র্বাচন করতেও পারি, বয়কটও করতে পারি
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে কী কথা হলো?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আমাদের অফিসে এসে চায়ের পেয়ালা হাতে তিনি বললেন, দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর সৌজন্য সাক্ষাতে আসতে পারেননি, সে জন্যই এসেছেন। খোশগল্পই হয়েছে বলতে পারেন। আমরা বিএনপি-জামায়াত আমলের দুঃশাসনের নবসংস্করণের বিরোধিতা করি। এদের বাইরে বাম বিকল্প গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। এসব কথা জানা সত্ত্বেও আটটি দল নিয়ে গঠিত বাম গণতান্ত্রিক জোটকে তাঁদের ১৪ দলে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়ার মতো বোকা তিনি নন।
প্রথম আলো: কেন, আপনারা তো স্বাভাবিক মিত্র ছিলেন।
মুজাহিদুল: ছিলাম। সেই আওয়ামী লীগ আজ নেই। মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের জন্মকালে দলটির যে চরিত্র ছিল, সেটা সোহরাওয়ার্দীর হাতে দক্ষিণপন্থার দিকে চলে যায়। এরপর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একসময় মধ্য-বাম নীতি গ্রহণ করলেও এখন আবার মধ্য-ডানে চলে গেছে।
প্রথম আলো: কার্যত আওয়ামী মুসলিম লীগ যুগে ফিরছে কি?
মুজাহিদুল: মতাদর্শগতভাবে সেটার কাছাকাছি। সেটাকে তারা কৌশল বলতে চায়। কিন্তু কোনো কৌশল মৌলিক নীতির পরিপন্থী হয়ে পড়লে সেটিই তার নীতি-আদর্শে রূপান্তরিত হয়ে যায়। আগে আওয়ামী লীগ ছিল চরিত্রগতভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির, সেটা বদলে হয়েছে লুটেরা ধনিকশ্রেণিনির্ভর।
প্রথম আলো: তবে আপনি যাকে কিশোর বিদ্রোহ বলছেন, সেটা কি একটা নতুন আশাবাদ তৈরি করেনি?
মুজাহিদুল: অবশ্যই। জোর দিয়েই তা বলব, এতে আমরা একটা বিস্ফোরণ দেখলাম। ছাত্র-জনতার মধ্যে ক্ষোভ ছিলই। তাদের কথা যা চলছে, সেটা আর চলতে পারে না। পরিবর্তন দরকার। শুধু কথার কথা নয়, ছাত্রছাত্রীরা নিরাপদ সড়কের ইস্যুতে দেখিয়ে দিল যে পরিবর্তন সম্ভব। এটা দিগন্তের উন্মোচন। সংখ্যাগত বিচারে উনসত্তরের ছাত্র আন্দোলনের চেয়ে এটা যে আরও ব্যাপক, তা সন্দেহাতীত। এটা স্বতঃস্ফূর্ত, এটা দুর্বলতা নয়, শক্তি। একে এখন সচেতনতার দিকে নিতে হবে। তারা ‘রাষ্ট্র মেরামতের’ আওয়াজ তুলেছে। আমরা স্লোগান দিতাম কৃষক, শ্রমজীবী, ছাত্র-জনতা এক হও, এখন বাকি মেরামতকাজে তাদের টানতে হবে।
প্রথম আলো: নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আপনি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার চান। কিন্তু রূঢ় বাস্তবতা হলো বর্তমান সরকারের অধীনেই একটা নির্বাচন করা।
মুজাহিদুল: নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থাসহ অনেক কিছুই করার আছে। আপনি বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনের যে কথা বললেন, সেটা সংবিধানবিরোধী। কারণ, নির্বাচনকালে সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা কার্যত প্রয়োগ করবে ইসি। তাই প্রধানমন্ত্রী যিনিই হোন, তিনি যদি চলমান অবস্থার চরিত্রই বহাল রাখেন, তাহলে এ দেশে কোনো নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না। সংবিধানে একটা সংশোধনী এনে ১২৬ অনুচ্ছেদের মর্ম সুনির্দিষ্ট করতে হবে।
প্রথম আলো: ধরুন, সরকারি দল কোনো ধরনের সংশোধনী আনবে না। তারা একটি ছোট সরকার করবে, সেখানে হয়তো রওশনকে দেখা যাবে। বিএনপি বা আপনি নির্বাচন বয়কট করবেন?
