বাংলাদেশে নারীদের ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপতথ্য ছড়ানোর হার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নারী নেতাকর্মী। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে ২৫ জন নারী নেত্রীকে নিয়ে ২৩৭টি অপতথ্য ছড়ানোর প্রমাণ মিলেছে। তারা দেশের সাতটি রাজনৈতিক দল ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী।
গুজব বা ভুয়া তথ্য ছড়ানো সাইবার অপরাধীদের বেশি টার্গেট ছিল ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এনসিপির নেত্রী ডা. তাসনিম জারা ও বিএনপি নেত্রী রুমিন ফারহানা। এছাড়া উপদেষ্টাদের মধ্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে নিয়েও অপতথ্য ছড়ানোর হার বেশি।
ফ্যাক্ট চেকিং বা তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানারের প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বুধবার (৮ অক্টোবর) রিউমর স্ক্যানার এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারী নেত্রীদের নাম বা ছবি ব্যবহার করে ভুয়া বক্তব্য, সম্পাদিত ভিডিও বা এআই কনটেন্ট ছড়ানো হচ্ছে, যা তাদের সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি করছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের নামেও এসব তথ্য প্রচার করে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছেন সাইবার অপরাধীরা। ফলে নারীদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে এবং গণপরিসরে তাদের অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে।
হাসিনাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি অপতথ্য, ৮৮ শতাংশই ইতিবাচক
রিউমর স্ক্যানারের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ৯ মাসে দেশের অন্তত সাতটি রাজনৈতিক দল ও অঙ্গসংগঠনের ২৫ নারী নেতাকর্মীকে জড়িয়ে অন্তত ২৩৭টি অপতথ্য ছড়ানো হয়েছে। এরমধ্যে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট নারীদের জড়িয়ে সবচেয়ে বেশি ১৮৮টি অপতথ্য ছড়ানো হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি গুজব ছড়ানো হয়েছে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে। ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয়ে থাকা শেখ হাসিনাকে জড়িয়েই ১৪৮টি অপতথ্য ছড়ানো হয়।
অপতথ্যগুলোর ধরন বুঝতে এগুলোকে রিউমর স্ক্যানার দুটি আলাদা ভাগে ভাগ করেছে। শেখ হাসিনার পক্ষে যায় এমন অপতথ্যের প্রচারকে ইতিবাচক এবং বিপক্ষে যায় এমন অপতথ্যের প্রচারকে নেতিবাচক হিসেবে ধরে নিয়ে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, এসব অপতথ্যের প্রায় ৮৮ শতাংশ ক্ষেত্রেই শেখ হাসিনাকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এসব অপতথ্যের অধিকাংশই (২৯ শতাংশ) পুরোনো ভিডিও কেন্দ্রিক, যেগুলোকে চলতি বছরের ঘটনা দাবিতে প্রচার করতে দেখা গেছে।
শেখ হাসিনাকে ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। এরই প্রেক্ষিতে তাকে ভারতের বিভিন্ন স্থানে দেখা যাচ্ছে বা তিনি দেশে ফিরেছেন দাবিতে বিভিন্ন সময়ের পুরোনো ভিডিও রীতিমতো ক্যাম্পেইন আকারে চালানো হয়েছে। এর ফলে তার নামের পাশে অপতথ্যের সংখ্যাও বেড়েছে। শেখ হাসিনা ছাড়াও তার পরিবারের আরও তিন নারী সদস্যকে (মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, বোন শেখ রেহানা, বোনের মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক) জড়িয়ে আরও ২১টি অপতথ্যের প্রচার ছিল বিগত ৯ মাসে।
এছাড়া দলটির নেত্রী ডা. দীপু মনিকে জড়িয়ে একটি, মমতাজ বেগমকে নিয়ে চারটি, সেলিনা হায়াৎ আইভীকে নিয়ে তিনটি এবং জান্নাত আরা হেনরীকে নিয়ে একটি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। কোনো নাম উল্লেখ ছাড়া শুধু দলটির নারী নেতাকর্মী পরিচয়ে আরও অন্তত ১০টি অপতথ্য খুঁজে পাওয়া গেছে।
এনসিপির ৭ নেত্রীকে ঘিরে ৩২ ভুয়া তথ্য, বেশি তাসনিম জারার
