সাবধান, ছিনতাইকারী সামনে!
ঈদ সামনে রেখে সক্রিয় হয়ে উঠেছে ঢাকার একটি সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারীর চক্র। গতকাল শনিবার ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) যাত্রাবাড়ী ও নিউ মার্কেটে অভিযান চালিয়ে আট ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে কেবল উৎসবের সময় নয়, সারা বছর ধরে তৎপরতা চালায় এই চক্রের সদস্যরা।
সাত মাস আগে বাংলাদেশে আসেন জার্মান তরুণী সুইন্ডে উইদারহোল্ড। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে নানা ছবি তুলে ল্যাপটপে রাখেন তিনি। গত ১৪ জুন ভোরবেলা ধানমন্ডি থেকে রিকশায় করে এলিফ্যান্ট রোডে ফেরার পথে ছিনতাইকারীরা তাঁর ল্যাপটপ ছিনিয়ে নেয়। এরপর কাঁদতে কাঁদতে বাংলাদেশ ছাড়েন জার্মান তরুণী সুইন্ডে।
উচ্চমাধ্যমিক পাস তরুণ যুবক রাশেদ হোসেন বিকাশ এজেন্টদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করতেন। গত ১০ জুন দুপুর ১২টার দকে টাকা সংগ্রহ করে অফিসে ফেরার পথে ডেমরার বক্সনগর এলাকায় ছিনতাইকারীরা গুলি করে তাঁকে হত্যা করে টাকা ছিনিয়ে নেয়।
মতিঝিল থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়ে বাসে করে গত ১৯ মে মিরপুর যাচ্ছিলেন গোলাম মোস্তফা। বেলা দুইটার দিকে মৎস্য ভবন মোড়ে আসার পর বাসে উঠে তাঁর টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায় চার ডাকাত।
সদরঘাট থেকে বাসে করে গত ২৬ জানুয়ারি ভোরবেলায় ধানমন্ডিতে আসেন হেলেনা বেগম ও তাঁর স্বামী মনিরুল ইসলাম। বাসায় ফেরার পথে মাইক্রোতে থাকা একদল ছিনতাইকারী হেলেনার ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে টান দিলে গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মারা যান তিনি।
গত ছয় বছর পাঁচ মাসে ঢাকা মহানগরীতে ছিনতাই ও ডাকাতির শিকার হয়ে মামলা করেছেন ৬৬৬ জন। এর মধ্যে ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ৫৭০ জন। আর ডাকাতদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ৯৬ জন নাগরিক। প্রথম আলোর অনুসন্ধান এবং ঢাকার ৪৯টি থানার সাধারণ নিবন্ধন খাতার তথ্য পর্যালোচনায় এমন তথ্য মিলেছে।
তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ছিনতাইকারীদের খপ্পরে পড়া অনেকে মামলা করেন না। এ কারণে প্রতিবছর কতজন নাগরিক ঢাকায় ছিনতাই বা ডাকাতির শিকার হচ্ছেন, তার পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না।
ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের সাধারণ নিবন্ধন খাতার তথ্য বলছে, গত ছয় মাসে ঢাকায় ছিনতাই-ডাকাতির শিকার হয়ে ৩৫ জন বিচার চেয়ে মামলা করেছেন। ২০১৭ সালে ৭১ জন, ২০১৬ সালে ১০১, ২০১৫ সালে ১৪৪, ২০১৪ সালে ১৭৭, ২০১৩ সালে ৮২ এবং ২০১২ সালে ৫৬ জন ভুক্তভোগী মামলা করেছেন।
ভুক্তভোগী এবং পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গল, ঢাকায় রাতের থেকে দিনে ছিনতাই-ডাকাতি দলের সদস্যরা বেশি তৎপর থাকে। ভোরবেলা থেকে দুপুরের মধ্যে বেশির ভাগ নাগরিক ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। ছিনতাইকারীরা সংঘবদ্ধ হয়ে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় কাজ করে আসছে। ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে মূলত কাজ করে তারা। ছিনতাইয়ের কাজে বেশির ভাগ ছিনতাইকারী মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাস ব্যবহার করেছে। গোয়েন্দা সংস্থার ভুয়া পরিচয় দিয়ে ছিনতাইকারী ও ডাকাত দলের সদস্যরা নিরীহ সাধারণ মানুষের সর্বস্ব লুট করে নিয়েছে। বাধা দিলে খুন করতে মোটেও পিছপা হয় না ঢাকার সংঘবদ্ধ এসব অপরাধী।
