ফারুক নোমানীঃ

অনাগত সন্তানকে ঘিরে উৎসবের আমেজ ও নানা উৎসাহব্যঞ্জক ভাবনা পরিলক্ষিত হয় পৃথিবীর প্রতিটি জনপদে, প্রতিটি গোত্র গোষ্ঠীতে। এটাই স্বাভাবিক রীতির বিষয়। মানবতার ইতিহাসে এ রীতি চলে আসছে বংশ পরম্পরায়। যুগ যুগ ধরে। তবে বড় হৃদয়বিদারক কথা হলো, দিনদিন সমাজে বেড়েই চলেছে এই শিশুহত্যা। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা নবজাতক শিশুর রক্তাত্ব মৃতদেহ ছিড়ে খায় ক্ষুধার্ত কুকুরে। সৃষ্টির সেরা জীব আদম সন্তান নিক্ষিপ্ত হয় ময়লার ডাস্টবিনে। নর্দমা, ড্রেনের নোংরা পানিতে ভেসে থাকে আল্লাহর শ্রেষ্ট সৃষ্টি। আরো নিদর্য়ভাবে চলছে মায়ের গর্ভে থাকা নিষ্পাপ ভ্রূণের হত্যাযজ্ঞ। রাষ্ট্রীয় আইন ও ধর্মীয় কঠোর নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে শহরের অলিতে গলিতে গজিয়ে ওঠা ক্লিনিক হাসপাতালে যেমন চলছে গর্ভপাতের রমরমা কারবার। আবার বন বদাড়ে নিষ্ঠুরভাবে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে সদ্যভূমিষ্ট মানবসন্তান। এই ভ্রূণ ও শিশুহত্যা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কোনভাবেই। এটা যেন ঠিক জাহেলী বর্বরতার আধুনিক ভার্সন। জাহেলী যুগে কন্যা সন্তানকে যেমন পিতা নিজহাতে মাটির গর্তে পুতে জীবন্ত হত্যা করতো, ঠিক তেমনি কষ্ট দিয়ে অথবা তার চেয়ে আরো বেশি যন্ত্রণা দিয়ে মায়ের গর্ভে থাকা মানবশিশুকে ক্ষতবিক্ষত করে হত্যা করছে মানুষের রূপধারী অমানুষরা। এরচেয়ে অপমানকর আর কি হতে পারে? এই সমাজ আর মানুষের জন্য এরচে’ কলঙ্কজনক অধ্যায় কিইবা হতে পারে আর! কোনভাবেই এটা সভ্য সমাজের কালচার হতে পারে না। এ যে জাহেলী বর্বরতারই জ¦লন্ত প্রতিচ্ছবি।

ইসলামপূর্ব জাহেলী যুগে কন্যা সন্তান হত্যা:
বর্তমানের এই সভ্য যুগ যেন সেই জাহেলী বর্বর যুগেরই একটি প্রতিচ্ছবি। এদেশে এখনো অনেক পরিবারে কন্যা সন্তানের জন্মকে অপমানকর মনে করা হয়। কন্যা সন্তান জন্মের ‘অপরাধে’ অনেক মা শিকার হন রীতিমত শ্বশুর শাশুড়ির নির্যাতনের। আবার কন্যা ভূমিষ্ঠ হওয়ার কারণে মাকে তালাক দিয়েছে পাষণ্ড পিতা, এর নজিরও কম নেই। ঠিক এ যেন বর্বর যুগের আপডেট ভার্সন। এমনই ছিলো জাহেলী যুগে। কন্যা সন্তানের জন্মকে মনে করা হতো কলঙ্কের। সমাজের চোখে নিকৃষ্ট ছিল কন্যার জনক। আপমান ও লজ্জায় সে থাকতো আত্মগোপন করে। চলতো মানুষ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে। কন্যা সন্তানকে তারা এতটাই নিকৃষ্ট ভাবতো যে, চরম শত্রুর জন্য কন্যা কামনা করতো, এমনকি আল্লাহর প্রতি তাদের চরম বিদ্বেষের প্রকাশ হিসেবে আল্লাহর জন্যও তারা কন্যার সম্পর্ক সাব্যস্ত করতো। কন্যা সন্তানকে তারা জীবন্ত মাটিতে পুঁতে হত্যা করতো। কুরআনুল কারীমে তার বিবরণ রয়েছে। ‘তারা রহমান আল্লাহর জন্য যে কন্যা সন্তানের বর্ণনা করে, যখন তাদের কাউকে তার সংবাদ দেয়া হয়, তখন তার মুখমণ্ডল কালো হয়ে যায় এবং ভীষণ মনস্তাপ ভোগ করে।’ (সূরা যুখরুফ: ১৭)

