সন্দেহের ভিত্তিতে ধরে মামলা দেওয়ার অভিযোগ, পুলিশ বলেছে সবাই বিএনপির
সবুজদেশ ডেক্সঃ আসামির কাঠগড়ায় ডালিমকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন রোকেয়া বেগম। ডালিম সম্পর্কে রোকেয়ার নাতি। রোকেয়ার দাবি, ডালিম (২৩) কেরানীগঞ্জের একটি গ্রিলের কারখানায় কাজ করেন। বন্ধুদের সঙ্গে রোববার গুলিস্তানে এলে সেখান থেকে তাঁকেসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে ওয়ারী থানা-পুলিশ। তাঁদের বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগ আনা হয়েছে।
আদালত ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির রোববারের সমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশের কাজে বাধা ও নাশকতার অভিযোগে ঢাকার ৩৩ থানায় ৪২ মামলায় ১৯০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ১৩৪ জনের বিরুদ্ধে সোমবার রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে।
সোমবার বিকেলে ঢাকার আদালত ডালিমকে দুই দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেন। ডালিমের রিমান্ডে নেওয়ার খবর শুনে দাদি রোকেয়া প্রথম আলোকে বলেন, ডালিমের নামে আগে কোথাও মামলা নেই। রাজনীতিও করেন না। তাঁর বাবা সেলিম মিয়া নৌকা চালিয়ে সংসার চালায়। রোকেয়া ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, এখন ডালিমের মামলার খরচ চালাবে কে?
ডালিমের বন্ধু অনিক। তাঁর বাড়িও কেরানীগঞ্জ। অনিকের আইনজীবী হাবিবুর রহমান আদালতে দাবি করেন, রোববার সোহরাওয়ার্দীতে বিএনপির সমাবেশ ছিল। ঢাকার কোথাও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড হয়েছে—এমন কোনো খবর টেলিভিশন কিংবা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। তাঁর মক্কেল অনিককে গুলিস্তান থেকে ধরে নিয়ে বলছে, ওয়ারীর জয়কালী মন্দির এলাকায় অনিক নাশকতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন।
ডালিম, অনিকসহ ১৩ জনকে সোমবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের (সিএমএম) আদালতে হাজির করে ওয়ারী থানা-পুলিশ ১০ দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে। আদালত প্রত্যেককে দুই দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য পুলিশকে অনুমতি দেন।
রোববার ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকে দলটির নেতা-কর্মীরা এই সমাবেশে অংশ নেয়। ঢাকার আদালত এবং পুলিশ সূত্র বলছে, বিএনপির রোববারের সমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশের কাজে বাধা দেওয়া, হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করা এবং নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে ঢাকার ৩৩টি থানা-পুলিশ ৪২টি মামলায় ১৯০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আদালতে প্রতিবেদন দিয়ে পুলিশ বলেছে, গ্রেপ্তার সব আসামি বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী। এরা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার রাস্তায় অবস্থান নিয়ে যানচলাচলে বাধা দেয়, সরকার বিরোধী স্লোগান দেয়। এ ছাড়া পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে, ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটায় এবং নাশকতা মূলক কর্মকাণ্ড ঘটায়। এসব ঘটনার রহস্য উদঘাটনের জন্য আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি। ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত ১৩৪ জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছেন।
তবে গ্রেপ্তার আসামিদের আইনজীবীরা আদালতের কাছে দাবি করেন, হয়রানি করার জন্য পুলিশ এসব আসামিকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে। কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ আদালতের কাছে দাখিল করতে পারেনি পুলিশ। শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ঢাকার আদালতে দেখা যায়, দুপুর ২টার পর থেকে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের স্বজনেরা আদালতে ভিড় করতে শুরু করেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত স্বজনদের অনেকে আদালতের সামনে অপেক্ষা করেন। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের আদালতের সামনে দেখে অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। গ্রেপ্তার বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা কর্মীদের প্রিজন ভ্যানে করে আদালত থেকে নিয়ে যাওয়ার সময় বিভিন্ন স্লোগান দিতে দেখা যায়।
রোববার গ্রেপ্তার হওয়া সজীব ও হৃদয় শেখের আইনজীবী মুক্তাদির ফরিদী আদালত বলেন, হৃদয় শেখ কেরানীগঞ্জের একটি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র। সজীব কাঠমিস্ত্রি। নয়াবাজার এলাকা থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। হৃদয়ের মানিব্যাগে ছিল ২ হাজার টাকা, আর সজীবের ছিল ১ হাজার টাকা। পুলিশ সেই টাকা নিয়ে নিয়েছে। পরে তাঁদের ওয়ারী থানার রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে।
পল্টন থানার মামলায় গ্রেপ্তার নাজমুল হক, মতিঝিল থানার মামলায় গ্রেপ্তার শাহিনূর, রামপুরার মামলায় গ্রেপ্তার জুয়েল ওরফে আজি আহম্মেদ, সবুজবাগ থানার মামলায় আকরাম খান টিংকন ও সুজন মিয়ার আইনজীবীরা আদালতকে জানান, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা না থাকার পরও পুলিশ রাস্তা থেকে তাঁদের সন্দেহের ভিত্তিতে ধরে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দিয়েছে।
অন্যদিকে, সাভার থানা-পুলিশ গত বছরের নভেম্বর মাসের পুরোনো মামলায় ৯ জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে পাঠায়। পাঁচ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার আবেদন করলে আদালত তা নাকচ করে দেন। আদালত আদেশে বলেন, এসব আসামিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই।
কোন থানায় কত জন গ্রেপ্তার:
মতিঝিল থানায় ১৭ জন, ওয়ারী থানায় ১৩ জন, পল্টন ১৪ জন, শাহজাহানপুর ১১ জন, সবুজবাগ থানায় ৯ জন, রামপুরা থানায় ৮ জন, কদমতলী থানায় ৮ জন, খিলগাঁও থানায় ৮ জন, মুগদা থানায় ৮ জন, যাত্রাবাড়ী থানায় ৪ জন, শ্যামপুর থানায় ২ জন, গুলশান, খিলক্ষেত থানায় ১ জন, উত্তরা পশ্চিম থানায় ১ জন, নিউমার্কেট থানায় ৫ জন, কলাবাগান থানায় ৪ জন, দারুস সালাম থানায় ২ জন, হাজারীবাগ থানায় ৭ জন, ধানমন্ডি থানায় ১ জন, রমনা থানায় ১০ জন, শাহবাগ থানায় ৬ জন, বাড্ডা থানায় ৬ জন, বনানী থানায় ২ জন, ভাটারা থানায় ২ জন, তেজগাঁও থানায় ৪ জন, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় ৫ জন, হাতিরঝিল থানায় ৭ জন, কোতোয়ালি থানায় ৩ জন, পল্লবী থানায় ৩ জন, মোহাম্মদপুর থানায় ৩ জন, চকবাজার থানায় ৬ জন, কামরাঙ্গীরচর থানায় ৪ জন এবং সাভার থানায় ৯ জন।