সবুজদেশ ডেক্সঃ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয়েছে। ২৩ ডিসেম্বরের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে সিইসি মনোনয়নপত্র দাখিল, বাছাই ও প্রত্যাহারের দিনক্ষণ ঘোষণা করেছেন। তফসিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে ভোটের উৎসবে মেতে উঠেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ও তার শরিকরা। প্রথম দুই দিনে ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের রেকর্ড তৈরিই হয়নি, নেতা-কর্মীদেরে স্বতঃস্ফূর্ত ঢল নেমেছে। আওয়ামী লীগ আগে থেকে নিজেরাই ভোট যুদ্ধে নামেনি দেশকেও নির্বাচনমুখী করার উদ্যোগ নিয়ে অনেকটাই সাফাল্য কুড়িয়েছে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টির শক্তির ওপরে গড়ে উঠেছে ১৪ দল-সহ বিভিন্ন দলের শরিকানায় মহাজোট। অন্যদিকে আরেক প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি ও জনপ্রিয়তার ওপর ভর করে গড়ে ওঠা ২০-দলীয় জোট ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ও সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মহাজোট বিরোধী নির্বাচনী মোর্চা হিসেবে রাজনীতির মঞ্চে আবির্ভূতই হয়নি রীতিমতো আলোচনা ও জল্পনা-কল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে ঠাঁই নিয়েছে। মঞ্চে ঐক্যফ্রন্ট নেতারা তাদের সাত দফা দাবি থেকে একচুল না নড়ার ঘোষণা দিয়ে গরম গরম ভাষণে সমর্থকদের চাঙ্গা করে চলেছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের মুখপাত্র ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যেমন রোজ গণমাধ্যমে সব দলের অংশগ্রহণ মূলক নির্বাচন সামনে রেখে দায়িত্বশীল বক্তব্য রাখছেন তেমনি তার নির্বাচনমুখী বক্তব্য দলীয় নেতা-কর্মীদের শৃঙ্খলা রক্ষা করার মধ্য দিয়ে উজ্জীবিত করছেন। এদিকে ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের দুঃসময়ের কঠিন স্নায়ু চাপ নিয়েও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে বক্তৃতা বিবৃতি দিচ্ছেন। দুই পক্ষ যখন মুখোমুখি, সংলাপে যখন সমাধান আসেনি তখন ঐক্যফ্রন্ট যদিও আন্দোলনের কথা বলছে তখন তাদের দিকে গোটা দেশবাসীর কৌতূহলের বিষয় হচ্ছে নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করছেন কিনা। এ নিয়ে তারা গতরাতে সিরিজ বৈঠক করেছেন। বিশেষ করে বিএনপির অভ্যন্তরে এ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। একপক্ষ মনে করেন কারাবন্দী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি, নেতা-কর্মীদের নামে দায়ের করা মামলা ও হয়রানি বন্ধ করে নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করা না গেলে এই ভোটে অংশগ্রহণ করা যায় না। কিন্তু দলের দায়িত্বশীল নেতা-কর্মীরা মনে করছেন যেখানে দলের নেত্রী কারাবন্দী, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নির্বাসিত ও মামলার রায়ে দণ্ডিত সেখানে তীব্র গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন যখন প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না তখন আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করাই উত্তম। অনেকে বলছেন সেই ৫ জানুয়ারি দলের সুসময়ে ও কঠিন চাপে পতিত শাসক দল আওয়ামী লীগকে রেখে নির্বাচনে না গিয়ে বর্জন করার পরিণতিতে সারা দেশে নেতা-কর্মীদের নামে মামলাই হয়নি সংগঠনও দুর্বল হয়েছে। অন্যদিকে শাসক দল হয়েছে সুসংগঠিত ও কর্তৃত্বপরায়ণ। দাবি-দাওয়া যখন মানবে না, যখন মানছেই না, গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে সরকারকে বিদায় করার সুযোগই যখন আসছে না তখন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা ছাড়া বিকল্প কি বা আছে? পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন সংবিধান প্রণেতা ও দেশ-বিদেশে স্বনামধন্য আইনজ্ঞ ড. কামাল হোসেন ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে আসায় এবং বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক অতীত নিয়ে আ স ম আবদুর রব, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম, কর্নেল (অব) অলি আহমদ বীরবিক্রম, মোস্তফা মহসিন মন্টু, মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান মোহম্মদ মনসুর আহমদ ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতো ব্যক্তিরা ঐক্যফ্রন্টে যুক্ত হওয়ায় এর গুরুত্ব বেড়েছে। সরকার বিরোধী জনমতও তাদের অনুকূলে বইছে। সংলাপে তাদের অনেক দাবি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবিধান আইন ও নির্বাচন কমিশনের দোহাই দিয়ে নাকচ করলেও তিনি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের নিশ্চয়তা যেমন দিয়েছেন তেমনি আশ্বস্ত করেছেন একটি গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ নির্বাচন তারা উপহার দেবেন। অন্যদিকে বিএনপির নেতা-কর্মীদের নামে দায়ের করা মামলার তালিকা বিবেচনা করার জন্য যেমন নিয়েছেন তেমনি আর কোনো নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার না করা এবং মামলায় না জড়ানোর অঙ্গীকার করেছেন। এমনি পরিস্থিতিতে আলোচনার দরজা খোলাও রেখেছেন। সংলাপে বড় ধরনের সমাধান না এলেও দীর্ঘদিনে বিদ্যমান তিক্ততা ও প্রতিহিংসার মনোভাব যে অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে সেটি দেশবাসী অবলোকন করেছেন। ঐক্যফ্রন্টের নেতা যেখানে ড. কামাল হোসেন সেখানে তারা কোনো হঠকারী পথ নেবেন বলে কেউ মনে করছেন না। আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনকে রাজনীতির চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে ভোট যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন এমনটি আশা করছেন। পর্যবেক্ষকদের মতে ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথায় আস্থা রেখে সবাইকে নিয়ে নির্বাচনে