সরকারি ১৫ চিনিকলে লোকসান ৪ হাজার কোটি টাকা
সবুজদেশ ডেস্কঃ
ব্যাপক অনিয়ম, প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের অদক্ষতা ও বেপরোয়া দুর্নীতিতে ডুবতে বসেছে সরকারের ১৫টি চিনিকল। গত ৫ বছরে এসব প্রতিষ্ঠানের লোকসান দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। এই ঋণের পুরোটাই খেলাপি। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
আরও জানা গেছে, বর্তমানে প্রতি কেজি সরকারি চিনির উৎপাদন খরচ ৩শ’ টাকার বেশি। আর তা বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। অর্থাৎ কেজিতে ২৪০ টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। যদিও বাজারে সরকারি এই চিনির চাহিদা ব্যাপক। কিন্তু সরবরাহ করা হয় না। বেসরকারি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগসাজশে চিনিকলগুলো উৎপাদন বন্ধ ও বিক্রি রেখে বাজার এক রকম বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতেই ছেড়ে দেয়া হয়েছে। যে কারণে মিলগুলোতে প্রায় ৪৫ হাজার টন চিনি অবিক্রীত পড়ে আছে। অপরদিকে বেসরকারি চিনিকলের সবগুলো মুনাফায়।
এদিকে লোকসানের কারণে সম্প্রতি ৬টি চিনিকল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আর এ সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করছে এসব প্রতিষ্ঠানের ২ হাজার ৮৮৪ জন শ্রমিক। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রতিষ্ঠানগুলোর বোর্ড ভেঙে আমূল সংস্কার জরুরি। তবে লোকসানের দায় নিতে রাজি নয় বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন (বিএসএফআইসি) কর্তৃপক্ষ।
জানতে চাইলে বিএসএফআইসির চেয়ারম্যান সনৎ কুমার সাহা যুগান্তরকে বলেন, লোকসানের মূল কারণ বিক্রয় মূল্যের চেয়ে উৎপাদন খরচ বেশি। উৎপাদন কেন বেশি এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি এখানে যোগদান করেছি মাত্র ৭ মাস। এর আগে দীর্ঘদিন যারা এখানে দায়িত্ব পালন করেছেন তারা ভালো বলতে পারবেন। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশের অনুরোধ করেন তিনি। বিএসএফআইসির চেয়ারম্যান বলেন, লোকসান কমানোর প্রথম ধাপ হিসেবে ছয়টি চিনিকল বন্ধ করা হয়েছে। জাপান ও থাইল্যান্ড আমাদের চিনিকলে ৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে চায়। করোনার উত্তরণ হলে এই বিনিয়োগ আসতে পারে।
দেশে সরকারি মালিকানাধীন ১৫টি চিনিকল রয়েছে। এগুলো হল- জিলবাংলা সুগার মিলস, ঠাকুরগাঁও সুগার, শ্যামপুর সুগার, সেতাবগঞ্জ সুগার, রংপুর সুগার, পঞ্চগড় সুগার, নর্থবেঙ্গল সুগার, নাটোর সুগার মিলস, মোবারকগঞ্জ সুগার, কুষ্টিয়া সুগার, জয়পুরহাট সুগার, ফরিদপুর সুগার মিলস, রাজশাহী সুগার মিলস এবং কেরু অ্যান্ড কোং সুগার মিল। প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩০ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে এগুলো প্রতিষ্ঠিত। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে বাংলাদেশ সুগার মিলস কর্পোরেশন গঠিত হয়। পরে সুগার মিলস কর্পোরেশন ও বাংলাদেশ ফুড অ্যান্ড অ্যালাইড ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন দুটি একীভূত করে বিএসএফআইসি গঠিত হয়েছে।
গত পাঁচ বছরে ৩ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে কর্পোরেশন। এর মধ্যে বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরেই লোকসান ছিল ৯৭০ কোটি টাকা। তাছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে ৭ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ রয়েছে। এছাড়া শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও গ্র্যাচুইটি, ভবিষ্যৎ তহবিল, আখের মূল্য ও সরবরাহকারীর বিল বাবদ বকেয়া ৫৫১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। তবে সম্প্রতি ৪০৭ টাকা অর্থ সহায়তা পেয়েছে কর্পোরেশন। আরও ৪৫০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। অন্যদিকে আর সরকারি হিসাবে প্রতি বছর দেশে চিনির চাহিদা প্রায় ২০ লাখ টন। বিপরীতে সরকারি ১৫টি চিনিকলে উৎপাদিত হয় মাত্র ২ লাখ ৩০ হাজার টনের মতো। অর্থাৎ মোট চাহিদার ১০ শতাংশের কিছুটা সরকারিভাবে উৎপাদন করা হয়। বাকি চিনি বেসরকারি চিনিকল ও আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, যে উদ্দেশ্যে সরকারি কোম্পানি গঠন করা হয়েছিল, তা সফল হয়নি। কারণ লোকসান বৃদ্ধির অর্থ হল বাজার প্রতিযোগিতায় বেসরকারি কোম্পানির তুলনায় পিছিয়ে পড়ছে এসব কোম্পানি। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ বাড়ছে। অর্থাৎ মুদ্রা এবং পুঁজি উভয় বাজারে সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি বলেন, এসব প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজমেন্ট ভেঙে দেয়া উচিত। তা না হলে পরিস্থিতি উন্নতি হবে না।
