বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র দাইয়ান নাফিসের মা ১৯৭৯ সালে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাঁর মামা জেলার আটোয়ারী উপজেলার বলরামপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক। আওয়ামী ঘরানার পরিবারের সন্তান দাইয়ানকে ৮ আগস্ট গুজব ছড়ানোর অভিযোগে পুলিশে সোপর্দ করেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী।

দাইয়ানের মা নছিবা বেগম পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের ডেমনস্ট্রেটর। বাবা নজরুল ইসলাম দিনাজপুর সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান। দাইয়ানের পরিবারের সদস্য ও বন্ধুরা বলছেন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন দাইয়ান। ফেসবুকে নিজের প্রোফাইল পিকচার বদলে তিনি একটি পোস্টারের ছবিও দিয়েছিলেন।

নছিবা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ছোটবেলা থেকেই তাঁর ছেলে পড়ুয়া। স্কুলে রোল সব সময় এক-দুইয়ের মধ্যে ছিল। নটর ডেম কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার পর বুয়েটে ভর্তি হন। কখনোই কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল না।

দাইয়ান ছাড়াও ৬ আগস্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ২২ শিক্ষার্থীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল, তাঁদের কারোরই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই বলে জানিয়েছে তাঁদের পরিবার। দুই তদন্ত কর্মকর্তা বাড্ডা থানার এসআই জুলহাস মিয়া ও ভাটারা থানার এসআই হাসান মাসুদ প্রথম আলোর প্রশ্নের জবাবে বলেন, তদন্ত চলছে। এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

দাইয়ান গুজব ছড়ানোর অভিযোগে এবং অন্যরা পুলিশের ওপর হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগে এখন কারাগারে। দাইয়ানসহ গ্রেপ্তার ২৩ ছাত্রের মধ্যে ২০ জনের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে প্রথম আলো। এর মধ্যে ৩ জনের পরিবার বলেছে, তাঁরা আওয়ামী লীগের সমর্থক। অপর একজনের বাবা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন আর একজনের দাদা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। বাকি ১৪টি পরিবার ও তাদের এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে তাঁদের সম্পৃক্ততা নেই। একজনের বাবা একসময় বিএনপির রাজনীতি করতেন। বাকি তিন শিক্ষার্থী সীমান্ত সরকার, মাসাদ মর্তুজা বিন আহাদ ও রেজা রিফাত আখলাকের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। ২৩ শিক্ষার্থীর মধ্যে ছয়জনের ছবি প্রথম আলো পেয়েছে।

গ্রেপ্তার হওয়া শিক্ষার্থীদের স্বজনদের দাবি, তাঁদের সন্তানেরা সংঘর্ষে অংশ নেননি। ক্যাম্পাসে যাওয়ার সময়, কেউ দুপুরের খাবার খেয়ে বেরোনোর পর, কেউ পরীক্ষা দিয়ে বেরোনোর পর গ্রেপ্তার হন। পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পর মেসে ফেরার পথেও ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীরা কাউকে কাউকে রাস্তা থেকে ধরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছেন।

..খেতে বেরিয়েছিলেন সাবের আহমেদ

এশিয়ান ইউনিভার্সিটির ছাত্র সাবের আহমেদের বাড়ি টাঙ্গাইলের করটিয়া ইউনিয়নের মীরের বেতকা গ্রামে। তাঁর বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, সাবের ভদ্র ও শান্ত প্রকৃতির ছেলে। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা নেই। তাঁর বাবা আবু সাঈদ উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা ছিলেন। ২০০৪ সালে তিনি মারা যান। তাঁর মা মির্জা শাহীনা মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন কাজের বুয়া না আসায় সাবেরদের মেসে রান্না হয়নি। তাই বিকেলের দিকে খেতে বের হন। এ সময় পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

পরীক্ষা দিতে বেরিয়েছিলেন আমিমুল এহসান

আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সফটওয়্যার প্রকৌশল বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র আমিমুল এহসান ওরফে বায়োজিদ পরীক্ষা দিতে সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন বলে জানিয়েছে তাঁর পরিবার। বাবা আজাহার আলী অবসরপ্রাপ্ত মাদ্রাসাশিক্ষক। বাড়ি জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার তালোড়া বাইগুনি গ্রামে। সেখানে মা বিলকিস বেগম বলেন, আমিমুল পরীক্ষা দিয়ে বসুন্ধরা এলাকায় তাঁর কক্ষে ফিরছিলেন। রাত ১০টার দিকে তাঁরা গ্রেপ্তারের খবর পান। তাঁদের পরিবার ও সন্তানেরা কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন বলে জানান তিনি।