মুজাহিদুল: এ ধরনের একটি সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে অবাধ নির্বাচন অসম্ভব। গত পাঁচটি সিটি নির্বাচনে তা আবারও নতুন করে প্রমাণিত হয়েছে।
প্রথম আলো: সিলেটে বিএনপি জিতল কি না?
মুজাহিদুল: কারও বিজয় বা ‘দয়ার দান’ অবাধ নির্বাচনের মাপকাঠি নয়। ছাত্রলীগ-ছাত্রদল মারামারি করে অবশেষে ৬০: ৪০ ফর্মুলায় ভাগ-বাঁটোয়ারা করল, এটা কি অবাধ হলো? তবে নির্বাচন অবাধ হবে কি না, সেটা এক জিনিস, আর তাতে অংশ নেব কি না, সেটা ভিন্ন।
প্রথম আলো: ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি বয়কট করল বলেই কি আপনি বয়কট করলেন? দুই বয়কটের ফারাক কী? এবার সেই অবস্থান পাল্টেছেন?
মুজাহিদুল: আজ আপনার সঙ্গে এক পরিস্থিতিতে কথা বলছি, সেটা কাল বা আগামী মাসে কী হবে, তা আপনি যেমন, তেমন আমিও বলতে পারি না। নির্বাচন করতেও পারি বা বয়কটও করতে পারি, সেটা আন্দোলনের কৌশল হিসেবে। এখন কাজ হলো অবাধ নির্বাচনের জন্য শক্তিশালী আন্দোলন করা।
আমরা এবং বিএনপি উভয়ে আওয়ামী শাসনের বিরোধী। তবে মৌলিক পার্থক্য হলো বিএনপি দক্ষিণপন্থী ও আমরা বামপন্থী অবস্থান থেকে বিরোধিতা করি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নীতি, আদর্শ ও সামাজিক মর্যাদাগত দিক থেকে সমমনা দল, বলা যায় যে বিএনপি ‘দুই নম্বরি’ বিরোধী দল। আমরা একটিকে আপদ, অন্যটিকে বিপদ বলি। বলি ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলায় পড়লে মানুষের মুক্তি হবে না।
প্রথম আলো: কেন, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী, ভারতের পরীক্ষিত মিত্র আর বিএনপি তার উল্টো। এই ফারাকটাও মুছে দেবেন?
মুজাহিদুল: অবশ্যই। কারণ, এ ধরনের স্লোগান দেওয়া বা না দেওয়া, উভয়ের জন্য এটা হলো সুবিধা অর্জনের হাতিয়ার। তা না হলে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হয় কী করে? বিএনপির মুখে ভারতবিরোধিতা, কিন্তু ভেতরে ভারতের সঙ্গে ডিল করতেই উতলা। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর আলাপকালে শেখ হাসিনা আমাকে বললেন, ‘আমি তো চারটি নয়, সাতটি দলের বিরুদ্ধে নির্বাচন করেছি। বাকি তিনটি হলো ভারত, আমেরিকা ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসন।’
প্রথম আলো: প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সর্বশেষ কবে, কী কথা হলো? বিএনপির সঙ্গে সংলাপ হয় না, আপনারা এক-আধটু সংলাপ করেন না?
মুজাহিদুল: তাঁর সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয় গণজাগরণ মঞ্চের পর। তিনি বলেছিলেন, এখন আর কেন ছাত্ররা থাকবে? বললাম, কখন তারা যাবে, সেটা তো আমরা বলতে পারি না। নির্দেশে ছাত্ররা আন্দোলনের শুরু করবে বা থামাবে না। তা নিয়ে তাঁর সঙ্গে বড় রকমের মতবিরোধই দেখা দিয়েছিল। আরেকবার, তিনি বিরোধী দলে থাকতে, সিপিবির একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, আপনারা আদর্শের আর আমি ক্ষমতার রাজনীতি করি। আমি তখন সবিনয়ে বলেছিলাম, আপনারা এমনটা করেন, এতে আমরা থাকব না। তখন তিনি বলেছিলেন, যখন থাকবেন না, তখন আবার যেন বেশি গালমন্দ করবেন না।
প্রথম আলো: অনেকে বলবেন, যখন ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো ঘটনা ঘটে, তখন ওই ধরনের কূটকৌশলনির্ভর ‘ক্ষমতার রাজনীতির’ প্রয়োজনীয়তা একটা বাস্তবতা। মানবেন?