এদিকে বেসরকারি চিনিকলের মধ্যে প্রায় সবগুলোই মুনাফা করছে। এর মধ্যে বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ, নরসিংদীর পলাশে দেশবন্ধু সুগার মিলস, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে ইউনাইটেড সুগার মিলস ও আব্দুল মোনেম সুগার রিফাইনারি, চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে এস আলম রিফাইন্ড সুগার মিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আখ উৎপাদনের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে আখ চাষিদের মিলের মাধ্যমে যে ঋণ দেয়া হয়, কৃষকরা সেই ঋণের টাকা যথাসময়ে পরিশোধ করলেও মিল কর্তৃপক্ষ পুরো টাকা ব্যাংকে পরিশোধ করে না। প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের শনাক্ত করা এই ৬ কারণের বাইরেও সরকারি চিনিকলগুলোয় লোকসান দেয়। তা হল রাজনৈতিক প্রভাবে অধিক জনবল নিয়োগ। সিবিএ’র নামে দলাদলি। মিল পরিচালনায় সিবিএ নেতাদের হস্তক্ষেপ এবং সিবিএ নেতার পরিচয়ে অধিকসংখ্যক জনবল মিলের উৎপাদন কাজে যুক্ত না হওয়া। সরকারি মিলগুলোয় কাঁচামাল বা উৎপাদিত পণ্য পরিবহনের জন্য যানবাহন মিলের কর্মকর্তা বা সিবিএ নেতা কর্তৃক ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা। অতিরিক্ত জ্বালানি তেলের বিল আদায়। উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণে কোনো বিপণন সিস্টেম না থাকা। মিলগুলোর লোকসানের আরেকটি কারণ পণ্যের প্রচার না থাকা। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের কর্মকর্তাদের মতে, চিনিকলগুলোয় শুধু চিনি উৎপাদন করে লাভজনক করা যাবে না। চিনিকলের কর্মচারীদের বছরে মাত্র ৩ মাস কাজ থাকে। বাকি ৯ মাস তারা অলস সময় কাটান। আখমাড়াই মৌসুম শেষ হলে চিনিকলগুলোয় অন্য পণ্য উৎপাদনের উদ্যোগ নিতে হবে। অতিরিক্ত জনবল কমাতে হবে।
বিলুপ্ত প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের এক সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে, সুনির্দিষ্ট ৬টি কারণে সরকারি চিনিকলগুলো লোকসান দিচ্ছে। এগুলো হল- যৌক্তিক কারণ ছাড়াই এই কারখানাগুলোয় উৎপাদিত চিনির ব্যয় বেশি, কিন্তু তুলনায় বাজারে চিনির দাম কম। এক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা অদক্ষতা, দুর্নীতি ও ব্যাপক অনিয়মের কথা বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে সরকারি এই চিনির চাহিদা ব্যাপক। কিন্তু সরবরাহ করা হয় না।
বেসরকারি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগসাজশে চিনিকলগুলো উৎপাদন বন্ধ রেখে বাজার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, উৎপাদিত পণ্য বিক্রি না হওয়ায় দিনের পর দিন মূলধন আটকে আছে। আর মূলধন আটকে গেলে বাড়তে থাকে ব্যাংক ঋণের সুদের পরিমাণ। তৃতীয়ত, সরকারি চিনিকলগুলোয় ব্যবহৃত প্রধান কাঁচামাল আখ পাওয়া যায় না। আখের অভাবে চিনিকলগুলো বন্ধ থাকে মাসের পর মাস। চিনিকল বন্ধ থাকলেও শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে সারা বছরের বেতন-ভাতা দিতে হয়।
উৎপাদন নেই, কিন্তু বেতন-ভাতা দিতে হচ্ছে। ফলে লোকসানের পরিমাণও বাড়ছে। চতুর্থ কারণ হল সারা বছর উৎপাদন হচ্ছে না। ফলে যথাসময়ে ব্যাংক ঋণও পরিশোধ করা যাচ্ছে না। আর যথাসময়ে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় প্রতিদিন ব্যাংকগুলোর কাছে চিনিকলগুলোর দায় বাড়তে থাকে। পঞ্চমত, আখ চাষে চাষীদের আগ্রহ কমে গেছে। মিলগুলোয় আখ সরবরাহ করতে সরকারি দলের আধিপত্য বিস্তার, সরকারি কর্মকর্তাদের নানারকমের ঝুটঝামেলা এবং কলগুলোয় সরবরাহকৃত আখের মূল্য সময়মতো না পাওয়ায় আখচাষীরা আখ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। আর ৬ষ্ঠ কারণ আখ সরবরাহে জটিলতা, আখের দাম না পাওয়ায় আখ চাষের বদলে চাষীরা অন্য ফসল চাষ করার দিকে ঝুঁকছেন। এ কারণে দিন দিন আখ চাষের জমি কমে যাচ্ছে। এটিও চিনিকলগুলোর লোকসানের অন্যতম কারণ।
লোকসান কমাতে সম্প্রতি সরকারি ৬ চিনিকল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসএফআইসি। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের আখ মাড়াই বন্ধ করা হয়েছে। উৎপাদন বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া চিনিকলগুলো হচ্ছে- কুষ্টিয়া, পাবনা, পঞ্চগড়, শ্যামপুর (রংপুর), রংপুর ও সেতাবগঞ্জ (দিনাজপুর) চিনিকল। বন্ধ হওয়া ছয় চিনিকলে ২ হাজার ৮৮৪ জন শ্রমিক কাজ করছে। বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া ৬ চিনিকল গত অর্থবছরে ৩৮০ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। তার মধ্যে কুষ্টিয়া চিনিকল ৬১ কোটি, পাবনা ৭৪, পঞ্চগড় ৪৭, শ্যামপুর ৫৯, রংপুর ৫৩ এবং সেতাবগঞ্জ চিনিকল লোকসান দিয়েছে ৮৪ কোটি টাকা।
সুত্রঃ দৈনিক যুগান্তর