ঢাকার শীর্ষ দুই ছিনতাইপ্রবণ এলাকা
ঢাকা মহানগরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা ওতপেতে আছে ছিনতাইকারী ও ডাকাত দলের সদস্যরা। লুট করে নিচ্ছে নিরীহ মানুষের মোবাইল ফোন, স্বর্ণালংকার, টাকা, মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, কাভার্ড ভ্যানসহ বিভিন্ন দ্রব্য। সংসদ ভবনের সামনে থেকে ফার্মগেট মোড়, কারওয়ান বাজার থেকে শাহবাগ মোড়, মৎস্য ভবন মোড় থেকে পল্টনের ইউবি এল মোড় এবং দৈনিক বাংলার মোড় থেকে মতিঝিল শাপলা চত্বর পর্যন্ত সড়কে প্রায় ছিনতাইকারীদের খপ্পরে পড়ছেন নাগরিকেরা।
ইসকেন্দার হাওলাদার পেশায় সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক। গত ১৪ জানুয়ারি সন্ধ্যার দিকে ফার্মগেট থেকে তিনজন লোক তাঁর অটোরিকশা ভাড়া করেন। সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ পর্যন্ত যাওয়ার পর ছিনতাইকারীরা তাঁকে হত্যা করে তাঁর অটোরিকশা নিয়ে চলে যায়। লাশ ফেলে রেখে যায় সেচ ভবনের সামনের ফুটপাতের নালায়।
ঢাকার আদালতের তথ্য বলছে, ঢাকার মহানগরীর শাহবাগ ও রমনা এলাকায় বেশি ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। গত সাড়ে ছয় বছরে শাহবাগ এলাকায় ছিনতাই ও ডাকাতির শিকার হয়ে ৬৩ জন মামলা করেছেন। রমনা এলাকায় শিকার হয়েছেন ৫৭ জন।
শাহবাগ মোড়টি ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থান। ব্যস্ত এই মোড়ের দক্ষিণাংশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, শহীদ মিনার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ক্যাম্পাস। এ মোড়ের উত্তর পাশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও বারডেম হাসপাতাল।
ভুক্তভোগী ও মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, শাহবাগ মোড়, মৎস্য ভবন মোড়, প্রেসক্লাবের কাছের ইউবিএল মোড়, রেল ভবনের সামনে, হাইকোর্ট মাজারের মোড়, ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে, টিএসসি মোড় ও আশপাশ এলাকা এবং বাংলা একাডেমির সামনের সড়ক শাহবাগ এলাকার সবচেয়ে বেশি ছিনতাইপ্রবণ এলাকা।
মামুন মোল্লা একটি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় প্রতিনিধি। গত ২৮ জানুয়ারি বিকেলে তাঁতীবাজার থেকে প্রতিষ্ঠানের ৪২ লাখ ব্যাগে ভরে রিকশায় করে পল্টনে আসছিলেন। সন্ধ্যার আগে মামুন যখন প্রেসক্লাবের সামনে আসেন, তখন মোটরসাইকেলে করে কয়েকজন যুবক তাঁর রিকশা থামায়। ছিনতাইকারীরা তখন মামুনকে মারধর করে ৪২ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়। চলতি বছরের ৬ মার্চ শাহবাগ থানাধীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছিনতাই, ১৩ মার্চ ট্রপিক্যাল সেন্টারের সামনে মোবাইল ছিনতাই, ১৯ মার্চ মৎস্য ভবন মাড়ে টাকা ছিনতাই, ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের সামনে টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।