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে দেশের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটির নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে একাধিক নারী সদস্য আছেন। জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়ার সুবাদে গত বছর থেকেই এ নারীরা কম-বেশি আলোচনায় ছিলেন। রাজনীতিতে নাম লেখানোর পর তাদের জড়িয়ে নিয়মিতই অপতথ্যের প্রচার লক্ষ্য করেছে রিউমর স্ক্যানার।
জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে এনসিপি ও তার অঙ্গসংগঠনের সাত নারী নেত্রীকে জড়িয়ে অন্তত ৩২টি অপতথ্য শনাক্ত হয়েছে। এরমধ্যে দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারাকে জড়িয়েই প্রচার হয়েছে ১৯টি অপতথ্য। এসব অপতথ্যের আটটিতে আপত্তিকর এবং যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ দৃশ্যের প্রচার ছিল।
এছাড়া নুসরাত তাবাসসুমকে জড়িয়ে ছয়টি, সামান্তা শারমিনকে জড়িয়ে তিনটি এবং হুমায়রা নুর, তাজনূভা জাবীন, অর্পিতা শ্যামা দেব ও শ্যামলী সুলতানা জেদনীকে জড়িয়ে একটি করে অপতথ্য শনাক্ত হয়েছে। কোনো নাম উল্লেখ ছাড়া শুধু এনসিপির নারী নেতাকর্মী পরিচয়ে আরও অন্তত দুটি অপতথ্য খুঁজে পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার।
বিএনপিতে রুমিন ফারহানাকে নিয়ে বেশি অপতথ্য
বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের অন্তত আট জন নারী নেতাকর্মীকে জড়িয়ে গত ৯ মাসে অন্তত ২৩টি অপতথ্য শনাক্ত হয়েছে। এরমধ্যে দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক রুমিন ফারহানাকে জড়িয়ে প্রচার হয়েছে এমন অপতথ্য শনাক্ত হয়েছে ৯টি। এ অপতথ্যগুলোর ক্ষেত্রে ভুয়া মন্তব্য, এআই দিয়ে তৈরি ভুয়া ছবি যেমন ছিল; তেমনই ছিল পুরোনো ভিডিও ব্যবহার করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা।
রুমিন ফারহানা ছাড়াও বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে আটটি, জাইমা রহমান, ডা. জুবাইদা রহমান, নিপুণ রায় চৌধুরী এবং মানসুরা আলমকে জড়িয়ে চলতি বছর একটি করে অপতথ্যের প্রচার দেখা গেছে। কোনো নাম উল্লেখ ছাড়া শুধু বিএনপির নারী নেতাকর্মী পরিচয়ে আরও অন্তত দুটি অপতথ্য খুঁজে পাওয়া গেছে।
এছাড়া অন্য চারটি দলের মধ্যে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) নেত্রী লাকী আক্তারকে জড়িয়ে দুইটি, ইনকিলাব মঞ্চের ফাতিমা তাসনিম জুমাকে জড়িয়ে দুইটি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট নেত্রী সোহাগী সামিয়াকে জড়িয়ে একটি ও গণঅধিকার পরিষদ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের কথিত মহিলা সম্পাদিকা তন্নির পরিচয় দিয়ে ছড়ানো একটি অপতথ্য শনাক্ত হয়েছে।
উপদেষ্টাদের মধ্যে রিজওয়ানা হাসানকে নিয়ে বেশি গুজব
রাজনীতির মাঠের বাইরে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের দুইজন নারী উপদেষ্টাকে জড়িয়ে গত ৯ মাসে ১০টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। এরমধ্যে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে জড়িয়ে ৯টি (এরমধ্যে দুটি আপত্তিকর এবং একটি এআই কনটেন্ট) এবং ফরিদা আখতারকে জড়িয়ে একটি অপতথ্য প্রচারের প্রমাণ মিলেছে। এছাড়া প্রধান উপদেষ্টার এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদকে জড়িয়েও অন্তত একটি অপতথ্য শনাক্ত হয়েছে।
অপতথ্য ছড়ানোর বিষয়ে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, সম্মুখসারীর নারী রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে আমি যেটা দেখেছি যে, দুর্নীতিবিষয়ক গুজব বা ভুয়া তথ্য হলে সেটা বিশ্বাসযোগ্য হয় অনেকের কাছে। তবে শ্লীলতাহানির মতো ঘটনার ক্ষেত্রে অনেকেই হয়তো বিশ্বাস করে না যে, তারা এটা করে থাকতে পারেন বা এটা হয়ে থাকতে পারে।
সামান্তা মনে করেন, যারা জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে কাজ করেন তাদের জন্য এগুলো খুবই সমস্যা হয়। কারণ গুজবগুলো ওই পর্যায়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বিশ্বাস করে। সেক্ষেত্রে তার সামাজিক বা পারিবারিক প্রভাব ভয়ানক হয়।
তিনি আরও বলেন, আমার কাছে মনে হয় যে, আমাদের আক্রমণ করলে বা আমরাই যদি এটার এত শিকার হই, তাহলে বাকি নারীরা এ পথে আসার আশা ভরসা পাবে না। এটা একটা কৌশলের জায়গা থেকে করা হচ্ছে।
সবুজদেশ/এসএএস