ঢাকা ০৮:৩৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সিইসির বক্তব্যে দ্বিমত চার কমিশনারের

Reporter Name

জাতীয় নির্বাচনে কোনো অনিয়ম হবে না, এমন নিশ্চয়তা দেওয়ার সুযোগ নেই—এ বক্তব্য দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা। তাঁর এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন অন্য চার নির্বাচন কমিশনার। সিইসিকে সংযত হয়ে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আর বিএনপি বলেছে, সিইসি সত্য কথা বলে দিয়েছেন।

নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে সিইসির এমন বক্তব্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নানা অনিয়মের মুখে নির্বাচন কমিশন (ইসি) নীরব ছিল। এ অবস্থায় সিইসির এ ধরনের বক্তব্য সাধারণ মানুষের মধ্যে আরও আস্থাহীনতা তৈরি করবে। তবে অনেকে মনে করছেন, সিইসির বক্তব্যে ইসির অসহায়ত্ব ও বাস্তবতা প্রকাশ পেয়েছে।

সিইসি নুরুল হুদা গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, জাতীয় নির্বাচনে কোথাও কোনো অনিয়ম হবে না—এমন নিশ্চয়তা দেওয়ার সুযোগ তাঁর নেই। ইসি সূত্র জানায়, সিইসির এ বক্তব্যের পর খোদ নির্বাচন কমিশনে অস্বস্তি তৈরি হয়। তাঁর সহকর্মী চার নির্বাচন কমিশনারই প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা সিইসির এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। এটা ইসির অবস্থানও নয়।

সিইসির বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় গতকাল বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘সিইসি একটি স্পর্শকাতর বিষয় উত্থাপন করেছেন। উনি বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনে অনিয়ম হবে না, এমন নিশ্চয়তা নেই। জানি না সিইসি কেন, কোন প্রেক্ষাপটে কথাটা বলেছেন। এটা তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত হতে পারে। আমি এ কথার সঙ্গে মোটেই একমত নই। আগামী জাতীয় নির্বাচনে যারা অনিয়ম করতে চায়, তারা এ ধরনের কথায় উৎসাহিত হতে পারে বলে আমি আশঙ্কা করি।’

নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সিইসির এ বক্তব্যের সঙ্গে কমিশনের কোনো সম্পর্ক নেই। নির্বাচন কমিশনার হিসেবে তাঁরা রাগ-অনুরাগ-বিরাগমুক্ত থেকে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করার শপথ নিয়েছেন। একটা যথাযথ নির্বাচন করতে তাঁরা সবকিছুই করবেন।

নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম বলেন, কমিশনে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। সিইসি কেন এমন মন্তব্য করেছেন তিনি জানেন না, তবে এটি সিইসির নিজস্ব মত।

আরেক নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরীও বলেছেন, সিইসির এ বক্তব্য কোনো অবস্থাতেই কমিশনের বক্তব্য নয়। কারণ তাঁরা একটি সুন্দর, সুষ্ঠু নির্বাচন করার শপথ নিয়েছেন।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ও এরপর বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কেন্দ্র দখলসহ নানা অনিয়মের কারণে নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। নুরুল হুদার নেতৃত্বে বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর সম্প্রতি যে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়, সেগুলোতে নানা অনিয়মের অভিযোগ আছে। অনেক ক্ষেত্রে ইসির চেয়ে বড় ভূমিকায় ছিল পুলিশ। এ অবস্থায় জাতীয় নির্বাচনের আগে সিইসির বক্তব্য সরকারেও অস্বস্তি তৈরি করেছে।

এ বিষয়ে গতকাল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, সিইসি রাষ্ট্রীয় একটি প্রতিষ্ঠানের মূল দায়িত্বে আছেন। বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁকে আরও সংযত হওয়া দরকার। ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আশা করি তিনি ভবিষ্যতে এ ধরনের বক্তব্য দেবেন না।’

বিএনপি মনে করে, বর্তমান সরকারের অধীনে যে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়, সিইসির বক্তব্যে তা ফুটে উঠেছে। এতে করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আরও জোরালো হলো। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সিইসি প্রকৃত অবস্থাটা বলে দিয়েছেন। যাঁরা তাঁর সঙ্গে দ্বিমত করছেন, তাঁরা সরকারের হয়ে কথা বলছেন। মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সিইসিকে সংযত হয়ে কথা বলতে বলেছেন। এতেই বোঝা যায় অবস্থা কী!’