আরো স্পষ্ট করে অন্যত্র বলা হয়েছে। ‘যখন তাদের কাউকে কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়, তখন তার মুখ কালো হয়ে যায় এবং অসহ্য মনস্তাপে ক্লিষ্ট হতে থাকে। তাকে শোনানো সুসংবাদের দুঃখে সে লোকদের কাছ থেকে মুখ লুকিয়ে থাকে। সে ভাবে, অপমান সহ্য করে তাকে থাকতে দিবে, না তাকে মাটির নীচে পুঁতে ফেলবে। শুনে রাখ, তাদের ফয়সালা খুবই নিকৃষ্ট।’ (সূরা নাহল: ৫৮-৫৯)।

পাঠক, ইসলামের আগমনপূর্ব আরবের দৃশ্যপট ছিলো বড়ই নির্মম। কন্যার প্রতি তাদের আচরণ ছিলো বড়ই বেদনার। সমাজের ব্যবহার ছিলো অমানবিক। আরবের অধিকাংশ গোত্র কন্যা সন্তানকে এভাবে জীবন্ত কবর দিত। রাবিয়াহ, কিন্দা ও তামীম গোত্র আরবে এ ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ ছিল। (বুলূগুল আরব ৩/৪২)। তারা দারিদ্রতা ও অভাবের ভয়ে এটা করত। তবে অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মত হলো, আরবের প্রায়ই সকল গোত্রই এ কাজে জড়িত ছিল (প্রগুক্ত :৪৩, উসদুল গাবাহ ৪/২২০)।

কায়েস ইবনু আসিম নামক এক ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণের পর রাসূূলুুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললেন, আমি নিজ হাতে আমার আটটি মেয়েকে জীবিত মাটির নীচে দাফন করেছি। (তাফসীরে ইবনে কাসির ৪/২৯৯৩) এ ব্যক্তির নিজহাতে কন্যাহত্যার ভয়ংকর বিবরণ তার মুখেই বর্ণিত হয়েছে ইতিহাসের বিভিন্ন গ্রন্থে। দেখুন- আলওয়াফী বিলওয়াফাত ২৪/২১৫।

পাঠক, এভাবেই সেই অন্ধকার যুগে নির্মম হত্যার শিকার হতো কন্য সন্তানরা। পিতার হাতেই জীবন্ত প্রোথিত হতে হতো শুধু কন্যা হিসেবে জন্ম নেয়ার অপরাধে। আর বর্তমানে দুনিয়ার আলো বাতাসে চোখ খোলার আগেই অনেক কন্যা ভ্রূণকে শুধু কন্যা হবার কারণেই মায়ের পেটের ভেতরেই টুকরো টুকরো করে হত্যা করা হয়।

এম. আর. ভ্রূণহত্যার নির্মম অধ্যায়:
চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, গর্ভধারণের পর প্রথম আট সপ্তাহের মধ্যে একটি ভ্রূণ সন্তান হিসেবে অবয়ব লাভ করতে থাকে। প্রথম অবস্থায় এটি মাংস পিন্ড হিসেবে নারীর দেহের একটি অঙ্গ হিসেবে থাকে। ধীরে ধীরে তা বিকাশ লাভ করে ও তাতে প্রাণ সঞ্চারিত হয়। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে, ভ্রুণের বয়স যখন তেতাল্লিশ দিনের কম হয়, তখন ভ্রুণ একটি রক্তপিণ্ড হিসেবে মায়ের গর্ভে অবস্থান করে। এ সময় পর্যন্ত তার কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রকাশ পায় না। আধুনিক যুগে ভ্রুণহত্যা জাহেলি যুগে কন্যা সন্তানকে জীবন্ত সমাধিস্থ করার মতোই। তখন বাবা নিজ মেয়েকে গর্তে পুঁতে ফেলত আর এখন আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে মায়ের পেটেই শিশুকে মেরে ফেলা হচ্ছে।