শাহবাগ এলাকার পর ঢাকার রমনা এলাকায় ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য বেশি। বাংলামোটর মোড় পার হলেই শেরাটন মোড়। মোড়ের কাছেই রমনা পার্ক। পার্কের উত্তর পাশে প্রধান বিচারপতির বাসভবন, কাকরাইল মসজিদ, মন্ত্রীসহ সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তাদের বাসভবন এবং ঢাকা মহানগর পুলিশের সদর দপ্তর (ডিএমপি)। ডিএমপি ভবনের কাছেই মগবাজার মোড়। মোড়ের কাছে আছে হাতিরঝিল, মৌচাক এলাকা ও মগবাজার এলাকা।
রমনা থানার সাধারণ নিবন্ধন খাতার তথ্য বলছে, রমনা এলাকার দিলু রোড, বড় মগবাজার মোড়, শেরাটন মোড়, নিউ ইস্কাটন রোড, হাতিরঝিল উড়ালসড়কে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটছে।
জহিরুল ইসলাম মৌচাকের একটি ব্যাংক থেকে এক লাখ টাকা তোলেন। গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর বিকেলে রমনার প্রোপার্টি প্লাজার সামনে আসার পর তিন ছিনতাইকারী তাঁকে ধাক্কা দিয়ে মাইক্রোতে তোলে। পরে মারধর করে তাঁকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে টাকা ছিনিয়ে নেয়।
আর আজহারুল ইসলাম ময়মনসিংহের একটি চালকলের ব্যবস্থাপক। গত ১৭ মে ময়মনসিংহ থেকে থেকে ট্রাকে করে চাল নিয়ে রাত দুইটায় যখন হাতিরঝিল উড়ালসড়কে আসেন, তখন ডাকাত দলের সদস্যরা ট্রাক ছিনিয়ে নেয়। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম থেকে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি মাসুদ আলম গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টার দিকে হেঁটে হেঁটে কারওয়ান বাজারে অফিসে আসছিলেন। তিনি যখন রমনা পার্কের রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার উল্টো দিকের রাস্তায় আসেন, তখন তিনজন ছিনতাইকারী ছুরিকাঘাত করে তাঁর দুটি মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়।
রমনা জোনের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার এহসান ফেরদৌস প্রথম আলোকে বলেন, এটা সত্য যে ঢাকার মধ্যে শাহবাগ ও রমনা এলাকায় ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা বেশি ঘটছে। কারণ, এ দুটি এলাকার বেশির ভাগ সড়ক চওড়া। ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। আবার রাত যত গভীর হতে থাকে, ততই রাস্তাগুলো একেবারই জনশূন্য হয়ে পড়ে। এ সময়ে ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কারওয়ান বাজার সার্ক ফোয়ারার পাশে আছে পান্থকুঞ্জ পার্ক। পার্কের ভেতর ভাসমান লোকদের আনাগোনা বেশি। অথচ আলোর ব্যবস্থা নেই পার্কে। রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও ভাসমান লোকের আখড়া। রাতের বেলা সেখানে ভুতুড়ে পরিবেশ থাকে। মাদকসেবীদের আড্ডা বসে সেখানে।
গত ২৭ জুন পান্থকুঞ্জ পার্কে মাদকবিরোধী অভিযানে গিয়ে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ভুতুড়ে এ পার্কে ছিনতাইকারীসহ অন্য অপরাধীদের আড্ডা বসে। রমনা জোনের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার এহসান ফেরদৌসও বলেন, এক মাসের ব্যবধানে পান্থকুঞ্জ পার্ক এলাকায় দুটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে।
ছিনতাইকারীদের হাতে ৩২ খুন
ছয় বছর পাঁচ মাসে ঢাকায় ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হয়েছেন ৩২ জন। এর মধ্যে ঢাকার তেজগাঁও ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় সর্বোচ্চ পাঁচজন নিহত হয়েছেন। আর যাত্রাবাড়ী এলাকায় তিনজন, শাহবাগে তিনজন এবং মিরপুর, ওয়ারী, বাড্ডা ও হাজারীবাগে দুজন করে খুন হন ছিনতাইকারীদের হাতে। এ ছাড়া দক্ষিণখান, বনানী, গুলশান, উত্তরা, ধানমন্ডি, খিলক্ষেত, দারুস সালাম, নিউ মার্কেট, রমনা, মতিঝিল, শাহজাহানপুর, সবুজবাগ ও খিলগাঁও এলাকায় একজন করে ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হন।