মুজাহিদুল: অবশ্যই না। কারণ, কোনো সৎ উদ্দেশ্য কোনো অসৎ উপায় অবলম্বন করে অর্জন করা যায় না। আগুনে আগুন নেভে না। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী পড়েও আমরা বুঝতে পারি, নীতি-আদর্শ ধরেই টিকতে হবে। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, জনগণের অধিকার চাই। নীতির জন্য ক্ষমতা ছাড়ব। ক্ষমতার জন্য নীতিহীনতার আশ্রয় নেব, এটা মানা যায় না।
প্রথম আলো: পুলিশ ও ছাত্রলীগের একাংশ মিলে রাজপথের যে উদ্বেগজনক তৎপরতা, তা কীভাবে দেখছেন?
মুজাহিদুল: যখন জনসমর্থনের ভিত্তিতে ক্ষমতায় টেকা সম্ভব হয় না, তখন এটা অবশ্যম্ভাবী যে সেই সরকার পুলিশ বা গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকেই ব্যবহার করে ক্ষমতায় থাকতে চাইবে।
প্রথম আলো: সরকারে থাকা আপনার বাম বন্ধুরা কেমন করছেন? তাঁরা উন্নয়নের সারথি?
মুজাহিদুল: তাঁরা বামপন্থা পরিত্যাগ করে গেছেন। তাঁরা বলেছিলেন, সরকারকে একটু ‘মানুষ করতে’ তাঁরা যাচ্ছেন। গত এক দশকে তাঁরা আওয়ামী লীগকে আরও অমানুষ করেছে, সরকার আরও বেশি অগণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক ও বিদেশনির্ভর হয়েছে। উন্নয়ন হয়েছে, সেই সঙ্গে বৈষম্য বেড়েছে। সমাজব্যবস্থায় মৌলিক কিছু গলদ না থাকলে এমনটি হওয়ার কথা নয় যে সমাজে সম্পদ বাড়ে কিন্তু মানুষের দুর্দশা কমে না। এ রকম সমাজের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি।
প্রথম আলো: ১০ বছর আগের প্রায় সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৩৫ বিলিয়ন ডলার, রপ্তানিও ছয় গুণ বেড়েছে, বিদ্যুৎ তিন গুণের বেশি, এভাবে যুগান্তকারী সাফল্যগুলোকে আপনি খাটো করে দেখবেন?
মুজাহিদুল: বিরাট সাফল্য। কিন্তু তা কার স্বার্থে? এই সম্পদ বৃদ্ধি ধনীকে আরও ধনী করেছে। আপনি কার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সাফল্য বিবেচনা করছেন, সেটা দেখতে হবে। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের যা গৌরবের, তাই পাকিস্তানিদের জন্য ছিল লজ্জার। সুতরাং কোন অবস্থান থেকে দেখছেন, সেটা আগে বিচার্য। কেউ খাবে আর কেউ খাবে না, সেই প্রশ্নের মীমাংসা করেছিলাম একাত্তরে অস্ত্র হাতে। এখনকার বাংলাদেশে কিছু লোক অঢেল খাবে, আর অন্যরা চুইয়ে পড়া কিছু পাবে। তারা পুঁজিবাদের নিকৃষ্ট রূপ, নয়া উদারবাদী নীতিতে দেশকে নিয়ে গেছে।
প্রথম আলো: এর আশু বিপদ কী?