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করা ইসির সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু এখন পর্যন্ত নির্বাচন সুষ্ঠু করার কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে গা ছাড়া ভাব দেখা গেছে। সিইসি যদি মনে করেন, নির্বাচনে অনিয়ম হবে না, এ নিশ্চয়তা দেওয়া যাবে না, তাহলে নৈতিকভাবে তাঁর পদে থাকা ঠিক হবে না।

About Author Information
আপডেট সময় : ০৩:১১:৩৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১০ অগাস্ট ২০১৮
৪১১ Time View

সিইসির বক্তব্যে দ্বিমত চার কমিশনারের

আপডেট সময় : ০৩:১১:৩৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১০ অগাস্ট ২০১৮

জাতীয় নির্বাচনে কোনো অনিয়ম হবে না, এমন নিশ্চয়তা দেওয়ার সুযোগ নেই—এ বক্তব্য দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা। তাঁর এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন অন্য চার নির্বাচন কমিশনার। সিইসিকে সংযত হয়ে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আর বিএনপি বলেছে, সিইসি সত্য কথা বলে দিয়েছেন।

নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে সিইসির এমন বক্তব্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নানা অনিয়মের মুখে নির্বাচন কমিশন (ইসি) নীরব ছিল। এ অবস্থায় সিইসির এ ধরনের বক্তব্য সাধারণ মানুষের মধ্যে আরও আস্থাহীনতা তৈরি করবে। তবে অনেকে মনে করছেন, সিইসির বক্তব্যে ইসির অসহায়ত্ব ও বাস্তবতা প্রকাশ পেয়েছে।

সিইসি নুরুল হুদা গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, জাতীয় নির্বাচনে কোথাও কোনো অনিয়ম হবে না—এমন নিশ্চয়তা দেওয়ার সুযোগ তাঁর নেই। ইসি সূত্র জানায়, সিইসির এ বক্তব্যের পর খোদ নির্বাচন কমিশনে অস্বস্তি তৈরি হয়। তাঁর সহকর্মী চার নির্বাচন কমিশনারই প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা সিইসির এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। এটা ইসির অবস্থানও নয়।

সিইসির বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় গতকাল বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘সিইসি একটি স্পর্শকাতর বিষয় উত্থাপন করেছেন। উনি বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনে অনিয়ম হবে না, এমন নিশ্চয়তা নেই। জানি না সিইসি কেন, কোন প্রেক্ষাপটে কথাটা বলেছেন। এটা তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত হতে পারে। আমি এ কথার সঙ্গে মোটেই একমত নই। আগামী জাতীয় নির্বাচনে যারা অনিয়ম করতে চায়, তারা এ ধরনের কথায় উৎসাহিত হতে পারে বলে আমি আশঙ্কা করি।’

নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সিইসির এ বক্তব্যের সঙ্গে কমিশনের কোনো সম্পর্ক নেই। নির্বাচন কমিশনার হিসেবে তাঁরা রাগ-অনুরাগ-বিরাগমুক্ত থেকে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করার শপথ নিয়েছেন। একটা যথাযথ নির্বাচন করতে তাঁরা সবকিছুই করবেন।

নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম বলেন, কমিশনে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। সিইসি কেন এমন মন্তব্য করেছেন তিনি জানেন না, তবে এটি সিইসির নিজস্ব মত।

আরেক নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরীও বলেছেন, সিইসির এ বক্তব্য কোনো অবস্থাতেই কমিশনের বক্তব্য নয়। কারণ তাঁরা একটি সুন্দর, সুষ্ঠু নির্বাচন করার শপথ নিয়েছেন।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ও এরপর বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কেন্দ্র দখলসহ নানা অনিয়মের কারণে নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। নুরুল হুদার নেতৃত্বে বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর সম্প্রতি যে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়, সেগুলোতে নানা অনিয়মের অভিযোগ আছে। অনেক ক্ষেত্রে ইসির চেয়ে বড় ভূমিকায় ছিল পুলিশ। এ অবস্থায় জাতীয় নির্বাচনের আগে সিইসির বক্তব্য সরকারেও অস্বস্তি তৈরি করেছে।

এ বিষয়ে গতকাল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, সিইসি রাষ্ট্রীয় একটি প্রতিষ্ঠানের মূল দায়িত্বে আছেন। বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁকে আরও সংযত হওয়া দরকার। ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আশা করি তিনি ভবিষ্যতে এ ধরনের বক্তব্য দেবেন না।’

বিএনপি মনে করে, বর্তমান সরকারের অধীনে যে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়, সিইসির বক্তব্যে তা ফুটে উঠেছে। এতে করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আরও জোরালো হলো। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সিইসি প্রকৃত অবস্থাটা বলে দিয়েছেন। যাঁরা তাঁর সঙ্গে দ্বিমত করছেন, তাঁরা সরকারের হয়ে কথা বলছেন। মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সিইসিকে সংযত হয়ে কথা বলতে বলেছেন। এতেই বোঝা যায় অবস্থা কী!’

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করা ইসির সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু এখন পর্যন্ত নির্বাচন সুষ্ঠু করার কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে গা ছাড়া ভাব দেখা গেছে। সিইসি যদি মনে করেন, নির্বাচনে অনিয়ম হবে না, এ নিশ্চয়তা দেওয়া যাবে না, তাহলে নৈতিকভাবে তাঁর পদে থাকা ঠিক হবে না।