পাঠক, মানুষের ভ্রূণ হল মানুষের একটা আকার। তাই ধর্মীয় বিবেচনায় গর্ভপাত হলো চরম ভুল বা সরাসরি খুন। ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে তাই গর্ভপাত বিরাট অপরাধ বলে বিবেচিত হয়। কয়েকটি উপায়ে গর্ভপাত ঘটানো হয়। পেটের ভ্রূণ যন্ত্রের মাধ্যমে টুকরো টুকরো করে, সাত সপ্তাহের মধ্যে হলে ঔষধ প্রয়োগ করে। সবচেয়ে সস্তা পদ্ধতি হলো মায়ের জঠরে বিষ বা লবণ প্রয়োগ করে ভ্রণ হত্যা এবং চব্বিশ ঘন্টা পর মৃত বাচ্চা প্রসব করানো । এসব নিষ্ঠুর পদ্ধতি অবলম্বন করে ভ্রূণ হত্যা করা হয়ে থাকে। তবে গর্ভপাতের জন্য বাংলাদেশে এমআর বা মিনস্ট্রুয়াল রেগুলেশন বহুল প্রচলিত মাধ্যম। এমআর বা মিনস্ট্রুয়াল রেগুলেশনের মাধ্যমে গর্ভপাত হলো, এক ধরনের লম্বা নল জরায়ুতে ঢুকিয়ে গর্ভের শিশুটিকে প্রথমে নির্মমভাবে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়। পরে ভ্যাকুয়াম সাকারের মাধ্যমে শিশুটিকে শুষে আনা হয় বাইরে।

বাংলাদেশে এমআরের নামে কত ভ্রুণ হত্যা হচ্ছে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান সরকারের কাছে না থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গুতম্যাকার ইনস্টিটিউট ২০১৪ সালে একটি জরিপে উঠে আসে এক ভয়ংকর তথ্য। সেখানে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১১ লাখ ৯৪ হাজার স্বপ্রণোদিত গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে। সেই হিসেবে দৈনিক গড়ে এ ধরনের গর্ভপাতের সংখ্যা ৩ হাজার ২৭১টি।

এদেশে ধর্মীয় ও আইনগতভাবে এমআর নিষিদ্ধ। বাংলাদেশে গর্ভপাত নিষিদ্ধ করা হয় ১৮৬০ সালের পেনাল কোডের ৩১২-৩১৮ ধারার মাধ্যমে, যদি না নারীর জীবন বাঁচাতে গর্ভপাতের প্রয়োজন হয়। তবে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালীন সময়ে গর্ভপাতের আইনের ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা আনা হয়। ১৯৭২ সালের অর্ডিনেন্স অনুসারে যেসব নারী মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তাদের জন্য গর্ভপাত বৈধ করা হয়। এবং এই অর্ডিনেন্স অনুসারেই গর্ভবতী হওয়ার ৮ সপ্তাহ পর্যন্ত এমআরকে বৈধতা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে মাসিক নিয়মিতকরণ বা মেনস্ট্রæয়াল রেগুলেশনের (এমআর) আইন ১৯৭৯ এর মাধ্যমে ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত এমআর করার বৈধতা দেওয়া হয়। ভ্রূণ হত্যা বাংলাদেশের আইনে নিষিদ্ধ তারপরও গোপনে বিভিন্ন হসপিটাল ও ক্লিনিকে গর্ভপাত করানো হয়। যা নৈতিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিতে অবৈধ ও মারাত্মক অপরাধ।

