শত চেষ্টাতেও ফিরছে না শৃঙ্খলা
গতকাল শনিবার রাজধানীর পাঁচটি ব্যস্ত বাসস্ট্যান্ড এলাকা ঘুরে চালক ও পথচারীদের নিয়ম অমান্য করার প্রতিযোগিতা আগের মতোই চোখে পড়ে। ট্রাফিক সপ্তাহের শেষ দিন ছিল কাল। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ট্রাফিক সপ্তাহ আরও তিন দিন বাড়িয়ে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত করা হয়েছে।
এই সাত দিনে শৃঙ্খলা দৃশ্যমান না হলেও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ট্রাফিক সপ্তাহে অনেক ইতিবাচক ফল এসেছে। ট্রাফিক আইন প্রয়োগ ও সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে অনেকটা অগ্রগতি হয়েছে। এটিকে টেকসই ও চলমান রাখতে এবং সড়কের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা আরও বেগবান করতে ট্রাফিক সপ্তাহ ১৪ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
ঢাকাসহ সারা দেশ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সাত দিনে সারা দেশে ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১ লাখ ২৯ হাজার ৮৭১টি। জরিমানা আদায় হয়েছে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা। ৪৬ হাজার ৭২৩ জন চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আটক করা হয়েছে ৩ হাজার ৭৭৭টি যানবাহন। মামলা ও জরিমানার পাশাপাশি চালক ও পথচারীদের উদ্দেশে প্রচার করা হচ্ছে সচেতনতামূলক বার্তা।
মামলাগুলোর অধিকাংশ হয়েছে রাজধানীতে। জরিমানার অর্ধেকের বেশি আদায় হয়েছে রাজধানী শহর থেকে। এত কিছুর পরও রাজধানীর সড়কে নৈরাজ্য থামছে না কেন? জানতে চাইলে নগর গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পরিবহন খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলছে চরম অব্যবস্থাপনা। এই অরাজক পরিস্থিতি থেকে সাত দিনে উত্তরণ সম্ভব না। আইন, নিয়ম-নীতি সবই আছে। এগুলো প্রয়োগ করার তৎপরতা নেই। উচ্চপর্যায় থেকে আইন প্রয়োগের অঙ্গীকারও নেই। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের দায়িত্বপ্রাপ্তদের আইন মানতে এবং মানাতে উদ্যোগ নিতে হবে।
নিয়ম না মানার প্রতিযোগিতা
মিরপুর আনসার ক্যাম্প এলাকায় দেখা যায়, তানজিল পরিবহন এবং নিউ ভিশন পরিবহনের দুটি বাস যাত্রী তোলার জন্য নিজেদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি করছে। তানজিল পরিবহন মিরপুর চিড়িয়াখানা থেকে ফার্মগেট হয়ে গুলিস্তান এবং নিউ ভিশন পরিবহন মিরপুর চিড়িয়াখানা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চলাচল করে।
মহাখালী এলাকায় দেখা যায়, ঢাকা-ময়মনসিংহ পথে চলাচলকারী এনা পরিবহনের একটি বাসের চালক এক হাতে মুঠোফোনে কথা বলছেন, আরেক হাতে স্টিয়ারিং সামলাচ্ছেন। ফোনে কথা বলতে বলতেই তিনি মহাখালী মোড় পার হয়ে গেলেন।
মহাখালী হয়ে বিভিন্ন পথে চলাচলকারী বাসগুলো মহাখালী ট্রাফিক পুলিশের সামনেই যাত্রী তুলছে। একাধিক বাস ও লেগুনা মহাখালী রেললাইনের ওপর থেমে যাত্রী তুলছে। অথচ বাস থামানোর এবং যাত্রী তোলার নির্ধারিত স্থান আরও কিছুটা সামনে।
বাড্ডা থেকে গুলিস্তান পথে চলাচলকারী ৬ নম্বর বাসের চালক মো. আরমান বলেন, ‘যাত্রী যেখানে থাকবে আমরা সেখানেই বাস থামাব। যাত্রীরা সামনে গিয়া না দাঁড়ালে আমাদের কী দোষ।’
বিজয় সরণি মোড়ে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ মোটরসাইকেলচালকের হেলমেট থাকলেও আরোহীদের হেলমেট নেই। এক মোটরসাইকেলে চালকের সঙ্গে নারী ও দুই শিশু আরোহী থাকলেও শুধু চালকের হেলমেট রয়েছে। অনেক মোটরসাইকেলচালক হেলমেটের ভেতর মোবাইল ফোন গুঁজে কথা বলতে বলতে চালাচ্ছেন।
মিরপুর বাঙলা কলেজের সামনে একাধিক সড়ক দুর্ঘটনার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পদচারী-সেতু বসানো হয়। সেই পদচারী-সেতু এখন অলস পড়ে থাকে।
ছুটির দিনেও বিআরটিএ খোলা
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর বিআরটিএর কার্যালয়ে লাইসেন্স ও ফিটনেস সনদ নিতে হিড়িক পড়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিআরটিএ বাড়িয়েছে দিনের কর্মঘণ্টা। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী গতকাল সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও বিআরটিএ কার্যালয়ে লাইসেন্স নবায়ন, গাড়ির ফিটনেস ও নবায়ন কার্যক্রম চলেছে। তবে কার্যালয়ের ভেতরে ও বাইরে দালালদের উৎপাত বন্ধ হয়নি। গতকাল বিআরটিএর তিনটি ভ্রাম্যমাণ আদালত ১৪ জন দালালকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন। মোটরযান অধ্যাদেশের আওতায় ৬৩টি মামলায় ৯৯ হাজার ১০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।
বিআরটিএ মিরপুর কার্যালয়ের ভেতরের অস্থায়ী কয়েদখানায় দেখা যায়, এক ব্যক্তিকে পিছমোড়া করে ধরে এনে ঢোকালেন দুই আনসার সদস্য। সেখানে আগে থেকেই ছিলেন পাঁচ ব্যক্তি। তাঁরা সবাই দালাল। গতকাল সেখানে ১০ দালালকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বিআরটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাজহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দালালদের কারণে সেবা নিতে আসা লোকজন অতিষ্ঠ। দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
জাবালে নূরের ছয়টি বাস জব্দ
চলাচলের অনুমতি বাতিলের পরও যাত্রী পরিবহনের অভিযোগে জাবালে নূর পরিবহনের ছয়টি বাস জব্দ করেছে র্যাব। র্যাবের মিডিয়া শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, গতকাল মিরপুর ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে বাসগুলো আটক করা হয়।
গত ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভারের পাশে বাসে ওঠার অপেক্ষায় থাকা শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একদল শিক্ষার্থীর ওপর জাবালে নূরের একটি বাস উঠে গেলে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়।