মুজাহিদুল: অব্যাহতভাবে নৈরাজ্য চলবে। অনেকেই বলেন, কী হবে বলুন তো? বলি, একটা বিষয় নিশ্চিত, সবকিছু অনিশ্চিত থাকবে। কেন অনিশ্চয়তা, তার কারণ চরম নৈরাজ্য। এর কারণ দুটো। লুটের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরের সংঘাত। খালেদা জিয়ার পেট্রলবোমা বা আন্দোলনে যত লোক মরেছে, তার চেয়ে বেশি মারা গেছে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ খুনোখুনিতে। ক্ষমতায় না থাকা বিএনপির মধ্যে পদায়ন ও লুটের মাল বণ্টন নিয়েও একই সহিংসতা চলমান। কে বেশি ইসলামপন্থী, তা নিয়ে দুই পক্ষে প্রতিযোগিতা চলছে। যারা ভিশন-২০২০ এবং ভিশন-২০৩০ নিয়ে ব্যস্ত, তাদের বলব, আগে ভিশন-১৯৭১ বাস্তবায়ন করুন। জামায়াতকে তারা নিয়ন্ত্রণে রাখবে কিন্তু নিষিদ্ধ করবে না। আওয়ামী লীগের দুঃশাসন, যেটা বিএনপিও করেছিল, তা থেকে চোখ সরাতে তারা মানুষকে দেখানোর জন্য এই জুজুকে টিকিয়ে রাখবে। এই সুযোগে এই অপশক্তি মহাবিপদ হয়ে উঠতে পারছে।
প্রথম আলো: এতক্ষণ যা বলেছেন, হয়তো তার সবটাই উচিত কথা, কিন্তু লোকে বলে, এসব বাগাড়ম্বর করেই আপনারা ৪৭ বছর পার করলেন। আজ পর্যন্ত সংসদে একটি গ্রুপ পর্যন্ত করতে পারলেন না। আপনারা জনবিচ্ছিন্ন, এই সমালোচনা কীভাবে খণ্ডাবেন?
মুজাহিদুল: বামেরা জনবিচ্ছিন্ন এটা সম্পূর্ণ অসত্য। জাতীয় সম্পদ রক্ষা, সুন্দরবন, যৌন নির্যাতন, গার্মেন্টস, গণজাগরণ মঞ্চ—এ রকম আরও অনেক ইস্যুতে সব আন্দোলনে সামনে রয়েছে বামপন্থীরা এবং সবাই বিশ্বাস করে যে আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই শক্তি আমাদের আছে। আমরা এটা পারি। তবে এসবকে ভোটের সংখ্যায় রূপান্তর করতে পারিনি। কারণ, আমাদের দল বহুদিন গোপন ছিল। পাকিস্তানের পুরোটাই। স্বাধীনতার পর দু-দুবার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এরশাদের পতনের পর শাসকশ্রেণির কৌশল হলো সরকার ও বিরোধী দল—দুটোকেই তারা নিয়ন্ত্রণে রাখবে। তাই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই মেরুকরণ এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে এর বাইরে আর কোনো শক্তি না আসতে পারে। সে জন্য আজ মানুষ জানতে চায়, আপনি আওয়ামী লীগপন্থী, নাকি বিএনপিপন্থী? এভাবে একটি খাঁচায় সামাজিক মনস্তত্ত্বকে আটকে ফেলা হয়েছে। এটা ভাঙতে একটু সময় লাগবে। আপনি যে প্রশ্ন করেছেন, সেটা ক্ষুদিরামকেও শুনতে হয়েছে। খামোখা জীবন দাও। ১০০ বছর গেল, ২০০ বছর গেল। এ কথা অনেকে বলেন, তোমাদের রেসপেক্ট করি, তোমাদের কাছে আশা করি না। যারা বলে অমুক দেশ পারে, তোমরা পারো না কেন? সবিনয়ে তাদের বলি, এ রকম ঢালাওভাবে দেখা ও চিন্তা করা ভুল। বলুন তো, পশ্চিমবঙ্গে বাম শাসন দীর্ঘায়িতও করা গেল, কিন্তু মহারাষ্ট্রে বা গুজরাটে একদমই পারল না কেন?
প্রথম আলো: বিদেশনীতি কেমন? ৪০ লাখ ‘বাংলাদেশি’ চিহ্নিত হওয়ার পরও তথ্যমন্ত্রী বলছেন, তাঁরা আলোচনার সূত্রপাত করবেন না।
মুজাহিদুল: এখানেও সুবিধাবাদ, জাতীয় স্বার্থ নয়, ক্ষমতায় থাকা অগ্রাধিকার। যা অবস্থা, তাতে সরকারের হাত-পা অনেকটাই বাঁধা। মেরুদণ্ড খাড়া নেই। কারণ, প্রধানমন্ত্রী জানেন, জনগণের ইচ্ছায় ক্ষমতায় থাকা নির্ভর করে না। তিনি বলেছিলেন, ক্লিনটন সাহেব পাইপলাইনে গ্যাস দিতে বলেছিলেন। আমি না বলেছিলাম। খালেদা জিয়া হ্যাঁ বলেছিলেন। সমতে ক্লিনটন ঠিক করেছিলেন যে খালেদা জিয়া জিতবেন।
প্রথম আলো: আপনি এ বিশ্লেষণ মানেন?