নূর মোহাম্মদের গ্রামের বাড়িতেও গিয়েছিল পুলিশ

সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৩৪ ব্যাচের ছাত্র নূর মোহাম্মদ সাবেক সেনা কর্মকর্তার ছেলে। তাঁদের বাড়ি নরসিংদীর মনোহরদীর চরতারাকান্দী গ্রামে। ৬ আগস্ট গ্রেপ্তারের দুই দিন পর পুলিশ তাঁর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে। এলাকাবাসী বলেন, পরিবারটির কেউই কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন। তাঁর বাবা মো. সিরাজুদ্দীন এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সিকিউরিটির কাজ করেন। তিনি মুঠোফোনে বলেন, ‘নিরাপদ সড়কের জন্য অনেক ছাত্রই তো পথে নেমেছিল। আমার ছেলেও নাকি সেখানে ছিল। আমি অনেক কষ্ট করে ছেলেকে পড়াশোনা করাচ্ছি। এমন অবস্থায় কী করব বুঝতে পারছি না।’

মুশফিককে পুলিশে ধরিয়ে দেয় ছাত্রলীগ-যুবলীগ

ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মুশফিক ৬ আগস্ট পুলিশের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার সময় নিজের বিভাগের কক্ষেই থাকার কথা বাবাকে জানিয়েছিলেন। ঘটনা শেষে মেসে ফেরার পথে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁকে পুলিশে ধরিয়ে দেন বলে অভিযোগ করেন বাবা মাহবুবুর রহমান। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা বলেন, মুশফিক কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। তাঁর বাবা বলেন, সংঘর্ষের সময় মুশফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দোতলায় বিভাগের কক্ষে দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে ছিলেন। পরে তিনি জানতে পেরেছেন, কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে মেসে ফেরার পথে বাড্ডা থানার কাছে গলায় ঝোলানো আইডি কার্ড, পিঠে ব্যাগ দেখে বাড্ডা এলাকার ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা ধাওয়া করেন। তাঁরা সাত-আটজন দৌড়ে পাশের এক বাসায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েও রক্ষা পাননি। হাতিবান্ধা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর খান বলেন, ‘তাঁকে কোনো রাজনীতি করতে দেখিনি। কোনো দিন কোনো মিছিল-মিটিংয়েও দেখিনি। এই ছেলে থানা কিংবা পুলিশের ওপর আক্রমণ করতে পারে, এটা আমার বিশ্বাস হয় না।’

রাজনীতি করতেন না সাখাওয়াত

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের দ্বিতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী সাখাওয়াত হোসেন কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন বলে জানিয়েছে তাঁর পরিবার। তাঁর মা শেফায়া বেগম রংপুরে একটি সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা। ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছিলেন রংপুর সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস। তিনি তাঁর ছেলের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।

রাশেদুলের পরিবার আ.লীগের সমর্থক

ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র রাশেদুল ইসলাম কোনো রাজনৈতিক দলের যুক্ত ছিলেন না বলে তাঁর পরিবারের সদস্য ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন। তাঁর বাড়ি রাজবাড়ী সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়নের ধুঞ্চি গ্রামের গোদার বাজার এলাকায়। তাঁর বাবা আব্বাস আলী কবিরাজ বলেন, ‘আমার ছেলে রাজনীতি করে না। কোনো মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নেয় না।’

ক্লাস করে কক্ষেই ছিলেন তারিকুল

সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর চার বছর ধরে বাবা মানসিক ভারসাম্যহীন। ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে মা গ্রামের বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন। এক বছর পরই ছেলে তারিকুল ইসলাম পরিবারের হাল ধরবেন এমনটাই ধরে রেখেছিলেন মা তাছলিমা ইসলাম। কিন্তু ছেলের জন্যই তিনি এখন বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন। ধরনা দিচ্ছেন পুলিশ, আদালত আর আইনজীবীর কাছে।

ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র তারিকুল ইসলামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার সদর উপজেলার দীঘলী ইউনিয়নের পূর্ব দীঘলী গ্রামে। দীঘলী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য (পূর্ব দীঘলী গ্রামের) মো. জাহের বলেন, তারিকুল খুবই ভালো ছেলে।

আওয়ামীপন্থী চেয়ারম্যানের ছেলে ইখতেদার

সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ষষ্ঠ সেমিস্টারের ছাত্র ইখতেদার হোসেনের বাবা ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার কামারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান। তিনি আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। এর আগে তিনি ময়মনসিংহ-২ (ফুলপুর ও তারাকান্দা) আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ হায়াতুর রহমানের একান্ত সচিব ছিলেন। বাবা এবাদত হোসেন প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলার সময় কেঁদে ফেলেন। বলেন, ‘মনটা খুব অস্থির। আমার ছেলে কোনো কিছুতেই ছিল না। প্রতি ঘণ্টায় আমি তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি। সে কোনো দিন মিছিলেও যায়নি। অযথাই পুলিশ তাঁকে নিয়ে গেছে।’

