সিলেটে দুই দলের কৌশল-পাল্টা কৌশল
সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটার টানতে মরিয়া প্রার্থীরা। ভোটারদের মন জয় করতে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন তাঁরা। নানা কৌশল নিচ্ছেন ভোটের মাঠে নিজেদের এগিয়ে রাখতে। এর আড়ালে প্রধান দুই দলের মেয়র প্রার্থীর মধ্যে চলছে কৌশলের খেলা। নির্বাচনের মাঠে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করতে চলছে কৌশল আর পাল্টা কৌশলের যুদ্ধ।
সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদরউদ্দীন আহমদ কামরান। কাউন্সিলর, পৌরসভার মেয়র ও সিটি মেয়র হয়ে তিনি ১৮ বছর পৌর প্রশাসনে ছিলেন। আর বিএনপির মনোনীত প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী সদ্য সাবেক মেয়র। দুজনেরই দলীয় ভোটের পাশাপাশি ব্যক্তিগত ভোট ব্যাংক রয়েছে। দলীয় গণ্ডির বাইরের ভোটারদের আকর্ষণ করতে ইতিমধ্যেই তাঁরা নানা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সংখ্যালঘু ভোট, জোটের ভোট, আঞ্চলিক ভোট টানার উদ্যোগ শহরে দৃশ্যমান।
সিলেটের নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক মহলের মতে, ভোট টানার বাইরেও ভোটের মাঠে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করার জন্য প্রধান দুই দলের মেয়র প্রার্থীরা কৌশলী ভূমিকা নেওয়ার চেষ্টা করছেন। একজন কৌশলে অন্যজনকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছেন। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি দলের প্রার্থী প্রশাসনকে ব্যবহার করছেন। পুলিশের ভূমিকা নিয়েও ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে।
সিলেটের নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে স্থানীয় জনসাধারণের মনে সব সময়ই একটি ইতিবাচক ধারণা ছিল। আবার আশঙ্কাও ছিল খুলনা বা গাজীপুরের মতো অবস্থা হয় কি না। নির্বাচনী প্রচার শুরুর দিকে ১১ জুলাই রাত সাড়ে ১২টার দিকে পুলিশ শ্রমিকদলের এক কর্মীকে আটক করে। আরিফুল হক চৌধুরী আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, পরোয়ানা বা মামলা ছাড়া কোনো নেতা-কর্মীকে পুলিশ আটক করলে ঘটনাস্থলে তাৎক্ষণিক অবস্থান নেওয়া হবে। সে অনুসারে তিনি মাঠে নামেন। শ্রমিকদলের কর্মীকে আটকের ঘটনায় তাৎক্ষণিক টানা ৪০ মিনিট ঘটনাস্থলে অবস্থান করে ওই কর্মীকে ছাড়িয়ে নেন তিনি।
পরে ওই ঘটনায় পুলিশ একটি মামলা করে। ওই মামলায় বিএনপির ৪৩ জন কর্মী ও অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করা হয়। ওই মামলাসহ আরেক মামলায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়। এর বিরুদ্ধে পাল্টা কৌশলে যায় বিএনপি। উচ্চ আদালতে গিয়ে আগাম জামিন নেন বিএনপির ৫০ নেতা-কর্মী।
এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাড়ি গিয়ে পুলিশ তল্লাশি ও হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব আবদুর রাজ্জাকের ছেলে রুমন রাজ্জাককে গ্রেপ্তার করা হয়। রুমন কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না বলে তাঁর পরিবারের সদস্যরা বলছেন। আবদুর রাজ্জাককে খুঁজতে গিয়ে তাঁকে না পেয়ে রুমনকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে পরিবার ও বিএনপির অভিযোগ। অন্যদিকে আরিফুল হক চৌধুরীর ঘনিষ্ঠজন অ্যাসিড-সন্ত্রাস নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদ জুরেজ আবদুল্লাহ গুলজারকেও গত সোমবার গ্রেপ্তার করা হয়। আরিফুল হকের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন জুরেজ।
এসব গ্রেপ্তারের বিষয়ে পুলিশ বলছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। নির্বাচনী কারণে কাউকেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না।
গত শনিবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে দুর্বৃত্তরা বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের গাজী বুরহান উদ্দিন-গরম দেওয়ান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে একটি ছোট কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনের শিখা দেখে স্থানীয় লোকজন ছুটে আসেন। তবে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার আগেই কার্যালয়ে থাকা নির্বাচনী ব্যানার, পোস্টার, লিফলেট প্রভৃতি পুড়ে যায়। এ ঘটনায়ও মামলা হয়েছে। আগুনের ঘটনায় বিএনপি জড়িত বলে অভিযোগ করেছিলেন কামরান। আর বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী বিষয়টি অস্বীকার করেন।