কেন হচ্ছে ভ্রূণ ও শিশুহত্যা?
সমাজের সব ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়া নৈরাজ্য, নৈতিক অবক্ষয় এবং বিশৃঙ্খলার বলি হতে হচ্ছে এসব নবজাতককে। প্রতিদিন নিত্যনতুন মাত্রায় উন্মোচিত হচ্ছে সমাজের বিকৃত চেহারা। সে সঙ্গে বেরিয়ে পড়ছে মানবিকতার অধঃপতনের ভয়াবহ চিত্র। এসব নৈরাজ্য এবং পাশবিক উন্মত্ততা, নৈতিক মানবিকতার বিকাশের ঘাটতি এবং আদর্শবাদের পতনের ফলে একের পর এক এ জাতীয় ঘটনা ঘটছে। সামাজিক অপরাধ, পাপাচার ব্যাধি মূলত ভ্রূণ হত্যার জন্য দায়ী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কারণে কোনো নারী সন্তানসম্ভবা হলে লোকলজ্জার কারণে গর্ভপাত ঘটানো হয়। এ ছাড়া অনেক স্বামী-স্ত্রী ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ সন্তান বিবেচনা করে গর্ভপাতের আশ্রয় নেন। অনেক ক্ষেত্রে পরকীয়ার সম্পর্কে জড়িয়ে কোনো নারী সন্তানসম্ভবা হলে ভ্রূণ কিংবা নবজাতককে হত্যা করা হয়। নারীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে অনেক পুরুষ দৈহিক সম্পর্কে জড়ান। ওই নারী সন্তানসম্ভবা হলে তাকে মেনে নেন না বা অনেকে পালিয়ে যান। পরে বাধ্য হয়ে ওই নারীকে এমন পথ বেছে নিতে হয়। ক্ষেত্রবিশেষে নবজাতক কন্যা হলে তাকে হত্যার ঘটনাও ঘটছে। তবে অধিকাংশ ভ্রূণ হত্যা হচ্ছে নষ্ট চরিত্রের ফসল।

ইসলামের দৃষ্টিতে গর্ভপাত:
ইসলামে গর্ভপাতের বিষয়টি আলোচনার পূর্বে একটি হাদীস দেখবো, আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা. বলেন, সাদিকুল মাসদূক (সত্যপরায়ণ ও সত্যনিষ্ঠরূপে প্রত্যায়িত) রাসুলুল্লাহ সা. আমাদের হাদীস শুনিয়েছেন যে, ‘তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টি (শুক্র) তার মাতৃ উদরে চল্লিশ দিন জমাট থাকে। এরপর অনুরুপ চল্লিশ দিনে রক্তপিণ্ডে পরিণত হয়। এরপর অনুরুপ চল্লিশ দিনে তা একটি গোশত পিণ্ডের রুপ নেয়। এরপর আল্লাহ তা’আলার তরফ থেকে একজন ফিরিশতা পাঠানো হয়। সে তাতে রুহ ফুঁকে দেয়। আর তাঁকে চারটি বিষয় লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। আর তা হল এই- তার রিযক, তার মৃত্যুক্ষণ, তার কর্ম এবং তার বদকার ও নেককার হওয়া। (সহীহ মুসলিম ৬৪৮২)

পাঠক, মায়ের গর্ভে ভ্রূণটি ধাপে ধাপে বেড়ে উঠতে থাকে এবং ১২০ দিন অতিবাহিত হলে শিশুর রূহ ফুঁকে দেয়া হয়। আর আস্তে আস্তে তা একটি পূর্ণাঙ্গ মানব শিশুতে পরিণত হয়। তাই গর্ভপাতের বিষয়টিকে আমরা চারভাগে ভাগ করতে পারি।