টিউটরিয়াল শেষে ফিরছিলেন রেদওয়ান

ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রেদওয়ান আহমেদ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন বলে দাবি করেছে পরিবার। শুধু তা-ই নয়, ঘটনার দিন দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টিউটরিয়াল পরীক্ষা শেষে বের হতেই বাড্ডা থানার পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে যায় বলে জানায় পরিবার।

রেদওয়ানের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার বাটাইয়া ইউনিয়নের শ্রীনদ্দি গ্রামে। স্থানীয় লোকজন বলেন, পারিবারিকভাবে রেদওয়ানদের পরিবার আওয়ামী লীগের সমর্থক। তাঁর বাবা আবুল কালাম আজাদ চাঁদপুরের কচুয়া বঙ্গবন্ধু ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক। পরিবার নিয়ে সেখানেই থাকেন তিনি। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন দুপুর পর্যন্ত রেদওয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউটরিয়াল পরীক্ষায় অংশ নেন। পরীক্ষা শেষে ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে রাস্তায় এলে পুলিশ তাঁকে আটক করে।

লাইব্রেরিতে যাচ্ছিলেন বায়োজিদ

পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে যেতে বাসা থেকে রওনা দিয়েছিলেন ইস্ট ওয়েস্টের পরিসংখ্যান বিভাগের ষষ্ঠ সেমিস্টারের ছাত্র মো. বায়োজিদ। পথেই তাঁকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে বলে দাবি করেছে তাঁর পরিবার। বায়োজিদের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার বুধাইরকান্দি গ্রামে। তাঁর বাবা আবদুল বাতেনের বইয়ের দোকান রয়েছে। মা মরিয়াম বেগম বুধাইরকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। বাবা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছেলে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন।

রাজনীতি করেন না আজিজুল করিম

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএর ছাত্র আজিজুল করিম কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না বলে জানিয়েছে পরিবার। বাড়ি কুমিল্লা নগরের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ ঠাকুরপাড়া এলাকায়। তাঁর বাবা আবদুল করিম শিপিং কোম্পানিতে কাজ করতেন। এখন অবসরে আছেন। মা সুফিয়া আক্তার বলেন, ‘আমার ছেলে কোনো রাজনীতি করে না। একেবারেই নিরীহ গোছের। আমি ছেলের মুক্তি চাই।’

ক্যাম্পাস থেকে ধরে নিয়ে যায় জাহিদুলকে

সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির ফার্মাসি বিভাগের ষষ্ঠ সেমিস্টারের জাহিদুলের বাসা কুমিল্লার দক্ষিণ ঠাকুরপাড়া এলাকায়। পরিবার বলছে, ঘটনার দিন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় নাম দিতে তিনি ক্যাম্পাসে গিয়েছিলেন। তখন পুলিশ তাঁকে আন্দোলনকারী ভেবে গ্রেপ্তার করে। তাঁর বাবা জাকিরুল হকের কুমিল্লা শহরে ওষুধের দোকান রয়েছে। মা জাহানারা হক গৃহিণী। প্রিজন ভ্যানের গ্রিল ধরে জাহিদুলের কান্নার একটি ছবি ১০ আগস্ট প্রথম আলোয় ছাপা হয়। রিমান্ড শেষে ওই দিন গ্রেপ্তার হওয়া শিক্ষার্থীদের আদালতে এনেছিল পুলিশ। জাহিদুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর মা সেই পত্রিকাটি পাশে নিয়ে কাঁদছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে নিরপরাধ।’

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ একরাম হোসেন বলেন, ‘কুমিল্লার দুটি ছেলেই কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়। এলাকায় তাদের কোনো বদনাম নেই। যতটুকু শুনেছি, ঘটনার দিন তাদের ক্যাম্পাস থেকে ধরে নিয়ে যায়।’

মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান মেহেদী হাসান

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এ এম মেহেদী হাসান খানের বাড়ি যশোরের অভয়নগরের এক্তারপুর গ্রামে। এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, তাঁর দাদা এম এ ফাত্তাহ খান ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। পরিবারের সদস্যরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত নন। তবে তাঁরা আওয়ামী লীগের সমর্থক। মেহেদী হাসানের বাবা মাসুদ খান অবসরপ্রাপ্ত রাজস্ব কর্মকর্তা।

মেহেদীর মা লিলিনা খাতুন বলেন, ওই দিন হোটেল থেকে খেয়ে বের হয়েছিলেন তাঁর ছেলে। এরপর পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে দেখছিলেন। এ অবস্থায় পুলিশ আটক করে বলতে থাকে, মুঠোফোনে ছবি তুলছিলেন মেহেদী। এরপর তাঁকে থানায় নিয়ে যায়।