মুজাহিদুল: বহুলাংশে। বর্তমান সরকার আত্মসমর্পণ করে বসে আছে। সে জন্যই ক্ষমতায় আছে। বিশ্বব্যাংক বলল, সাহায্য নাও। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, গরু মরেছে, গরু দাও। তিরস্কারটা তারা বুঝেছিল। বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন উভয়ে বলেছিলেন, দরকার হলে ১০০ বছর ঘাস খেয়ে থাকব। কিন্তু শর্তযুক্ত ঋণ নেব না। এখন ঠিক বিপরীত পথে বাংলাদেশ। যারা ক্ষমতায় রাখবে, তার সঙ্গেই মিতালি করব। ক্ষমতায় যেতে ভারতবিরোধী, আর থাকতে ভারতপন্থী হতে হবে। অনেকে এসব বিষয়ে কথা দিয়েও কথা রাখেনি, তাই ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটেছে। তাই এখন কথা দিয়ে কথা রাখার পরীক্ষায় উতরানোর কাল চলছে। তবে দুই নৌকায় পা দেওয়ার চেষ্টাও তারা করে থাকে। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের গাড়িতে হামলা হলো। এটা মার্কিনবিরোধিতা নয়। তারা বলেছে, এটা ষড়যন্ত্র। ওই সভা যদি ক্ষমতাসীনদের কারও সঙ্গে হতো, তাহলে তারা পাথর নয়, ফুলের ডালা হাতে হাজির হতো। অবৈধ পথে তারা যে বিপুল বিত্তবৈভব গড়েছে, তা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। তারা কল্পনা করছে যে তারা আমেরিকা, চীন, ভারত ও রাশিয়া—এই চারটিকেই খেলাতে পারছে। আসলে তারা বোকা। এই বৃহৎ শক্তির সব কটিকে সন্তুষ্ট করতে তারা পারবে না।
প্রথম আলো: ডা. বি চৌধুরীর বিএনপিকে ১০০ আসনের কম নিতে বলার ফর্মুলা এবং জাতীয় ঐক্য নিয়ে কী ভাবনা?
মুজাহিদুল: মনে হয়, সুবিধালাভে দর-কষাকষির ফর্মুলা নিয়ে কায়কারবার চলছে। আমিও জাতীয় ঐক্য চাই। কিন্তু আরও যাঁরা বলেন, তাঁদের এ বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধই ছিল জাতীয় ঐক্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। চার নীতিতে তার মর্মবাণীর প্রকাশ ঘটে। যাঁরা চার নীতির ধারায় দেশকে ফেরাতে চান না, তাঁদের মুখে জাতীয় ঐক্যের কথা মানায় না।
প্রথম আলো: আওয়ামী লীগ বনাম বাদবাকি, আপনার জাতীয় ঐক্য কি এমনই?
মুজাহিদুল: না। আমি এর পক্ষপাতী নই। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কোনোটিই থাকার সুযোগ নেই। তারা চার নীতি থেকে দূরে চলে গেছে। আর বাকিরা যদি এই দুটি দলের নব্য সংস্করণ হয়, তাহলেও চলবে না। বিকল্প নীতি দিতে হবে।
প্রথম আলো: অনেকে বলবেন, এই অবস্থান চূড়ান্ত বিচারে আওয়ামী লীগকেই স্বস্তি দিতে পারে।
মুজাহিদুল: না। আমরা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সামনের কাতারে আছি। কারণ, তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক সিক্সটি-ফরটির নয়।
প্রথম আলো: বিচার বিভাগ, মিডিয়া, ইসি ও অন্যান্য সাংবিধানিক সংস্থার স্বাধীনতা?
মুজাহিদুল: এর সবটাই আজ পায়ের নিচে পিষ্ট, চরমভাবে আক্রান্ত এবং ধ্বংসের উপক্রম। আগের মতো সবটা চোখে পড়বে না। ডিজিটাল তো, তাই ঐন্দ্রজালিক প্রহসন চলছে। ভোট গণনার রিপোর্ট কোনটি যাবে, কোনটি যাবে না, সেখানেও এখন একই কৌশল। পি সি সরকারের জাদু। হাতসাফাই। সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এক নয়। সাংবাদিকদের স্বাধীনতার ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণটা কখনো বড় বড় করপোরেট হাউস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, আবার কোথাও তারা পারস্পরিক যোগসাজশ করে কাজ করছে।