১. ভ্রূণের বয়স ৬ মাসের বেশি হলে কোন অবস্থায়ই তা নষ্ট করা বৈধ হবে না। কারণ ছয় মাসের বাচ্চা সিজারের মাধ্যমে ডেলিভারি করলে তা বেঁেচ থাকে। এমনকি মায়ের জীবনের ঝুঁকি থাকলেও তা নষ্ট করা যাবে না। কারণ এ সময়ে মা ও বাচ্চার জীবনের অধিকার সমান। তাই কোনভাবেই একটি জীবন্ত শিশুকে নিমর্মভাবে হত্যা করা যাবে না। আল্লাহ বলেন-‘আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতীত তাকে হত্যা করো না।’ (সূরা বনী ইসরাইল ৩২)

২. ভ্রূণের বয়স ছয় মাসের কম ও চার মাসের বেশি হলে, তখনও গর্ভপাত বৈধ নয়। কারণ ‘ভ্রূণে রুহ আসার পর গর্ভপাত সর্বসম্মতিক্রমে হারাম। আর এ গর্ভপাত সরাসরি হত্যাতুল্য।’ তবে যদি মাকে বাঁচানোর জন্য ভ্রূণকে নষ্ট করতে হয়, তাহলে তা বৈধ হবে। কারণ এখানে ছয় মাসের কম ভ্রূণে রুহ আসলেও তা সিজারের মাধ্যমে বের করলে তা বাঁচে না, আর এর বিপরীতে মায়ের জীবন নিশ্চিত। তাই মাকে বাঁচাতে এ সময়ের ভ্রূণ নষ্ট করার একান্ত প্রয়োজন দেখা দিলে তা বৈধ। (ফাতহুল আলিয়্যিল মালিক ১/৩৯৯)

৩. ভ্রূণের বয়স চারমাসের কম হওয়া, তবে তার অঙ্গ প্রতঙ্গ হাত পা আঙ্গুল চুল ইত্যাদি সৃষ্টি হয়ে যাওয়া যা ৪২ দিন মতান্তরে ৫২ দিনের মধ্যে শুরু হয়। এমতাবস্থায় গর্ভপাত মাকরুহ তাহরীমী।

৪. ভ্রূণের বয়স চার মাসের কম হওয়া এবং কোন অঙ্গপ্রতঙ্গ সৃষ্টি না হওয়া, এ অবস্থায় গর্ভপাত মাকরুহে তানযীহী । তবে যৌক্তিক কোন কারণ থাকলে তা মাকরুহ হবে না।

ইসলামে শিশুহত্যার শাস্তি:
কয়েকটি কারণে মানুষ ভ্রূণ বা শিশু হত্যা করে: ১. কন্যা সন্তানের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে, আর আল্লাহ সরাসরি এ বিষয়ে বলেন-‘ ‘যখন তাদের কাউকে কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়, তখন তার মুখ কালো হয়ে যায় এবং অসহ্য মনস্তাপে ক্লিষ্ট হতে থাকে। তাকে শোনানো সুসংবাদের দুঃখে সে লোকদের কাছ থেকে মুখ লুকিয়ে থাকে। সে ভাবে, অপমান সহ্য করে তাকে থাকতে দিবে, না তাকে মাটির নীচে পুঁতে ফেলবে। শুনে রাখ, তাদের ফয়সালা খুবই নিকৃষ্ট।’ (সূরা নাহল: ৫৮-৫৯)

২. দরিদ্রতার ভয়ে: এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন-‘ তোমরা তোমাদের সন্তানকে দরিদ্রতার ভয়ে হত্যা করো না। আমরা তোমাকে এবং তোমার সন্তানকে রিজিক দান করি। তাই তাদের হত্যা করা সত্যিকার অর্থেই একটি মহাপাপ।” (সূরা বনী ইসরাঈল আয়াত: ৩১)
‘আমি পৃথিবীতে তোমাদের জন্যও রিজিকের ব্যবস্থা করেছি এবং তাদের জন্যও যাদের রিজিকদাতা তোমরা নও, এমন কোনো বস্তু নেই যার ভাণ্ডার আমার কাছে নেই, যার থেকে আমি এক পরিকল্পিত হিসাব অনুসারে বিভিন্ন সময়ে রিজিক নাজিল করে থাকি।’ (সুরা হিজর ২০-২১)