শাহ আলম পেশায় কৃষক। থাকেন শরীয়তপুরে। তাঁর দুই ছেলে। বড় ছেলের নাম আলামিন। তার বয়স সাত বছর। আরেক ছেলের নাম আরাফাত। বয়স পাঁচ মাস। বড় ছেলে আলামিন প্রায় অসুস্থ থাকে। তার চিকিৎসা করানোর জন্য ঢাকায় আসেন শাহ আলম–আঁখি দম্পতি। গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর ভোররাত চারটায় লঞ্চে সদরঘাটে আসেন। সেখান থেকে রিকশায় করে যাচ্ছিলেন শনির আখড়ায় এক আত্মীয়ের বাসায়। সকাল ছয়টায় যখন তাঁরা দয়াগঞ্জ মোড় পার হচ্ছিলেন, তখন গুলিস্তান থেকে আসা পিকআপ থেকে অজ্ঞাত ছিনতাইকারীরা আঁখির ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে টান মারে। তখন আঁখির কোলে থাকা ছোট্ট শিশু আরাফাত রাস্তায় পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায়।
আরাফাতের বাবা শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ছিনতাইকারী তাঁর জীবনের সব সুখ কেড়ে নিয়েছে সেদিন। দুধের শিশু তার হাত থেকে রক্ষা পায়নি।
ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র খন্দকার আবু তালহা। ২০১৭ সালের ৮ অক্টোবর ভোরে গোপীবাগ এলাকায় ছিনতাইকারীরা হত্যা করে তালহাকে। তালহার বাবা আবু রিয়াজ মোহাম্মদ নূর উদ্দিন খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছিনতাইকারীদের হাতে আমার সাহসী মেধাবী ছেলের মৃত্যু কোনোভাবে মেনে নিতে পারি না।’
আবদুর রশিদের ঢাকার পান্থপথে মুরগির দোকান আছে। ১৮ বছর বয়সী তাঁর ছেলে সজীব ২০১৭ সালের ২২ জুন দিবাগত রাত তিনটার দিকে পান্থপথ থেকে রিকশায় করে গুলিস্তানে যাচ্ছিলেন। সজীব যখন হাইকোর্টের সামনে পূর্ত ভবনের সামনে আসেন, তখন মাইক্রোবাসে এসে তিন ছিনতাইকারী তাঁর আট হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। সজীব মাইক্রোবাসে ঝুলে পড়লে ছিনতাইকারীদের ধাক্কায় রাস্তায় পড়ে নিহত হন।
ছিনতাইকারীদের বড় টার্গেট কে?
মাহবুব বাড্ডার রুটস নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ বাড্ডা এলাকা থেকে টাকা সংগ্রহ করে দুপুরে যখন উত্তর বাড্ডার মহিলা কমিশনার গলির সামনে আসেন, তখন অজ্ঞাত ছিনতাইকারীরা মোটরসাইকেলে করে এসে গুলি করে টাকা ছিনিয়ে নেয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক আরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ছিনতাইকারীদের আলাদা দল আছে। আছে নিজস্ব সোর্সও। ছিনতাই বা ডাকাতি করার আগে তথ্য সংগ্রহ করে পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ছিনতাই বা ডাকাতির ঘটনা ঘটায়। ছিনতাইয়ের কাজে মোটরসাইকেল ব্যবহার করে থাকে।
৫৩ বছর বয়সী ইফতেখার মাহমুদ উত্তরা এলাকার একটি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। গত ১ ফেব্রুয়ারি এজেন্টদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে যখন উত্তরা পশ্চিম থানার ৫ নম্বর সেক্টরের ১/এ রোডে আসেন, তখন গুলি করে হত্যা করে আট লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা।
অফিস-বাসায় ঢুকে ছিনতাই-ডাকাতি