ক্লাস শেষে ফেরার পথে গ্রেপ্তার হন রিসালাতুল

ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির জেনেটিক অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র রিসালাতুল ফেরদৌস কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। রিসালাতুলের বাড়ি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর পৌর এলাকার আঙ্গারিয়া এলাকায়। তাঁর বাবা দেওয়ান জিল্লুর রহমান ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফেরার সময় আফতাবনগর এলাকায় পুলিশ তাঁর ছেলেকে আটক করে। উপজেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ এবং জেলা পরিষদের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আবদুল আলিম প্রথম আলোকে বলেন, ওই ছেলেকে তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে দেখেননি। কোনো দলের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততাও নেই।

মুঠোফোন কেড়ে নেওয়ায় পুলিশের সঙ্গে তর্ক, গ্রেপ্তার

ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির (আইইউবি) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী ফয়েজ আহমদ আদনানের পরিবার বলছে, তিনি ছাত্র আন্দোলনে ছিলেন না। তিনি কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত নন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরার পথে আদনান ও তাঁর দুই বন্ধুর কাছ থেকে পুলিশ মুঠোফোন কেড়ে নেয়। এ নিয়ে তর্কাতর্কি করায় পুলিশ তাঁদের আটক করে।

আদনানের বাড়ি সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার সদর ইউনিয়নের মল্লিকপুর গ্রামে। তাঁর বাবা সৌদিপ্রবাসী ব্যবসায়ী জামিল আহমদ। মল্লিকপুর গ্রামের বাসিন্দা ছাতক সদর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মুহিবুর রহমান বলেন, একসময় জামিল আহমদের বাবা আওয়ামী লীগ করতেন। এরপর পরিবারের কেউ আর রাজনীতিতে জড়িত হননি। ছেলে হিসেবে আদনান খুবই ভদ্র ও শান্ত বলেই তাঁরা জানেন।

ইফতেখারের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই

গ্রেপ্তার হওয়া শিক্ষার্থী ইফতেখার আহম্মদ প্রীতমের বাড়ি ফেনী সদর উপজেলার শর্শদি ইউনিয়নের গজারিয়া কান্দি ফকিরবাড়ি। তাঁর বাবা আবু তাহের সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। ইফতেখারের বাড়ির পাশের স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ পরিবারের কেউ প্রকাশ্য কোনো দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না, এখনো নেই।

রেজার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা পায়নি পুলিশও

এইচ এম খালিদ রেজার বাড়ি বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার সাতবাড়িয়া গ্রামে। তাঁর বাবা সিদ্দিকুর রহমান ওরফে খসরু এলাকায় ব্যবসা করেন। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত নন।

বানারীপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খলিলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, খালিদের পরিবারের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। তবে তিনি ঢাকায় কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কি না, সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

আরেক শিক্ষার্থী মো. হাসানুজ্জামান ওরফে ইমনের বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার চাঁদপাশা ইউনিয়নের বকশির চর এলাকায়। তাঁর বাবা মো. ওয়াহিদুজ্জামান ওরফে দুলাল আগে আদমজী জুট মিলে চাকরি করতেন। অবসর যাওয়ার পর তিনি পরিবার নিয়ে স্থায়ীভাবে গ্রামের বাড়িতে থাকেন।  তিনি একসময় চাঁদপাশা ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তবে ২০০৬ সালের পর তিনি রাজনীতিতে আর সক্রিয় নন।

ক্যাম্পাস থেকে বেরোনোর সময় গ্রেপ্তার জন শিহাব

শিহাব শাহরিয়ারের বাড়ি গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার উড়িয়া ইউনিয়নের গুনভড়ি গ্রামে। তাঁর বাড়িতে গেলে বড় ভাই সজল মিয়া বললেন, ঘটনার দিন গন্ডগোল দেখে শিহাব বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই ছিলেন। পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পর বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে বের হওয়ার সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে কিশোর ও তরুণদের আন্দোলনটা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, স্বচ্ছ ও দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন। তারা যে শৃঙ্খলাবোধ দেখিয়েছে, তা ট্রাফিকের লোকেরাও দেখাতে পারেনি এত দিন। অথচ নির্দলীয় এই আন্দোলনের ওপরই কিছু সশস্ত্র লোক হামলা চালাল। এরাই তো অপরাধী। শাস্তি তো এদের হওয়া উচিত। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা হলো না। এটা অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক ও দুঃখজনক।

প্রবীণ এই শিক্ষাবিদ মনে করেন, গ্রেপ্তার হওয়া শিক্ষার্থীদের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া উচিত। একইসঙ্গে তারা যে কাজটি করে দেখিয়েছে, তার জন্য তাদের প্রশংসা করা উচিত।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here