এলে যদি, প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার হোঁচট খায় তাহলে জনগণের সামনে তুলে ধরে সরকারকে সমালোচনার তীরে ক্ষতবিক্ষতই নয় জনমতও গঠন করতে পারবেন। জাতীয় আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহলের সামনে নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘিত হলে, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন পক্ষপাতমূলক আচরণ করলে এবং ভোটাররা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে না পারলে সেই চিত্রপট তুলে ধরতে পারবেন। নির্বাচন যদি অবাধ ও নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু না হয় এবং গণরায় যদি ছিনতাই হয় তাহলে তখন তিনশ আসনে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের সঙ্গে নেমে আসা জনতাকে নিয়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবেন। কিন্তু নির্বাচন বর্জন করলে তীব্র গণআন্দোলনে সরকারকে দাবি আদায়ে বাধ্য করতে পারবেন কিনা এ নিয়ে যেমন প্রশ্ন রয়েছে তেমনি নেতা-কর্মীরা আরেক দফা মামলা ও দমন-পীড়নের মুখোমুখি যে হবেন সেটি অনেকেই নিশ্চিত করে বলতে চান। পর্যবেক্ষকদের মতে নির্বাচন বর্জন করে প্রতিরোধে ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ থাকলেও সরকারদলীয় মহাজোট যে নির্বাচনী বৈতরণী আরেক দফা ওয়াকওভার নিয়ে বিনা বাধায় উতরে যাবে সে কথা নিশ্চিত বলা যায়। অনেকে মনে করেন ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে নির্বাচনে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে বিএনপি যদি বিরোধী দলের আসনেও বসেন তাহলে তাদের সংখ্যা নেহায়েত কম হবে না। তখন তারা সংসদের ভিতরে বাইরে দলের কারাবন্দী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন প্রতিবাদ অব্যাহত রেখে জনগণকে তাদের দাবির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারবেন। না হয় নিজেদের অস্তিত্ব কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পতিত হবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন যদি হয় বিএনপির জন্য তিক্ত অভিজ্ঞতা তাহলে ২৩ ডিসেম্বরের নির্বাচন হতে পারে নিজেদের ঘুরে দাঁড়ানোর টার্নিং পয়েন্ট। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় জবাবদিহিতার প্রশ্নে সংসদ ঘিরে ভারসাম্যমূলক ব্যবস্থা তৈরি হবে। নতুন পরিকল্পনায় সামনে সংগঠিতভাবে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পাবে।

ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেন সেনাশাসন কবলিত বাংলাদেশে ৮১ সালে পরাজয় জেনেও রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হয়েছিলেন। গণরায় ছিনতাই হবে জেনেও ৮৬ সালে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। দল ও নিজে পরাজিত হলে ৯১ সালের নির্বাচনের পর বলেছিলেন ভোট যুদ্ধ নিরপেক্ষ হয়েছে। তাই পর্যবেক্ষকদের মতে হঠকারী পথ নয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান শরিক বিএনপির সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে তাদেরকে নিয়েই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন। রাজনীতিতে কৌশল গ্রহণের পাঠ তিনি অনেক আগেই নিয়েছেন। তিনি সংবিধান, আইন ও বিধি-বিধান অনুযায়ী কীভাবে জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থা প্রত্যাশা করেন বা জনগণকে দিতে চান এবং রাষ্ট্র পরিচালনার পদক্ষেপ এবং সংবিধান সংশোধনসহ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় কী ধরনের সংস্কার আনতে চান তা নির্বাচনী ইশতেহারে তুলে দিয়ে এই ভোট যুদ্ধে গণরায় নেওয়ার চ্যালেঞ্জ নিতে পারেন। তিনি কীভাবে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীন ও শক্তিশালী করবেন, কীভাবে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন কার্যকর মর্যাদা দিয়ে গণতান্ত্রিক নির্বাচন সুষ্ঠু, সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য করতে পারবেন তার রূপরেখাও নির্বাচনী ইশতেহারে দিতে পারেন। এক কথায় মুক্তিযুদ্ধে আকাঙ্ক্ষার রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিনির্মাণে কী চান সেটি উপস্থাপন করে ভোটের ময়দানে এসে গণরায় নেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনের তফসিল না পেছানোর জন্য ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত। এক্ষেত্রে বিকল্পধারার অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তফসিল কিছুটা এদিক ওদিক করতে পারেন। ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে এলে একটি গ্রহণযোগ্য ব্যালট বিপ্লবের জন্য চ্যালেঞ্জ শুধু নির্বাচন কমিশনের একারই নয়, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ও প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনকালীন সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জের। দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে, সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক ধারা সমুন্নত রাখতে এবং কোনো অসাংবিধানিক শক্তির যাতে আগমন না ঘটে এবং একই সঙ্গে আগামী দিনে জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থা ও সুশাসন বা আইনের শাসন নিশ্চিত করতে শক্তিশালী সরকারের পাশাপাশি শক্তিশালী বিরোধী দল সময়ের দাবি। কার্যকর সংসদ ও সব বিতর্কের এবং সমস্যার সমাধানের কেন্দ্র হবে মহান সংসদ। এটি মানুষের প্রত্যাশা। মানুষের প্রত্যাশা পূরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া প্রতিশ্রুতির ওপর আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে ড. কামাল হোসেন ঐক্যফ্রন্ট বা বিএনপিকে নিয়ে নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করুন পর্যবেক্ষকরা এমনটাই মনে করছেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here