আমেনা খাতুন গৃহিণী। ঢাকার তেজগাঁও পশ্চিম নাখালপাড়ার একটি ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। তাঁর ছেলে বাবু আহম্মেদ বিদেশে থাকেন। গত ৮ মার্চ দুপুরে অজ্ঞাত এক লোক বাসা দেখার কথা বলে ফ্ল্যাটে আসেন। বাসা দেখানোর সময় ফ্ল্যাট দেখতে আসা ওই দুর্বৃত্ত বৃদ্ধ আমেনাকে খুন করে তাঁর হাতের বালা, সোনার চেইন খুলে নিয়ে যায়।
ওমর ফারুক দারুস সালাম এলাকার একটি বাসয় নিরাপত্তারক্ষীর দায়িত্বে ছিলেন। গত ৯ মার্চ বাসার নিচে গ্যারেজে ঢুকে ছিনতাইকারী ফারুককে হত্যা করে মোটরসাইকেল ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির উপপরিদর্শক রফিকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগেই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে শিগগিরই।
গাড়ি ছিনতাই
ঢাকায় টাকা, স্বর্ণালংকার ছিনতাই করার পাশাপাশি গাড়ি ছিনতাইয়ের ঘটনা অনেক বেশি ঘটেছে। মানিকনগর এলাকা থেকে আশিক হাওলাদার মোটরসাইকেলে করে গুলশানে আসছিলেন। তিনি যখন খিলগাঁও খিদমাহ হাসপাতালের সামনে আসেন, তখন মোটরসাইকেল করে আসা দুজন ছিনতাইকারী আশিকের মোটরসাইকেলটি ছিনিয়ে নেয়। এসিআই কোম্পানির নিরাপত্তারক্ষীর দায়িত্বে আছেন সহিদ উল্লাহ। ওষুধের কাঁচামাল নিয়ে কাভার্ড ভ্যানে করে নারায়ণগঞ্জে যাচ্ছিলেন। গাড়িটি যখন রায়েরবাগ এলাকায় আসে, তখন মাইক্রোবাসে করে আসা ভুয়া ডিবির সদস্য পরিচয় দিয়ে ছিনতাইকারীরা ৬৫ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
চালক রনি শেখ গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ভোরে ডিম নিয়ে মিনিট্রাকে করে নারায়ণগঞ্জে যাচ্ছিলেন। গাড়িটি যখন ওয়ারীর হানিফ উড়ালসড়কের ওপর আসে, তখন আরেকটি পিকআপে করে এসে ছিনতাইকারীরা মিনিট্রাক ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়।
হারুন গত বছরের ২৮ মার্চ পিকআপে করে বালু নিয়ে শাহ আলীর দিয়াবাড়ির পৌঁছালে ছিনতাইকারীরা মারধর করে তাঁর গাড়িটি ছিনিয়ে নেয়।
ইব্রাহীম খলিল পেশায় সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি গুলশানে যাওয়ার পথে তিনি যখন তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার বিটাক অফিসে আসেন, তখন হত্যার হুমকি তাঁর অটোরিকশাটি কেড়ে নেয় দুর্বৃত্তরা।
ভুয়া পরিচয়ে ছিনতাই
ঢাকায় ভুয়া পরিচয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। ছিনতাই ও ডাকাত দলের সদস্যরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুয়া ডিবি পুলিশের পরিচয় দিয়ে অপরাধ করছে।
সাইফুল ইসলাম ব্যবসায়িক কাজে চট্টগ্রাম থেকে গত ১৮ মে ঢাকায় আসেন। সেদিন সকালে পল্টন থেকে রিকশায় করে তিনি যখন কলাবাগানের বক্স কালভার্ট এলাকায় আসেন, তখন ডিবি পুলিশের পরিচয় দিয়ে তাঁর কাছে থাকা ব্যাগভর্তি পাঁচ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়।
রিকশায় সাবধান
ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, রিকশায় চলাচলকারীরা ঢাকায় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ছেন।
ব্যবসায়ী বিধান চন্দ্র ও তাঁর বন্ধু বিধু মিত্র গত ১৯ ফেব্রুয়ারি দুপুরে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার থেকে রিকশায় করে যাত্রাবাড়ী যাচ্ছিলেন। রিকশাটি যখন ইসলামপুরের কুঞ্জ বাবু লেনে আসে, তখন অজ্ঞাত ১০ থেকে ১৫ জন ডাকাত এই দুজনকে হত্যার হুমকি দেখিয়ে তাঁদের কাছে থাকা ৩৭ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়।
