে। মোল্লা খালিদ হোসেন বাগেরহাট সদর উপজেলার কু-বিষ্ণুপুর গ্রামের শারিরিক প্রতিবন্ধি ফরহাদ আহম্মেদের একমাত্র সন্তান। পরিবারসহ এলাকাবাসির স্বপ্ন খালিদ একজন বড় ফুটবলার হবেন।
সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে, দ্বিতীয়বারের মতো ইউনিলিভারের পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত হয় ক্লিয়ার মেন অনূর্ধ্ব-১৭ স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট। এই টুর্নামেন্টে বাগেরহাট সদর উপজেলার চিরুলিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের পক্ষে গোলরক্ষক হিসেবে খেলায় অংশ নেন দশম শ্রেণির ছাত্র খালিদ।
খুলনা বিভাগীয় ফাইনালে কালিয়া সরকারি পাইলট স্কুলকে ৩-০ গোলে হারিয়ে ঢাকার চূড়ান্ত পর্বে জায়গা করে নেন এইদল। মূল পর্বে এসে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিলেও এই গোলরক্ষক কোচদের নজরে আসতে সমর্থ হন। পুরো টুর্নামেন্ট থেকে বাছাই করা ৩৬ জন খেলোয়াড়ের ডাক পড়ে। সেখান থেকে সেরা ৬ জন বেছে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) আয়োজন করা হয় ২১ দিনের ক্যাম্প। সব বাছাই শেষে সেরা ছয়জনে খালিদ। তিনি এই মার্চ মাসেই উড়াল দেবেন ম্যানচেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাবে অনুশীলনের উদ্দেশে।
শনিবার সকালে চিরুলিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে গিয়ে দেখা হয় ফুটবলার খালিদের সাথে। স্থানীয় সহপার্টিদের দিয়ে অনুশীলনে ব্যস্ত তিনি। অবশ্য এলাকাবাসী তাকে রাজমিস্ত্রির যোগাল (সহযোগী) হিসেবেই চেনে। এই মাঠ থেকে মাত্র ৫শ মিটার দুরে খালিদের বাড়ি।
খালিদের মা হিরা বেগম বলেন, ‘খালিদের যখন দুই বছর বয়ষ তখন হঠাৎ অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়ে তার পিতা ফরহাদ আহম্মেদ শরিরিক প্রতিবন্ধি হয়ে যান। নিরুপায় হয়ে সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে। পরের বাসায় কাজ করে সংসার চালাতেন তিনি। অন্যের বাসায় কাজ করে বাড়ি ফিরে দেখতেন শিশু খালিদ লেবু দিয়ে বল বানিয়ে খেলছে। বিছানায় শুয়ে থেকে পিতা তাকে সহায়তা করছে। ছেলে বলতো এক সময় বড় খেলোয়ার হবে। ’
তিনি বলেন, ‘গত ৪ বছর আগে তিনিও মেরুদন্ডের হাড়ে সমস্যার কারনে অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। বন্ধ হয়ে যায় অন্যের বাড়ি কাজ করা। স্কুল ছাত্র খালিদের উপর পড়ে সংসারের ভার। তাই পড়াশোনা ও ফুটবল খেললেও সংসার চালানোর জন্য রাজমিস্ত্রি পেশাকেই বেছে নিতে হয়েছে। সেই থেকে সে রাজমিস্ত্রির জোগাল হিসেবে কাজ শুরু করে। স্থানীয় চিরুলিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণিতে পড়াশোনা করতো খালিদ। সংসার চালাতে গিয়ে গত তিন মাস সেই লেখাপড়াও বন্ধ রয়েছে।’
সিরাজুল ইসলাম নামের প্রতিবেশি এক কাকার সাথে রাজমিস্ত্রির জোগাল হিসেবে খালিদ কাজ শুরু করেন ৪ বছর আগে। এখনও তিনি সম্পূর্ন রাজমিস্ত্রি হতে পারেন নি। বিভিন্ন স্থানে খেলায় অংশ নেয়ার সময় অনেক সহায়তা করেছেন এই প্রধান রাজমিস্ত্রি।
প্রধান রাজমিস্ত্রি সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ছোট বেলা থেকেই ফুটবল খেলা পছন্দ করি। খালিদের ফুটবলের প্রতি আগ্রহ দেখে আমি তাকে সর্বোচ্চ সহায়তা করেছি।,
খালিদের বাবা ফরহাদ আহম্মেদ বলেন, ‘আমিও ছোটবেলায় ফুটবল খেলতাম। ফুটবলকে ভালবাসি। তাই ছেলেকে সব সময় ফুটবল খেলায় উৎসাহ দিই।
ফুটবলার খালিদ বলেন, পিতা শারিরিক প্রতিবন্ধি হওয়ায় তাকেই পরিবার সামলাতে হয়। এজন্য লেখাপড়াও বন্ধ করতে হয়েছে। চার বছর ধরে জোগাল হিসেবে কাজ করলেও ছোটবেলা থেকেই ছিল ফুটবলের প্রতি নেশা। লেবু দিয়ে বল বানিয়ে এক সময় তিনি খেলেছেন। তাই কোনো রকম পড়াশোনাও পাশাপশি ফুটবলের অনুশীলনও চালিয়েছেন। ম্যানচেস্টার সিটির অনুশীলনের মাধ্যমে তিনি বড় ফুটবলার হয়ে এলাকাবাসি ও পিতার স্বপ্ন পুরণ করতে চান।
চিরুলিয়া স্কুল এন্ড কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি মো: ফিরোজুল ইসলাম বলেন, রাজমিস্ত্রির জোগাল হিসেবে কাজ করা সেই ছেলেটা বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। এখন সে ম্যানচেস্টার সিটির ফুটবল ক্লাবে অনুশীলনের মাধ্যমে ভাল একজন খেলোয়ার হয়ে উঠবে। ঐতিহ্যবাহি চিরুলিয়া স্কুল এন্ড কলেজের ছাত্র খালিদের এই কৃতিত্বে এলাকাবাসির সাথে কলেজ কর্তৃপক্ষও গর্বিত ।