বদরউদ্দীন আহমদ কামরান বলেন, সিলেটে নৌকার পক্ষে গণজোয়ার দেখে বিএনপি স্তম্ভিত। তাদের পক্ষে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কার্যালয় জ্বালিয়ে দেওয়া কঠিন কিছু নয়। আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, এই ধরনের কোনো নোংরামির সঙ্গে তাঁরা জড়িত নন। বিএনপির কোনো নেতা-কর্মী এ ঘটনা ঘটাননি।
বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিছু বিষয় নিয়ে তাঁরা শঙ্কিত। তাঁদের মতে, বিএনপির মেয়র প্রার্থীর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে ভোটাররা তাঁর দিকেই ঝুঁকে আছেন। তাই সরকারি দলের প্রার্থী তাঁদের চাপে ফেলার জন্য নানা কৌশল নিচ্ছেন। সরকারি দলের প্রার্থী বদরউদ্দীন আহমদের নির্বাচনী ক্যাম্পে আগুনের ঘটনা তাদেরই অপকৌশল বলে মনে করে বিএনপি। তাঁদের আশঙ্কা, সরকারি দলের পক্ষ থেকে অন্য কোনো বড় অঘটন বা অপঘাতের ঘটনা ঘটিয়ে বিএনপির ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা হতে পারে। সে কারণে তাঁরা বিষয়টি মানুষের সামনে আনতে চান।
এদিকে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও আশঙ্কা রয়েছে বিএনপির নেতা-কর্মীদের। তাঁরা বলছেন, অনেক নেতা-কর্মীই এখন ঘরে থাকতে পারছেন না। যাঁরাই বিএনপির গণসংযোগে যাচ্ছেন, তাঁদেরই হয়রানি করা হচ্ছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি করা হচ্ছে। ভোট থেকে দূরে থাকতে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
ভোটের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের আত্মবিশ্বাস যেন বাড়ছে। আর বিএনপি নেতা-কর্মীদের আশঙ্কা প্রকট হচ্ছে। সরকারি দলের প্রার্থীর কর্মীরা ভোটের দিন নিজদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অন্যদিকে ভোটের দিন কেন্দ্রে যেতে পারবেন কি না, সে আশঙ্কার দোলাচলে রয়েছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা।
সিলেট নির্বাচনে খুলনা বা গাজীপুরের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয় কি না, তা নিয়েও বিএনপির মধ্যে আশঙ্কা রয়েছে। বিএনপি সূত্র বলছে, এটা নিয়ে তাঁরা সচেতন। তাই এ বিষয়ে পরিকল্পনা নিয়ে রেখেছেন তাঁরা। প্রতিটি কেন্দ্রের এজেন্ট তালিকায় একাধিক নাম রাখা হয়েছে। একজন ব্যর্থ হলে যাতে অন্যজন কেন্দ্রে থাকতে পারেন, সেই চেষ্টা বিএনপির কৌশলে রয়েছে। জানা গেছে, দলীয় পরিচয়ের বাইরেও প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যদের এজেন্ট তালিকায় রাখছে বিএনপি।
বিএনপির মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘যত কৌশলই নেওয়া হোক না কেন, প্রশাসনযন্ত্র যদি কারও পক্ষে কাজ করে তাহলে মাঠে থাকা কঠিন। পরিস্থিতি দেখে শঙ্কা হয়, তারপরও আমরা মাঠ ছাড়ব না। নির্বাচনে যত কৌশলই নেওয়া প্রয়োজন আমরা নেব।’
মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব আসাদ উদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের একটাই কৌশল হলো জনগণের কাছে যাওয়া। আমরা কোনো অপকৌশল নেব না। আর লক্ষ্য হলো কোনো উসকানির ফাঁদে পা না দেওয়া।’
রাজনৈতিক কৌশলের ক্ষেত্রেও বিএনপি আওয়ামী লীগ দুই পক্ষই সমানতালে কাজ করছে। বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থীকে ইতিমধ্যে ‘উচ্চ পর্যায়ের চাপে’ বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। জোটের শরিক দল জামায়াতের প্রার্থী এহসান মাহমুদ জুবায়ের মাঠে থাকলেও বিএনপির একটি বড় অংশ মনে করে, জামায়াত তাদের সঙ্গে না থাকায় ভালো হয়েছে। জামায়াত তাদের সঙ্গে থাকলে বিশালসংখ্যক সংখ্যালঘু ভোট তাদের হাতছাড়া হতে পারত।
আওয়ামী লীগ তাদের দলীয় কোন্দল-বিভেদ দূর করে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে রয়েছে। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে সামনে নিয়ে এসে সিলেটের উন্নয়নে কাজ করার ঘোষণা দিচ্ছে।