আবদুর সামাদ গত বছরের ১০ জানুয়ারি রিকশায় করে ধানমন্ডির ১০ নম্বর রোড দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন মোটরসাইকেলে আসা দুই যুবক হত্যার হুমকি দেখিয়ে ব্যাগভর্তি পাঁচ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়।
ঢাকার যে সড়কে বড় ভয়
ঢাকার ব্যস্ততম স্থান গুলিস্তান। শনির আখড়া থেকে আসা উড়ালসড়ক শেষ হয়েছে গুলিস্তানে এসে। এর পাশেই কাপ্তান বাজার। গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ড থেকে বঙ্গভবনের পাশ দিয়ে একটি সড়ক (টয়েনবী সার্কুলার রোড) গিয়ে মিশেছে হাটখোলা রোডে। হাটখোলা মোড় থেকে একটি সড়ক গেছে গোপীবাগের দিকে। আরেকটি সড়ক গিয়ে মিশেছে দয়াগঞ্জ সড়কে। টিকাটুলি মোড় থেকে আরেকটি সংযোগ সড়ক মিশেছে সায়েদাবাদে।
ওয়ারী থানার সাধারণ নিবন্ধন খাতার তথ্য বলছে, ওয়ারীর টয়েনবী সার্কুলার রোডে গত ২ এপ্রিল ছিনতাইকারীদের হাতে একজন খুন হন। গত বছর অক্টোবরে টিকাটুলিতে মোবাইল ছিনতাই, ২০১৬ সালের ২৯ জুন টয়েনবী সার্কুলার রোডে ৫০০ বস্তা চালভর্তি ট্রাক ছিনতাই এবং ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারি মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আদালতের কাজ শেষে বিকেলে রিকশায় করে বঙ্গভবনের পাশের টয়েনবী সার্কুলার রোড দিয়ে বাসায় ফিরছিলেন। হঠাৎ করে তিনজন ছিনতাইকারী তাঁকে পিস্তল দেখিয়ে হত্যার হুমকি দেখিয়ে টাকা ছিনতাই করে। এ ঘটনায় তিনি আর মামলা করেননি।
রেললাইন আর ভাসমান লোক
পুলিশ ও ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পুরান ঢাকার দয়াগঞ্জ মোড় খুব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেল, দয়াগঞ্জ মোড়ের কাছে ঘুন্টিঘর বস্তি। বস্তির সামনে দিয়ে গেছে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেললাইন। বস্তির সামনের একাধিক দোকানদার বলেন, দয়াগঞ্জ দিনেও ছিনতাই হয়।
ওয়ারীর গোপীবাগ এলাকায় প্রায় ছিনতাইকারীর কবলে পড়ছেন নিরীহ মানুষ। স্থানীয় ব্যক্তিদের অভিযোগ, গোপীবাগের কাছের রেললাইনে প্রকাশ্যে মাদক কেনাবেচা হয়। এ ছাড়া মালিবাগ মোড়, মগবাজার মোড়, কারওয়ান বাজার ও মহাখালী রেলক্রসিংয়ের আশপাশে ছিনতাই সংঘটিত হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মাসুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ছিনতাই প্রতিরোধে ঢাকা মহানগর পুলিশ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। রাস্তায় ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসিটিভি) বসানো হচ্ছে, চেকপোস্ট থাকে, পেট্রল টিম কাজ করে, ব্লক রেইড এবং মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা হচ্ছে।
ঢাকার কোথায় ছিনতাই-ডাকাতি বেশি
ঢাকার ৪৯টি থানার সাধারণ নিবন্ধন খাতার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেল, গত সাড়ে ছয় বছরে ঢাকার ২০টি অঞ্চলে ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা অন্যান্য এলাকা থেকে বেশি ঘটেছে। ঢাকার শাহবাগ ও রমনা থানা এলাকার পর যাত্রাবাড়ীতে ৩৮টি ও উত্তরা এলাকায় ৩৫টি করে ছিনতাই ও ডাকাতি সংঘটিত হয়েছে।
এরপর পল্টন ও মতিঝিলে ৩৪টি, ধানমন্ডি ও খিলগাঁও ৩২টি, শেরেবাংলা নগরে ২৯টি, বনানীতে ২৬টি, ওয়ারীতে ২৩টি, রামপুরা ও সবুজবাগে ২১টি এবং গুলশান, হাজারীবাগ ও মোহাম্মদপুরে ১৮টি করে, খিলক্ষেতে ১৭টি ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া মিরপুর ও কদমতলীতে ১৪টি করে এবং কলাবাগানে ১৩টি ছিনতাই সংঘটিত হয়েছে।