৩. চারিত্রিক স্খলনের ফসল: ইসলামে ব্যভিচার ও অবাধ যৌনাচারকে মারাত্মক অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ব্যভিচার বলতে বোঝায় ইসলামী বিধান মোতাবেক বিয়ে ছাড়া অবৈধ পন্থায় যৌন সম্পর্ককে। এটা ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কোরআনে কারিম ও হাদিস শরিফে এ সম্পর্কে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা এসেছে। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হচ্ছে-‘ আর তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তীও হয়ো না, নিশ্চয় তা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট পথ।’ (সূরা আল ইসরা : ৩২)

অন্য আয়াতে বলেন- ‘বলো, এসো, তোমাদের ওপর তোমাদের রব যা হারাম করেছেন, তা তিলাওয়াত করি যে, তোমরা তার সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না এবং মা-বাবার প্রতি ইহসান করবে আর দারিদ্র্যের কারণে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না। আমিই তোমাদেরকে রিয্ক দেই এবং তাদেরকেও। আর অশ্লীল কাজের নিকটবর্তী হবে না- তা থেকে যা প্রকাশ পায় এবং যা গোপন থাকে। আর বৈধ কারণ ছাড়া তোমরা সেই প্রাণকে হত্যা করো না, আল্লাহ যা হারাম করেছেন। এগুলো আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা বুঝতে পার।’ (সূরা আনআম : ১৫১)

পাঠক, ইসলাম ভ্রূণহত্যা ও শিশুহত্যাকে অন্য হত্যার মতো অপরাধ বলেই গণ্য করে থাকে। অন্য ধর্মেও এসব কাজ অপরাধ বলে বিবেচিত। ধর্ম যেমন প্রত্যেক শিশুকে দিয়েছে বাঁচার অধিকার, ঠিক আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনেও রয়েছে তাদের বাঁচার অধিকার। ইসলাম যেখানে সন্তানদের যত্ন করে লালন-পালনের কথা বলে, সেখানে এই নবজাতকদের হত্যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আল্লাহর প্রতি আস্থা ও পরকালে বিশ্বাসী কেউ এমন নির্মম কাজ করতে পারে না। সামাজিক অবক্ষয় ও নৈতিক অধঃপতন কতটা হলে এভাবে নবজাতক হত্যার উপলক্ষ তৈরি হয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু সভ্য সমাজ নয়, পৃথিবীর কোনো ধর্মে, সমাজে ও মতবাদে নিরাপরাধ মানুষ মারার কোনো বিধান নেই। এক্ষেত্রে ইসলাম সবচেয়ে কঠোর। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করল সে যেন পুরো পৃথিবীকে হত্যা করল, আর যে একজন (নিরপরাধ) মানুষকে বাঁচিয়ে দিল সে যেন পুরো পৃথিবীকে হত্যার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল (সুরা মায়েদাহ : ৩২)

আল্লাহ আরো বলেন-‘যখন জীবন্ত প্রোথিত কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে, কি অপরাধে তাকে হত্য করা হল?’ (সুরা তাকভীর ৮-৯)।

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করা কিংবা যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করা ছাড়া যে কাউকে হত্যা করল, সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল। আর যে তাকে বাঁচাল, সে যেন সব মানুষকে বাঁচাল। আর অবশ্যই তাদের কাছে আমার রাসূলগণ সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ নিয়ে এসেছে। তা সত্তে¡ও এরপর জমিনে তাদের অনেকে অবশ্যই সীমালঙ্ঘনকারী।’ (সূরা মায়েদা : ৩২)

তাই সহজেই আমরা বলতে পারি, একটি নবজাতক শিশুকে হত্যা করা অর্থ হলো সারাপৃথিবীর সকল মানুষকে হত্যা করা। আর এই ভয়াবহ মহাপাপ থেকে আমাদের সমাজকে রক্ষা করতে হবে। বাঁচাতে হবে আগামী প্রজন্মকে বিপদগামীতা থেকে।

লেখক: ইমাম, মেইন বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদ, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।
মুহাদ্দিস, বলিদাপাড়া মাদরাসা, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here